শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

আবারো নিষেধাজ্ঞার কবলে ইরান

হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ইরান ও ইরান সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী ছিল বিশে^র মনোযোগের কেন্দ্রে। এ তিনদিনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটে। ১৬ জানুয়ারি শনিবার ইরানের উপর থেকে দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। আনন্দোৎফুল্ল ইরান সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ৩ মার্কিন বন্দিকে মুক্তি দেয়। তারপরই ইরানের আনন্দের আলোভরা দিগন্তে কালো ছায়া নেমে আসে নতুন করে মার্কিন অবরোধ আরোপের ঘোষণায়। এদিকে বিশ^বাজারে ইরানের তেল সরবরাহ শুরুর উদ্যোগে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ২৮ ডলারে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ইরানের উপর থেকে অবরোধ অবসানে ঘোষণার পরদিন সউদি শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটে। এদিকে ধারণা করা হচ্ছে যে তেলের দাম শিগগিরই ব্যারেলপ্রতি ২০ ডলারে নেমে আসবে।
পাশ্চাত্যের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের সাথে পাশ্চাত্যের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় ’৭৯-র ইসলামী বিপ্লব পরবর্তীকালে। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের কিছু দেশ ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে ইরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপের ঘটনা ঘটে আরো পরে, ২০০৩ সালে। পুরনো ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ’৫০-এ দশকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ কর্মসূচি শুরু করে। ’৭৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশের সহযোগিতায় সে কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের কারণে তাতে ছেদ পড়ে। পরে ১৯৮১ সালে ইরানি নেতৃত্ব পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার সাথে ইরানের চুক্তি হয়। ’৯০-এর দশকে এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় রাশিয়ার সাথে। রাশিয়া পরমাণু বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি তথ্য দিয়ে ইরানকে সহায়তা করে।
২০০০ সালের দিকে ইরানের গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির কথা ফাঁস হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু পশ্চিমা দেশে হৈচৈ শুরু হয়। ভিন্ন মতাবলম্বী ইরানিরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ দাখিল করে। শুরু হয় পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে ইরানকে নিবৃত্ত করার বহুমুখী চেষ্টা। তাতে কাজ না হওয়ায় প্রধানত মার্কিন উদ্যোগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২০০৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রথম ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় এ অবরোধ আরো ব্যাপক করা হয়। এর পরিণতিতে চরম দুরবস্থার শিকার হয় ইরানের অর্থনীতি। বিশেষ করে রাজস্বের প্রধান উৎস তেল রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তার তেল শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে এককালের বেশ সবল অর্থনীতির দেশ ইরান।
তবে এটা ঠিক যে অর্থনৈতিক দিক থেকে একেবারে কাহিল হয়ে পড়লেও ইরান তার সামরিক সক্ষমতাকে সাধ্যানুযায়ী টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। এর প্রমাণ মেলে ইরাকে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে তার সামরিক উপদেষ্টা মোতায়েন, সিরিয়ায় বাশার সরকারের পক্ষে লড়াই করার জন্য যোদ্ধা প্রেরণ এবং ইয়েমেনের শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থনের ঘটনায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরানকে যে কোনো মূল্যে তার পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত রাখতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। দেখা যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তাতে সফল হয়েছে তারা। আর মার্কিন কঠিন চাপের মুখে অনমনীয় থাকা ইরান বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত ও সীমিত করতে সম্মত হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের জুলাইতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ বিশ^শক্তির সাথে স্বাক্ষরিত হয় পারমাণবিক চুক্তি। এ চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জাতিসংঘের আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সন্তুষ্টিমূলক সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। বহুকাক্সিক্ষত এ ঘোষণায় ইরানে আনন্দের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার নামে। ইরানি নেতারা দিনটিকে নতুন যুগের সূচনা বলে আখ্যায়িত করেন। কার্যত গোটা ইরানই নতুন আশা ও স্বপ্নে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু ১৭ জানুয়ারি ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কারণে ইরান ও ইরানের সাথে সংশ্লিষ্ট ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এর ফলে ওই ১১ কোম্পানি ও ব্যক্তি মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়বে। এদিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণার সাথে সাথে গুপ্তচরগিরির দায়ে আটক তিন মার্কিনিকে মুক্তি দিয়েছিল ইরান। এটা ছিল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যরে নিবিড় বার্তা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন সম্পর্ক রচনায় এ প্রচেষ্টা কোনো কাজে আসেনি, বরং এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের আসল চেহারাকেই প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এ বিষয়টিকে ‘ইরানকে বশে এনে কষে চড়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সোমবার পত্রিকাটি জানায়, ‘পরমাণু চুক্তি কার্যকরের পর ইরানের উপর নতুন করে অবরোধ আরোপ করে কার্যত তাকে ফাঁদে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয় শনিবার। এর আগে শর্তানুযায়ী ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করে আনে। বন্ধুত্বের আরো নিদর্শন স্বরূপ তিন মার্কিন বন্দিকে মুক্তি দেয়। কিন্তু এসবই ছিল ছেলে ভোলানো। অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার কথা বলে তেহরানকে বশে এনে মূলত কষে চড় দিয়েছে ওয়াশিংটন।’
নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, ইরানের উপর নতুন অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে তিন মার্কিন বন্দির মুক্তি বাধাগ্রস্ত হতে পারে এ আশঙ্কায় মার্কিন কর্মকর্তারা বিলম্বের কৌশল গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সাথে সাথে ইরান বন্দিদের মুক্তি দেয়। তাদের ইরান ত্যাগের খবর নিশ্চিত হওযার সাথে সাথে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
৬ জাতির সাথে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি মোতাবেক ইরানের পক্ষে আর কখনো পারমাণবিক শক্তি হয়ে না ওঠার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও বলেছেন, ইরানকে কখনোই পারমাণবিক শক্তি হয়ে উঠতে দেয়া হবে না। সে সাথে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতাও অর্জন করতে না দিতে বদ্ধপরিকর বলে সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা ইরান বিরোধিতাই নয়, ইসরাইলের ঘোষিত ইরান বিরোধিতারও প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। ইসরাইলও কোনোভাবেই পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন ইরান দেখতে চায় না। ৬ বিশ^শক্তির সাথে এক্ষেত্রে তার অবস্থান এক কাতারেই।
ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর না হতে দেয়ার সব পাকাপোক্ত ব্যবস্থার বিপরীত দিক হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমাজ ও বাজারে ইরানের পূর্ণ প্রত্যাবর্তন। সাধারণ ইরানি জনগণের জন্য পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী ইরান নয়, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ইরান প্রয়োজন। গত বছরের জুলাইতে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে বিভিন্ন দেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রূপ গ্রহণ করবে। বিশেষ করে ইরান তার রাজস্বের প্রধান উৎস তেল রফতানি শুরু করতে পারবে। ইতোমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণার সাথে সাথেই বিশ^বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমেছে। মঙ্গলবার তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ২৮ ডলার। ২০০৩ সালে পর তেলের দাম এত নিচে আর নামেনি। ইরান এখনো তেল রফতানি শুরু করেনি। বহুদিন তেল উত্তোলন বন্ধ থাকায় তার তেলক্ষেত্রগুলোর বর্তমান সক্ষমতা এখনো পরীক্ষিত হয়নি। ইরান বলেছে, প্রথম পর্যায়ে তারা দৈনিক ৫ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করবে। ক্রমেই এ পরিমাণ বাড়বে। ধারণা করা হচ্ছে যে, বিশ^বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা আপাতত একেবারেই নেই। বরং তা আরো হ্রাস পেয়ে অচিরেই ২০ ডলারে নেমে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে তেল রফতানিনির্ভর অন্য দেশগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। বিশেষ করে সউদি আরব। একদিকে তেলের বিপুল মূল্যহ্রাসের কারণে অকল্পনীয় পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতি অন্যদিকে ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বেহিসেবি অর্থ ব্যয়ের কারণে দেশটি মারাত্মক অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন। শনিবার ইরানের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের খবরে রোববার সউদি শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন তারই ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে।
ইরান সোমবার তার উপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এ নিষেধাজ্ঞা অবৈধ। এর কোনো নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, এ নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে। অন্যদিকে ইরানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কার্যত এ নিষেধাজ্ঞার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে বলেছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
বিশে^ পারমাণবিক শক্তি অর্জনের প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকুক তা শান্তিকামী বিশে^র কাম্য নয়। সে হিসেবে ইরানের পারমাণবিক শক্তি অর্জনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা যায় না। ইরান কেন, অন্য কারোরও এ ধরনের চেষ্টা কাম্য নয়, কারণ তা আরো অনেক দেশকে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের বিপজ্জনক পথে চালিত করতে পারে। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি সবার ক্ষেত্রেই সমান হওয়ার কথা হলেও তা হয়নি। বিশেষ করে ইসরাইলের পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল বিশ^শক্তিই এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বনের পথ অনুসরণ করছে। পক্ষান্তরে একই পথ অনুসরণ করতে গিয়ে ইরানকে এক দশকেরও বেশি সময় প্রচ- যন্ত্রণাদায়ক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত শক্তিমানদের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এ ঘটনায় আবার প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ^ বহুলাংশেই পরিচালিত হয় শক্তিমানের ইচ্ছায়, সুবিচার ও ন্যায় দ্বারা নয়।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর ইরানের জনগণের সামনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথ আবার উন্মুক্ত হয়েছে। পারমাণবিক শক্তি নয়Ñঅর্থনৈতিক শক্তিই হবে ইরানের মেরুদ-Ñএটাই এখন ইরানের আগামী দিনের জাতীয় স্লোগান হওয়া উচিত। বিরোধ-সংঘাত নয়, সমৃদ্ধির পথ ধরে দেশটি অনেকদূর এগিয়ে যাবে এটাই শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন