শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

মার্চের অমলিন স্মৃতি

প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ রেজাউর রহমান
মার্চ মাস এলেই প্রতিটি বাংলাদেশি যারা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন, তাদের স্মৃতিপটে পুনঃ জাগরিত হয় স্বাধীনতার জন্য প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংগ্রামে শুরু হওয়ার কথা। এই প্রত্যক্ষ ও সশস্ত্র সংগ্রাম আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশিরা তৎকালীন পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলাম। ১৯৭০’র সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৭২টি জাতীয় সংসদ আসনের ১৭০টিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। সংসদের তিনশ আসনের মধ্যে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের আসন ছিলো ১২৮টি। ওখানে জেনারেল আইউব খানের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ভারতের সাথে যুদ্ধ করার বদলে আইউব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর শান্তিচুক্তির বিরোধিতাকারী পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপল্স্্ পার্টি বা পিপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭০’র সাধারণ নির্বাচনের পরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে ৩ মার্চ-এটাও আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণাও দিয়েছিলেন। পয়লা মার্চ মতিঝিলস্থ হোটেল পূর্বানী ইন্টারন্যাশনালে শুরু হয়েছিলা আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠক। স্টেডিয়ামে হচ্ছিলো পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড দলের ক্রিকেট খেলা। হঠাৎ স্টেডিয়ামের দিক থেকে তুমুল হট্টগোল ও গগনভেদী শ্লোগান শোনা গেলো। কিছুক্ষণ আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী ঘোষণা করেছেন। দলে দলে ক্রিকেট খেলা দেখা বাদ দিয়ে সংসদ অধিবেশন বর্জন-মানি না, মানি না; বীর বাঙালি অস্ত্রধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো শ্লোগানে শ্লোগানে আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার মানুষ হোটেল পূর্বানীর বাইরে রাস্তায় জমায়েত হয়ে অধিবেশন মুলতবী হওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিলো। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকও স্থগিত হয়ে গেলো। বঙ্গবন্ধু বাইরে এসে জনতার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বললেন, ধৈর্য্য ধরে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। তিনি ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দিলেন ও সকলকে সেখানে যোগ দেয়ার কথা বললেন।
৩ মার্চ থেকে ঢাকায় নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হবে, প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ইতোমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান হতে কয়েকটি আঞ্চলিক ও অপেক্ষাকৃত ছোট দল থেকে নির্বাচিত অনেক সংসদ সদস্যই ঢাকায় এসে পৌঁছেছিলেন। সীমান্তগান্ধী, খান আবদুল গাফফার খানের পুত্র খান আবদুল ওয়ালী খান, জমিয়তে ওলামার মাওলানা শাহ আবদুল নূরানী, মুসলিমলীগের মমতাজ দৌলতানা ঢাকায় পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি সমর্থন ও একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। শুধু পিপিপি’র নির্বাচিত সদস্যরা কেউ আসেননি-কারণ পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর হুঙ্কার ছিলো যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত সংসদ সদস্যই ঢাকার অধিবেশনে যোগ দিতে গেলে রওয়ানা হবার আগেই তার পা ভেঙ্গে ফেলা হবে। খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয়কারী ‘জুলফি’র হুমকির ফলেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদের প্রস্তাবিত অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছিলেন। ২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট ছাত্র সমাবেশ। সমাবেশে ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) সহ-সভাপতি আসম আবদুর রব পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সাথে। সেটা ছিলো সবুজ পতাকার মাঝখানে লাল সূর্য আর লাল সূর্যের মাঝে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। ৩ মার্চ পল্টনে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। জনসভায় ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ ঘোষণা দিলেন যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ই হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
৫ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের উদ্যোগে এক জনসভা, মওলানা ভাসানী এর আগেই সমুদ্র উপকূল এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও ‘গরকী’র ফলে কয়েক লক্ষ লোকের মৃত্যু ও ব্যাপক ধ্বংসলীলার পরেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ক্ষমতাসীনদের ক্ষয়-ক্ষতি দেখা ও সাহায্য করার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলায়কুম’ জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে সকাল থেকেই খ- খ- মিছিল নিয়ে ঢাকা শহর ও পার্শ্ববর্তী চতুর্দিকের জনপদ থেকে আসা শুরু হয়েছিলো প্রতিবাদমুখর জনগোষ্ঠীর। ৪৫ বছর আগে ঢাকা এতোটা জনবহুল ছিলো না। কিন্তু বিকেলের মধ্যেই আনুমানিক দশ লক্ষ লোক জড়ো হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। সভার সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেখা নেই। শোনা গেলো, চার ছাত্রনেতা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নূরে আলমসিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আসম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে জরুরি পরামর্শ সভায় আলোচনারত। ছাত্রনেতৃবৃন্দের প্রচ- চাপছিলো ৭ মার্চ রমনার জনসভায় বঙ্গবন্ধু যাতে অবশ্যই সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিলো সকল শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ বন্ধ না করার। শান্তিকামী বঙ্গবন্ধু তখনও চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হোক। বঙ্গবন্ধু জনসভায় এলেন, মঞ্চে উঠলেন, গগণবিদারী আওয়াজ ও শ্লোগানে ১০ লক্ষ লোকের সমাবেশ তাকে স্বাগত জানালো। এক অপূর্ব জাদুকরী বক্তৃতায় জনতাকে কিছু নির্দেশ, পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন এবং সর্বশেষ ‘এ বারের সংগ্রামÑমুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রামÑস্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে তার তাৎক্ষণিক ভাষণ শেষ করলেন। সভা শুরুর ২/৩ মিনিট পরেই রেডিও’র আশরাফুজ্জামান খান জানালেন যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে তারা ভাষণ রেকর্ড করে রাখছেন। ৭ মার্চের জনসভায় কোনো সভাপতি ছিলো না, কোনো সঞ্চালক ছিলো না। অন্য কোনো বক্তাও ছিলো না। বঙ্গবন্ধু এলেন, মঞ্চে উঠলেন, তার  জীবনের সেরা বক্তৃতা দিলেন এবং মঞ্চ থেকে নেমে ৩২ নং ধানমন্ডি তার বাসার দিকে চলে গেলেন।
৭ মার্চের জের থেকে প্রায় প্রতিদিন সরা দেশ জুড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ সভা, শোভাযাত্রা ইত্যাদি। ১৫ মার্চ ঢাকায় এলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভবনে (রমনা পার্কের পূর্ব দিকে) শুরু হয় মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা, এক দেড় বা দুই ঘণ্টা পর আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলে সংবাদতৃষ্ণার্ত সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করার আগেই বঙ্গবন্ধু তাদেরকে তার বাসায় যেতে বলতেন। সাংবাদিকের দল পড়ি কি মরি হয়ে ছুটতেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের দিকে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সাথে তার আলোচনার কথা তুলে ধরতেন এবং প্রায় প্রতিদিনই আগামীকাল অর্থাৎ পরবর্তী দিন পুনরায় কখন প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনায় বসবেন তা জানাতেন। এর মধ্যে আলোচনার ৩/৪ দিন পরে জনৈক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন রাখলেন, আপনার সাথে শান্তিপূর্ণ পথে সংকটরে সমাধানের জন্য আলোচনায় বসলেও পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী প্রতিটি ফ্লাইটে সৈন্য এনে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে কেনো? বঙ্গবন্ধু জবাবে বললেন, বিষয়টি তার জানা আছে এবং তিনি এটা আলোচনায় উঠিয়েছিলেন। ২২ মার্চ পর্যন্ত একটানা সাতদিন আলোচনা শেষে পুনরায় কবে আলোচনায় বসা হবে তা না জানালে বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। ২৩ মার্চ ছিলো পাকিস্তানের রিপাবলিক দিবস। সারা দেশের কোথাও এমন কি সচিবালয় বা হাইকোর্ট ভবনেও পাকিস্তানি পাতাক উড়তে দেখা গেলো না। সর্বত্র উড়ছিলো ছাত্রনেতাদের দ্বারা প্রস্তাবিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সেদিন বিকেল থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে পাঁচজনের এক প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের এক প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনায় বসেন। ২৪ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, প্রেসেিডন্ট ইয়াহিয়া খান বা তার প্রতিনিধিদলের সাথে আওয়ামী লীগের প্রদিনিধিদলের বৈঠক আসলে ছিলো প্রতারণা। আলোচনার অজুহাতে সময় নষ্ট করাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনী ও আমলাদের একটি চাল। ২৫ মার্চ সকাল থেকেই তার বাসায় যেসব আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তার সাথে দেখা করেছেন তাদের প্রত্যেককেই তিনি নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলেছেন। তার পরামর্শে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত প্রায় প্রত্যেক সংসদ সদস্যই আত্মগোপনে চলে যান।
২৫ মার্চ দিনগত রাতে শুরু হয় এক নিরস্ত্র জনগণের ওপর আধুনিক সকল প্রকার মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর আক্রমণ ও গণহত্যা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। পরের কয়েক মাসের বিভিন্ন সময়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়, সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও আপনি নিজে কেন সরে যাননি? বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলতেন, ওরা আমাকেই সবার আগে হত্যা করবে বলে আমি জানতাম। রাস্তায় নামলে গুপ্তচর আমার পিছু নিতো ও সুবিধাজনক সময়ে মেরে ফেলতো। তাই আমি নিজের ঘরে বসেই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
২৫ মার্চ রাতের পর থেকে পরবর্তী নয়মাস হানাদার পাকিস্তানিরা ত্রিশ লক্ষ বাংলাদেশিকে হত্যা করে আড়াই লাখের মতো নারীকে ধর্ষণ করে, জনপদের পর জনপদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়, অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে।
১৬ ডিসেম্বর প্রায় তিরানব্বই হাজার হানাদারের পক্ষে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে।
স্বাধীনতার পরে চট্টগ্রাম নৌবাহিনী সদর দফতরে যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানি কমোডরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো তিরানব্বই হাজার সৈন্য, অত্যাধুনিক সকল প্রকার যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়েও তাদের এরকম পরিণতি কেনো? পাকিস্তানি কমোডর বলেছিলেন, তুমি একটা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছো গ্লাসটা পানিতে ভরে গেলে পানি উপচে পড়বে। আমাদের পাপের ঘড়া তেমনি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
 লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক





 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন