রফিক মুহাম্মদ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ‘বীর উত্তম’, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আজ ৩৬তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের হাতে তিনি নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫ বছর।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম, কর্মমুখরতা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলি এ দেশের গণমানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তার ঘটনাবহুল কর্মময় জীবন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন অলঙ্কৃত করে আছে। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। তা সত্তে¡ও সাধারণ মানুষের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্যে তা জোটেনি। মাত্র ছয় বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এ অল্প সময়েই তার ওপর সাধারণ মানুষের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থার তৈরী হয়েছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার ওপর মানুষের এই আস্থার কোনো কমতি ছিলনা।
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়াউর রহমান ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি তার সততা ও প্রজ্ঞা দিয়ে এদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলেন, বিশ্বে দ্রæত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দেশী-বিদেশী চক্রান্তের অংশ হিসেবে ঘাতকদের তপ্ত বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক। তিনি যে কত জনপ্রিয় ছিলেন তা বোঝা গিয়েছিল ঢাকায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত তার স্মরণকালের বৃহত্তম নামাজে জানাজায়। সেদিন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল ‘একটি লাশের পাশে সমগ্র বাংলাদেশ’। জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিকে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনো ভালোবাসে তার কারণেই।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী থানার বাগবাড়িতে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মনসুর রহমান কলকাতায় একজন কেমিস্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। শৈশব ও কৈশোরের একটি সময় গ্রামে কাটিয়ে তিনি পিতার সাথে কলকাতায় এবং দেশ বিভাগের পর করাচিতে চলে যান। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে তিনি কমিশন্ড লাভ করেন। সামরিক জীবনে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যেও তিনি একের পর এক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার সাথে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার কোম্পানি যুদ্ধে সর্বোচ্চ খেতাব লাভ করে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জন্য তিনি নিজেও একটি পিস্তল উপহার পান। সৈনিক জীবনে তিনি যেমন সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি জাতীয় সঙ্কটকালেও শক্ত হাতে হাল ধরেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যখন এদেশের নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সবাই তখন হতবাক। কি করবে কেউ কোন দিশা পাচ্ছেনা। রাজনৈতিক নেতারা যে যেদিকে পারেন আত্মগোপন কিংবা পালিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বিশ্বস¤প্রদায়কে বাংলাদেশের মানুষের এ ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে সমর্থনের আবেদন জানান। সেই সাথে ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে তিনি একটি সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে সমরনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন।
১৯৭৫ সালে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতাচ্যুত হন। সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। জাতির ভাগ্যাকাশে তখন এক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, প্রকৃতপক্ষে সে সময় দেশে কোনো সরকার ছিল না। কোথা থেকে কী হচ্ছে তা জানতে পারছিলেন না কেউ। চার দিকে এক অনিশ্চয়তা-বিশৃঙ্খলার মাঝে আধিপত্যবাদের শ্যেনদৃষ্টিতে উৎকণ্ঠিত ছিল গোটা জাতি। ইতিহাসের সেই ভয়াবহ ক্রান্তিকালে সিপাহি-জনতার মিলিত প্রয়াসে জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন এবং নেতৃত্বের হাল ধরেন। এর পর থেকে জিয়াউর রহমানকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সততা, দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও অসাধারণ মেধার গুণে তিনি শুধুই এগিয়ে গেছেন। ব্যক্তিগত সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দৃঢ় নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা, নির্লোভ, নির্মোহ, আত্মপ্রত্যয়, গভীর দেশপ্রেম প্রভৃতি গুণাবলি দিয়ে তিনি জাতির মধ্যে নতুন করে জাগরণের সৃষ্টি করেন। প্রতিদিন সারা দেশ চষে বেড়াতেন তিনি। তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল তিনি বাংলাদেশের মানুষের উপযোগী একটি স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদী আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটান। দেশে সমন্বয়ের রাজনীতি চালু করে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসেন। প্রথমে তিনি জাগদল গঠন করেন। এরপর তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিতে এক দিকে যেমন বামপন্থীরা স্থান পায়, তেমনি ডানপন্থীরাও জায়গা করে নেন। একটি উদার ও মধ্যপন্থী দল হিসেবে বিএনপিকে গড়ে তোলেন তিনি। যা বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল।
জিয়াউর রহমানের অমরকীর্তি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করা। এ ছাড়া তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। নিজে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হলেও তিনি এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখেন। জিয়াউর রহমান বিভক্তির রাজনীতি দূর করে ঐক্যের রাজনীতির ডাক দেন। তিনি উন্নয়ন এবং উৎপাদনের রাজনীতি শুরু করেন। রাজনীতিবিদদের তিনি জনগণের দোরগোড়ায় যেতে বাধ্য করেন। বিশাল কর্মকান্ডের সূচনা করে জনগণের মধ্যে তিনি সাড়া জাগান। মাত্র ছয় বছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পান শহীদ জিয়া। কিন্তু এ ছয় বছরেই তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন এবং তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে এ জাতিকে মুক্ত করেন। স্বজনপ্রীতি, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটসহ নানা অপকর্মে জাতির যখন ত্রাহি অবস্থা, ঠিক তখনই জিয়াউর রহমান শক্ত হাতে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তিনি সমগ্র জাতির মধ্যে এক নব জাগরণের সূচনা করেন। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগান তিনি। তাকে নিয়ে অনেকেই আজকাল ইঙ্গিতে কটূ কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু জীবদ্দশায় তাদের কেউ কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারেননি। এমনকি তার ব্যক্তিত্ব ও নির্লোভ চরিত্রের কাছে আজকের অনেকের চারিত্রিক দৃঢ়তা মøান হয়ে যেত। সাদামাটা জীবন যাপনের এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ কেন সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ইতিহাসে বিরল। তার চরিত্রে কোনো কপটতা ছিল না। সময় ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তিনি নেতৃত্বে এসেছেন। কাউকে উৎখাত কিংবা উচ্ছেদ করে তিনি আসেননি। এখানেই জিয়াউর রহমান ও অন্যদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। জিয়াউর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন সত্যিকার স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রয়োজন। তিনি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। একটি বহুমাত্রিক সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়নের আগেই ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারান।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী এবারে একটু ভিন্ন পরিবেশে পালিত হচ্ছে। শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির বহু নেতাকর্মীই বর্তমানে কারাগারে। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও লন্ডনে চিকিৎসাধীন বড় ছেলে তারেক রহমান মামলা মোকদ্দমার মুখোমুখি। সারাদেশের প্রায় সর্বস্তরের নেতাই বিভিন্ন মামলার আসামি। অতীতে কখনোই বিএনপিকে এতটা ঝড়-ঝাপটা মোকাবেলা করতে হয়নি। এত কিছু সত্তে¡ও জিয়াউর রহমান আজো তার অমর কীর্তিতে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে আছেন। তার আদর্শ এখনো কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অ¤øান হয়ে আছে।
বিএনপির কর্মসূচি : ৩৬তম শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে সকাল ৬-০০ টায় নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। একইভাবে সারাদেশে দলীয় কার্যালয়গুলোতে শাহাদাৎবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন করা হবে। সকাল ১০টায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর শেরে বাংলা নগরস্থ মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের উদ্যোগে মাজারে কোরানখানী ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর উদ্যোগে মাজার প্রাঙ্গনে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। সকাল ৯-০০ হতে বিকেল ৪-০০ টা পর্যন্ত নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ড্যাব এর উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান ও ঔষধ বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের উদ্যোগে বিশেষ চিত্রপ্রদশর্নী সকাল ১০টায় উদ্বোধন করবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ঢাকা মহানগর বিএনপি’র উদ্যোগে আজ ৩০ মে রাজধানীর ২৪টি স্থানে দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। সকালে জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপি চেয়ারপার্সন ধানমন্ডির সুগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে এ কর্মসূচী শুরু করবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন