বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

খুতবা নিয়ন্ত্রণ কল্যাণকর নয়

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শুক্রবার সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনে ছোট-বড় সবাই জুমার সালাতে উপস্থিত হতে চেষ্টা করে। যিনি প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন না বা মাঝে মাঝে সালাত আদায় করেন তিনিও জুমার সালাত আদায় করতে মাসজিদে যান। বিশেষ করে প্রথম আজানের পরপরই মুসল্লিরা ইমাম ও খতিবের আলোচনা শোনার জন্যই উপস্থিত হন। তবে কেউ কেউ ব্যতিক্রমও আছেন, ইমাম বা খতিব কী আলোচনা করলেন সেটা নিয়ে তাদের আগ্রহ তেমন দেখা যায় না। তবে অধিকাংশ লোকের অভ্যাস হলো যে মাসজিদে আলোচনা ভালো হয়, সে মাসজিদে সালাত আদায় করে থাকেন, সেটা যত দূরেই হোক। তাদের কাছে শুক্রবারের আলোচনাটা শোনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণতই ধর্মীয় আলোচনা শুনতে ভালোবাসেন। বর্তমান সময়ে কোরআন-হাদিসের মাহফিল তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। যার ফলে শুক্রবারের আলোচনা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সম্প্রতি আমরা লক্ষ করা যাচ্ছে ইমামদের কণ্ঠরোধ করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ব্যানারে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।
খতিবরা যদি সঠিকভাবে কোরআন ও সুন্নাহ’র আলোচনা পেশ করেন তাহলে কারো না কারো ব্যক্তি স্বার্থে আঘাত লাগবে। তাই বলে কী সত্যকে চেপে রাখা হবে। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মুসলিম হলেও কতভাগ মুসলিম এবং রাষ্ট্রপরিচালনার অংশীদারকে পাওয়া যাবে যারা সঠিকভাবে কোরআন ও সুন্নাহ মেনে চলেন? যারা কোরআন-সুন্নাহর বিপরীত চরিত্রের মানুষ তাদের সেটা শুনতে গাত্রদাহ হবে এটাই স্বাভাবিক। ইমামরা যেহেতু সমাজের ধর্মীয় নেতা, তাদের প্রতি মানুষের আস্থা সর্বাধিক বলে তারা যা বলেন তার মাধ্যমে মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করেন। খতিবরা যেহেতু হক কথা বলেন তাই তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের অসৎ চরিত্রের মানসিকতায়পূর্ণ ব্যক্তিদের নজরদারিও বেশি! আবার যারা কোরআন-সুন্নাহকে পাশকাটিয়ে কাট-ছাঁট করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলেন তাদের সংখ্যাও কম নয়। দুর্নীতিবাজদের গায়ে যাতে কোনো কথা না লাগে সে জন্য যত প্রকার ফন্দি-ফিকির আছে তার সবটাই করা হয়।
ইমামদের নিয়ন্ত্রণ করা কখনই সুফল বয়ে আনতে পারে না। নেতিবাচক এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হয়তো মিশরকে অনুসরণ করা হচ্ছে। গত বছরের (২০১৪) ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি’র এক সংবাদ থেকে জানা গেছে, মিশরের বহু মসজিদে জুমার খুতবা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সে দেশের সামরিক বাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে ইসলামি স্কলার সাদিকুর রহমান আল-আজহারি’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সেনা সমর্থিত সরকারের সমালোচনা বন্ধ করতে বা নিষিদ্ধঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক ইমামদের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করতেই সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই বাক স্বাধীনতার ওপর মিশরের সরকার কড়াকড়ি আরোপ করেছে। সে দেশের ধর্মমন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে খুতবার বিষয়বস্তু যা নির্ধারণ করে দিবেন তাই আলোচনা করতে হবে। একই সাথে বিষয়বস্তু অনুমোদিত একটি কপি ইমামকে সরবরাহ করা হয়। যদি কোনো ইমাম তা না মানেন তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। খতিবকে যদি কথা বলার স্বাধীনতা না দেওয়া হয় তাহলে তিনি কোনোভাবেই সঠিক কথা প্রচার করতে পারবেন না। এই রকম একটি সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করেছে যা মোটেই কল্যাণকর নয়। মিশরের এই অপতৎপরতার পর-পরই বাংলাদেশে খুতবা নির্ধারণের বিষয়ে টকশোতে কথা বলছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক কর্তা ব্যক্তি। যদি তার সাথে অন্যসবাই একমত নন। তবুও খুতবাহ নিয়ন্ত্রণে খতিব কাউন্সিল গঠন করার প্রক্রিয়াটি  ইতিবাচক নয়।
দেশে জঙ্গি তৈরি হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো আপস হতে পারে না। কারণ ইসলামে জঙ্গিবাদের স্থান নেই। ইসলাম সন্ত্রাসকে বরাবরই নিন্দা করে। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করাকে ইসলাম সমর্থন করে না। কেউ যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে অবস্থান নেয় আর এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকে তাহলে তাকে আইনের আওতায় আনা যেতে পারে। তবে এই অযুহাতে একজন ভালো মানুষকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা অনুচিত। খতিবরা সকল বিষয়ে শাসক শ্রেণির মত ও চিন্তার সাথে সহমত নাও হতে পারেন, কিংবা বিরোধী দল ও মতের হতে পারেন। তাই বলে তাদের অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত করা আরেক ধরনের অশান্তি সৃষ্টির কারণ। আলেমসমাজ মনে করেন, জঙ্গিবাদ রোধের নামে এটা খতিবদের নিয়ন্ত্রণ করার পাঁয়তারা মাত্র।
ইতোমধ্যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, অনেক ক্ষেত্রে ইমাম ও খতিবরা জুম্মার খুতবায় কী আলোচনা করবেন সেটা আলোচনার আগেই মাসজিদের সভাপতি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সেটা লিখিত, মৌখিক কিংবা উভয় রীতি চালু আছে। এ ধরনের নিদের্শনা দেয়া অনুচিত, যা অনধিকার চর্চার শামিল। আবার কিছু কিছু মসজিদের ইমাম ও খতিবদের এমনভাবে শাসানো হয়, যাতে তারা প্রভাবশালীদের মন রক্ষা করে আলোচনা করেন। তাদের মধ্যে যে ধরনের অপরাধ বিদ্যমান সেসব বিষয়ের আলোচনা যাতে কখনোই করা হয় না।
আবার কিছু কিছু মাসজিদের মুতাওয়াল্লি ও কমিটির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে যোগ্য ইমাম ও খতিব নিয়োগ দেয়া হয় না। ইমাম ও খতিব নিয়োগের ক্ষেত্রেও চলে আত্মীয়করণ, দলীয়করণ। যার ফলে যোগ্যতাসম্পন্ন ইমাম ও খতিবরা তাদের কাছে অযোগ্যই থেকে যায়। আবার এমনটিও ঘটে যে, সঠিকভাবে কোরআন-হাদিসের আলোচনা তুলে ধরলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থে আঘাত লাগে। কখনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিপক্ষে চলে যায়। তাই বারবার ইমাম ও খতিবদের অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত করা হয়। কখনো কখনো নির্যাতন করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়া হয়। এটি এক ধরনের যুলুম। আর যারা জুলুম করে তাদের ব্যাপারে সূরা আরাফের ৪৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সাবধান! অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর লানত বা অভিশাপ।’ সহিহুল বুখারিতে উল্লেখ করা হয়েছে মহানবী সা. বলেছেন, ‘একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, সে তার উপর জুলুম করতে পারে না এবং জালিমের হাতে সোপর্দ করতে পারে না।’ বুখারি শরীফের অন্য একটি হাদিসে এসেছে, “অত্যাচারিতের ‘বদ’ দোয়াকে ভয় কর, কেননা তার বদ দোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই।” ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী, সে যেন আজই তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয় সেই দিন আসার আগে, যেদিন তার কোনো অর্থ-সম্পদ থাকবে না। সেদিন তার কোনো নেক আমল থাকলে তা থেকে জুলুমের দায় পরিমাণ কেটে নেয়া হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তাহলে যার উপর জুলুম করেছে, তার বদ আমল থেকে নিয়ে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে’(বুখারি)। সুতরাং খুতবাহ নির্ধারণের নামে খতিবদের ওপর অন্যায়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত যেন চাপানো না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ন্যায় বিচার করতে হবে।
যারা সর্বদাই সত্যের বিপরীত কাজ করেন ও বিপথে চলেন তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে সঠিক পথের নির্দেশনা দেন ইমাম, খতিব ও আলেমসমাজ। নবী-রাসুলদের জ্ঞানের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তারা দায়িত্ব পালন করেন। যুগে যুগে মহান আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নবী-রাসূল, সাহাবী, মুমিন, ইসলামী দলগুলোর কর্মীদের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আর এসব কিছুই ঈমানী পরীক্ষার অংশ মাত্র। তেমনি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জুমার খুতবায় কুরআন-সুন্নাহর বাণীর আলোকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া ইমামদের দায়িত্ব। এ কঠিন কাজটি সম্পন্ন করা বাতিলের সাথে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে সত্য থেকে বিরত রাখার যে অপচেষ্টা করা হচ্ছে তার মোকাবিলায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
আল কোরআনের একটি উল্লেখযোগ্য নাম ‘আল ফুরকান’ (সত্য মিথ্যার প্রভেদকারী)। কুরআন থেকে আলোচনা করলে নিশ্চয়ই বাতিলের সাথে বিরোধ লাগবেই। অন্যায় ও বাতিলের সাথে কোনো আপস ইসলামের শিক্ষা নয়। দুনিয়ায় বুকে তাওহিদের কথা বলতে গেলে বাধা আসবেই। তাই বলে সত্য বলা থেকে বিরত থাকা কারো জন্যই উচিত হবে না। এদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইমামদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী প্রত্যেক ব্যক্তি ঈমানের দাবিতে অটল থাকবেন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম বিরোধী সকল চক্রান্ত ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য নবী-রাসূলদের উত্তরসূরী হিসেবে একটি দলকে দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হোক, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর তারাই সফলকাম’ (আল ইমরান-১০৪)।
ইসলামি স্কলারগণ মনে করেন, ইমাম ও খতিবরা নিজেরা ব্যক্তি জীবনে একজন দাঈ। একই সাথে তারা সমাজের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতাও বটে। সে কারণে যথাযথ দায়িত্বের সাথে ইমাম ও খতিবরা কোরআন-হাদিসের আলোকে বিজ্ঞানভিত্তিক তাত্ত্বিকপূর্ণ বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার মাধ্যমে একজন মুসলিমের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ের আলোকে জুমার খুতবাহ পেশ করেন। এ বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তাদের আলোচনার দ্বারা মুসল্লিদের জ্ঞান সম্প্রসারিত হয়। মসজিদে নামাজির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাই কোরআন-হাদিসে পারদর্শী এবং সময়ের প্রেক্ষাপট নিয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা খুবই প্রয়োজন।
সর্বোপরি, দেশ পরিচালনায় যারা অংশ নেন তাদের কেউ যদি রাষ্ট্রের সম্পদকে নিজের মনে করে অন্যায়ভাবে ভোগ দখল করেন, কাউকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্র করেন, জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেষ্টা করেন, সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা চাই এদেশের প্রতিটি মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বর্হিপ্রকাশ ঘটুক। জঙ্গিবাদের অবসান হোক। একই সাথে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। আমরা মনে করি, ইমাম বা খতিবগণ আল কোরআন ও সহিহ হাদিস জেনে-বুঝে, ব্যক্তিজীবনে আমল করে আলোচনা করেন। শিরক ও বিদয়াত মুক্ত তাওহিদি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে আহ্বান জানান। তাই তাদের ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এ কারণে সাধারণ মানুষ তাদের দেওয়া বক্তব্য থেকে নিজেদের জীবন পরিচালনা এবং সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকেন। তাই তাদের আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো মানে হয় না। “সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ” আল্লাহর এই হুকুমটি যাতে নির্বিঘেœ পালন করা যায় সেই লক্ষ্যে সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
mabdulkahhar@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন