শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

খাদ্যমান ও ঔষধিগুণে ভরপুর তালের শাঁস

| প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

টি এম কামাল, কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) থেকে  
জ্যৈষ্ঠের এ শেষ সময়টাতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় তালের শাঁস। এই কচি তাল, পাকা তালের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। জানান দিচ্ছে আর আর কিছুদিন পর পাওয়া যাবে পাকা তাল। বাংলায় বাগবিধিতে আছে-পিঠে তাল পড়ার কথা। এর বাইরে জনজীবনের কথামালায় খাওয়ার তাল, সুরের তাল, আভিধানিক অর্থের তাল নিয়ে কম কথা নেই। ঋতু-বৈচিত্র্যেও এসেছে তাল। গরমে তাপের মাত্রা বেড়ে গেলে বলা হয়- তাল পাকানোর গরম। প্রকৃতিই পিন্ডাকৃতির সুপক্ক ফলটি পাকিয়ে ঘন লালচে রঙের করে দিতে তাপ বাড়িয়ে দেয়। তালপাতার কদরও কম নয়। তালপাতার পাখা গরমে স্বস্তির উপকরণ। এক সময় তালপাতায় লেখা হতো। ছিপছিপে গড়নের কোন লম্বা মানুষকে দেখলে আজও বলা হয় তালগাছ। তাল পিঠা, তালের ফিরনি-পায়েস ক্ষীর মৌসুমের বড় খাবার। এর আগে কচি তালশাঁসের কদর গ্রামে ও শহরে আছে। তালের শাঁস উপাদেয় খাবার। প্রবীণরা বলেন, এর খাদ্যগুণ ও ওষুধিগুণ দুই-ই আছে। সামাজিক বিশ্লেষণ হলো, মৌসুমের ফল-ফলাদি খেতে হয়। তবে তালের রস নিয়ে কথা আছে- গাছ চুইয়ে সংগ্রহ করা টাটকা রস শরীরে ফিল্টারের কাজ করে। বিপাকে পড়তে হয় সংগৃহীত রস বিলম্বে পান করলে- তখন বেতালই নয়, সমতল ভূমিকেও চোখে অসমতল দেখা যায়। এ অবস্থা হলে লোকজন সহজেই বুঝতে পারে কী হয়েছে। চিরচেনা তালগাছের আদিনিবাস আফ্রিকায়। বহুকাল আগে এই দেশে তার আগমন। বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন বোরাসুস ফ্লাবেলিয়ার। খুবই ধীরে বাড়ে। বসন্তের শেষে ফুল ধরে ফল পাকে শরতে। পোক্ত কান্ডের গাছ ঘরের শক্ত খুঁটি হিসেবে ব্যবহার হয়। তালের আশ দিয়ে হস্তশিল্পের নানা কিছু তৈরি হচ্ছে। কুটির শিল্পে পরিণত হয়ে রফতানি হচ্ছে। আফ্রিকার তাল তালমিলিয়ে দাপটেই আছে এই দেশে।
গ্রামের সুন্দর দৃশ্য আঁকতে তালগাছ জুড়ে না দিলেই নয়। একটা সময় লম্বা ঋজু একহারা চেহারার তালগাছ নেই- এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যেত না। দূর থেকে দেখা যায় এমন তালগাছ ছিল গাঁয়ের কোন বাড়ি চেনার দিকনির্দেশক। গেল শতকের মধ্যভাগের পর গ্রামে তালগাছ কমে যাওয়া শুরু হয়। অন্যতম কারণ, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে খন্ডিত পরিবার শুরু হওয়া। বাড়ির ধারের তালগাছ কাটা শুরু হয়। অনেক গ্রামে তালগাছ খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমানে সড়কের ধারে সারিবদ্ধ তালগাছ দেখা যায়। তালগাছ নিয়ে আমাদের অনেক বড় গর্ব আছে। শৈশবের পাঠে সেই পদ্য ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে...রচনা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দেশেই’। আমাদের কাব্যে সাহিত্যে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে তালগাছ। বনফুল তার ‘নুড়ি ও তালগাছ’ নামের গল্পটিতে এমন সাহিত্য সৃষ্টি করছেন, যা অমর হয়ে আছে। এই গল্পের বর্ণনায়- বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ এক তালগাছ। তলায় পাথরের ছোট্্র নুড়ি। ঘাসই তার ভুবন। উঁচু তালগাছ তার কাছে বিস্ময়। নুড়ি গাছকে জিজ্ঞাসা করে- কে আপনি? অত উঁচুতে কী দেখেন। এভাবেই গল্পের গতি নিপুন ছন্দ নিয়ে এগিয়ে যায়। তালপাতার পুঁথি ও তালপাতার সেপাইয়ের কথা কে না জানে। কেচ্ছা কাহিনী ও শিশু সাহিত্যেও তালগাছকে নিয়ে অনেক মজা আছে। বিশাল পাথারে এক তালগাছ তাতে মামদো ভূতের বাস। কেচ্ছায় ভরদুপুর এই তালগাছ। একবিংশ শতকেও এমন গল্প প্রবীণদের কাছে শোনা যায়। গল্পের শুরুতে বলা হয়...অ-নে-ক আগের কথা... তালগাছের মাথায়...। এমন গল্প শুনে তালগাছের তলা দিয়ে না যাওয়াই ভালো। ভূতপেতœী না থাক পিঠে তাল পড়লে ক্যাঁ-কু্যঁ করতে হতে পারে। এই তালগাছ বাবুই পাখির খুব পছন্দের। প্রকৃতির আর্কিটেক্ট বাবুই তালগাছের সরু ডগায় খড়কুটা দিয়ে যে বাসা বানায়, তা চিরকালের ক্ল্যাসিক শিল্পকর্ম হয়ে আছে। ওদের কাছে বড় আশ্রয়ের জায়গা তালগাছ।
তাল নিয়ে যে কত কথা...। কেউ উলটপালট কথা বললে, আনন্দে ও কোন কারণে ধৈর্যচ্যুতি হয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করলে সোজাসাপ্টা বলা হয় ‘বেতাল হয়ে গিয়েছে’। বেসুরো গান, তবলার তাল কেটে গেলে বলা হয়- তাল কেটে বেতাল হয়েছে। কোন কাজে এলোমেলো কিছু করলে বলা হয় ‘তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে’। এক শ্রেণীর মানুষ কারও কাছে ভাল থাকার জন্য বা ভাল সেজে থাকতে তাল মিলিয়ে কথা বলেন। ভিলেজ পলিটিকস্ থেকে শুরু করে সমাজ জীবনে, চাকরি জীবনে তাল মিলিয়ে চললে মন পাওয়া কঠিন নয়। আবার মোসাহেবী করতে তাল মিলিয়ে চলা বাঞ্ছনীয়। তাল নিয়ে এত কথার পরও বলতে হয় সব কিছুই কি তালগোল পাকিয়ে গেল...।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন