সাইবার হামলা এখন বিশ্বে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। এ হামলা এতটাই ভয়ংকর যে, রাষ্ট্রের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অতি স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল তথ্য চুরি হয়ে অন্যের হাতে চলে যায়। কম্পিউটার প্রযুক্তির শুরুর দিকে এই হামলার মাধ্যমে একজনের কম্পিউটার অচল করে দেয়া হতো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কম্পিউটারে সংরক্ষিত সব তথ্য-উপাত্ত একেবারে নষ্ট হয়ে যেত। এখন এই হামলার ধরণ বদলেছে। এটি এখন মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাইবার হামলা চালিয়ে হ্যাকাররা অর্থ দাবী করছে। অনেকটা মুক্তিপণের মতো। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত কম্পিউটারে সাইবার হামলা বা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে হামলাকারিরা পুরো কম্পিউটার সিস্টেমকে অচল করে দেয়। তারপর বার্তা পাঠিয়ে অর্থ দাবী করে। গত শুক্রবার বিশ্বের প্রায় ৯৯টি দেশে একযোগে সাইবার হামলা চালানো হয়। এসব দেশের মধ্যে উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন দেশও রয়েছে। হ্যাকিংয়ের শিকার দেশগুলোর তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ¯েপন, ইতালি ও তাইওয়ানের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশ। হামলাকারিরা ‘র্যানসমওয়্যার’ নামে একধরনের ম্যালওয়ার বা ভাইরাসের মাধ্যমে এ হামলা চালায়। এতে অনেক দেশের স্বাস্থ্য, টেলিকম বা যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত ক্ষতির শিকার হয়েছে। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস। দেশটির হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে রাখতে হয়। লন্ডন, বø্যাকবার্ন, নটিংহ্যাম, গ্যালওয়ে ও হার্টফোর্ডশায়ারসহ বিভিন্ন এলাকার এনএইচএসের হাসপাতাল ও ট্রাস্টগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম থমকে যায়। হাসপাতালের কর্মীরা তাদের নেটওয়ার্কে রোগীদের তথ্য দেখতে পারেনি। ¯েপনের টেলিকম ও জ্বালানি কো¤পানি, যুক্তরাষ্ট্রের ডেলিভারি কো¤পানি ফেডএক্সও এই হামলার শিকার হয়েছে। সাইবার হামলার শিকার দেশগুলোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা অ্যাভাস্ট বলেছে, ওয়ানাক্রাই এবং ভ্যারিয়্যান্ট নামের র্যানসমওয়্যারের শিকার ৭৫ হাজার ক¤িপউটার আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছে। সংস্থাটির ম্যালওয়্যার বিশেষজ্ঞ জ্যাকব ক্রুসটেক বলেছেন, এটা বিশাল একটা ব্যাপার। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থা এনএসএর তৈরি করা একটি টুল ব্যবহার করে এই সাইবার হামলা চালানো হয়। গত এপ্রিলে শ্যাডো ব্রোকারস নামের হ্যাকাররা ওই প্রযুক্তিটি চুরি করে এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। এটি ঠেকাতে একটি নিরাপত্তা প্যাচ মাইক্রোসফট প্রকাশ করলেও অনেক ক¤িপউটারে তা আপডেট করা হয়নি।
নিঃসন্দেহে সাইবার হামলা ভয়ংকর একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে রাষ্ট্রের কোনো গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সুরক্ষিত থাকছে না। এসব গোপন তথ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের হাতে চলে গেলে হামলার শিকার রাষ্ট্র অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হতে বাধ্য। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভয়াবহ সাইবার হামলার অভিযোগ উঠতে। এতে নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে এখনও তর্ক-বিতর্ক এবং তদন্ত চলছে। সাইবার হামলার মাধ্যমে যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি উন্নত দেশের নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়া যায়, তবে তা কতটা মারাত্মক তা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না। এ তুলনায় আমাদের দেশ তো অনেক পিছিয়ে। এ ধরনের হামলার শিকার ইতোমধ্যে আমরাও হয়েছি। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হলেও পুরো অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ চুরি কীভাবে হয়েছে এবং কারা এর সাথে জড়িত তা, এখনও জানা যায়নি। বলা বাহুল্য, সাইবার হামলাকারীরা যেখানে উন্নত বিশ্বে হামলা চালিয়ে সব অচল করে দিতে পারে, সেখানে আমাদের দেশের মতো কম প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশে এ হামলা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। ইতোমধ্যে, আমাদের দেশের মানুষের যাবতীয় তথ্য মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। মোবাইল রেজিস্ট্রেশনের সময় আঙ্গুলের ছাপ নেয়া নিয়ে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যক্তির গোপন তথ্য ফাঁস এমনকি তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যাবতীয় গোপন তথ্য জানা যাবে বলে অভিযোগ উঠে। সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটবে না বলে আশ্বস্থ করা হলেও জনমনে শংকা থেকেই গেছে। এখন উন্নত বিশ্বসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেভাবে সাইবার হামলাকারীদের কবলে পড়ছে, তাতে আমাদের অবস্থান কোথায়, তা সহজে অনুমেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যত উন্নত করা হচ্ছে, তা ভেঙ্গে ফেলার বিপরীত শক্তিও সমান তালে এগিয়ে চলেছে। বলা যায়, এক ধরনের প্রযুক্তি যুদ্ধের সূচনা হয়েছে। এ যুদ্ধে যদি নিরাপত্তা প্রযুক্তি তথ্য সংরক্ষণে সফল না হয়, তবে সারা বিশ্বে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ইতোমধ্যে তার নজির সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ম্যানুয়েল পদ্ধতি উঠে যাচ্ছে। আগে কাগজ-কলমের মাধ্যমে যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাইলবন্দি করে রাখা হতো, তা এখন কম্পিউটারের ফোল্ডারে সংরক্ষিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে যেমন দ্রæত কাজ সম্পাদন করা যায়, তেমনি কম্পিউটার নষ্ট হয়ে সব তথ্য ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এর উপর নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে সাইবার হামলা। তারা এখন এতটাই বেপরোয়া যে সাইবার হামলার মাধ্যমে কম্পিউটার হ্যাক করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। অনেক সময় রাষ্ট্রও হামলাকারীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সাইবার হামলা ঠেকানোর পদ্ধতিও রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সচেতনতার। বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো প্রযুক্তির পথে হাঁটতে থাকা দেশকে অধিক সচেতন হওয়া জরুরী। প্রযুক্তি গ্রহণের সাথে সাথে তা বিনষ্ট বা বিকল করতে না পারে। এমন প্রযুক্তিও জোগাড় করে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের গাফিলতি করা যাবে না। সামান্য ভুলের কারণে কত বড় ক্ষতি হয়েছে, তা উল্লেখিত সাইবার হামলার মাধ্যমে বোঝা গেছে। এ ঘটনা থেকে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় তথ্য-উপাত্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যে অর্থ চুরি হয়ে গেছে, তা থেকে আমাদের অধিক সচেতন হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন