শফিউল আলম : পাহাড় ধসের ঝুঁকি কাটেনি। ভরা বর্ষা মৌসুমের এ মাসেও (আষাঢ়-শ্রাবণ) ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। টানা অতিবর্ষণের সময় পাহাড়ি ভূমিধসের আশঙ্কা তীব্র। কেননা চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ের গড়ন বৈশিষ্ট্য এমনিতেই বালু ও নরম মাটির। তদুপরি পাহাড় টিলাগুলোর বন-জঙ্গল উজাড় ও সর্বত্র পাহাড় ন্যাড়া হয়ে গেছে। এরপর কেটে খুঁড়ে ছেঁটে ও খুঁদে ফেলায় পাহাড় টিলা বেশিরভাগই নড়বড়ে এবং ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। অতিবর্ষণ হলেই পাহাড় কিংবা পাহাড়ের পাদদেশ ধসে গিয়ে সেখানে থাকা জনবসতিকে বিধ্বস্ত ও তাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি প্রকট। গত জুন মাসে (প্রাক-বর্ষায় ও বর্ষার শুরুর দিক) সারাদেশে পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এরমধ্যে প্রায় ৩০ ভাগই বর্ষণ হয় বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট তথা পাহাড়ি অঞ্চলে। চলতি জুলাই মাসেও যদি অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল নামে তাহলে পাহাড়ি এলাকায় ফের বিপদের শঙ্কা। দক্ষিণ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আবহাওয়ামন্ডলে আগের এল-নিনোর (বৃষ্টি নিরোধক) প্রভাব কেটে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে বৃষ্টিপাত। বাংলাদেশের উপর বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ু ক্রমাগত বেশি সক্রিয় হতে থাকায় এ সপ্তাহের শেষ দিক থেকে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। আবহাওয়া ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সূত্র একথা জানায়।
এদিকে সামনে ভারী বর্ষণে বিপদের আশঙ্কা মাথায় নিয়েই চট্টগ্রামে পাহাড়-টিলারাশি ও তার পাদদেশে লাখ লাখ মানুষ বসবাস করছে। চট্টগ্রাম মহানগরী ও শহরতলী এলাকায় বর্তমানে বিপজ্জনক ভঙ্গুর অবস্থায় আছে ১৭টি পাহাড় টিলা। সেখানে উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ। একই সাথে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলজুড়ে একশ’রও বেশি পাহাড় টিলায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাস করছে ১৮ লাখ মানুষ। গত ১১, ১২ ও ১৩ জুন মৌসুমি নিম্নচাপের প্রভাবে টানা ভারী বর্ষণে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি জনবসতির উপর পাহাড়-টিলা ধসে গিয়ে রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার ও খাগড়াছড়িতে প্রায় পৌনে ২শ’ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এর আগে-পরে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসরতদের অবিলম্বে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বিভিন্ন স্থানে মাইকিংসহ প্রশাসন তৎপর হয়। পাহাড়ের অনেক বাসিন্দাকে সরিয়েও নেয়া হয়।
তবে পাহাড় টিলার ভূমিদস্যু চক্র এবং তাদের সাথে যাগসাজশে থাকা বিশেষত ক্ষমতাসীন দলীয় প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা-কর্মী, ক্যাডারদের নানামুখী চাপে অনেকেই আবার ফিরে আসে পাহাড়ের ঘরবসতিতে। প্রতিবছরই প্রশাসন কিছুদিন তৎপর হলে পাহাড় ও পাদদেশের বাসিন্দাদের সাময়িক সরে যাওয়া, আবার ফেরার দৃশ্য সবার চোখে পড়ে। এভাবে গেলে প্রশাসন এবং সেই সংঘবদ্ধ চক্রের নিয়োজিত দালালদের মধ্যকার কানামাছি খেলা চলছে। অথচ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কোন উদ্যোগ নেই। পাহাড় টিলা ও পাদদেশে বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ জেনে কিংবা না জেনে বসবাসরত বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হতদরিদ্র হকার-মজুর, দিনে এনে দিনে খাওয়া ভূমিহীন পরিবার। ওরা পরিণত হয়েছে ভূমিদস্যু চক্র ও তাদের দালালদের অসহায় হাতের পুতুল। অন্যদিকে চট্টগ্রামজুড়ে পাহাড়ি বন-জঙ্গল কেটে ন্যাড়া করে সেসব পাহাড়-টিলা ও ঢালু কেটে খুঁড়ে অবৈধ দখলে নিয়ে স্থায়ী অথবা অস্থায়ী ঘর-বসতি তৈরি করা হয়। এরপর বসতহারাদের ভাড়া দিয়ে, কোন সময় চাঁদার বিনিময়ে থাকতে দেয়া হচ্ছে। আবার সেসব পাহাড়-টিলা কেটে বালি ও মাটি বিক্রি হচ্ছে অবাধে। এভাবে কাড়ি কাড়ি টাকা পকেটে ভরছে ভূমিদস্যু ও তাদের নিয়োজিত দালাল চক্র। যারা থাকে সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে। অসহায় লাখো মানুষকে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
নিবিড় বনায়নের তাগিদ
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং বর্ষা এলেই পাহাড় টিলার বাসিন্দাদের সারানোর নামে ঘুরেফিরে আসা-যাওয়ার সমাধান কী? এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সফিউল আলম গতকাল (শনিবার) ইনকিলাবকে জানান, পাহাড়ে কিংবা পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে হবে। কেননা মানুষের জীবন নিয়ে ঝুঁকি মেনে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। তাদের স্থায়ীভাবে নিরাপদ বসবাসের জন্য অবশ্যই বিকল্প সংস্থান সরকারকেই করতে হবে। এরজন্য সমন্বয় ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন। উচ্ছেদ কোন সমাধান নয়, মানবিকও নয়। কেননা তারা ক’দিন কোথাও ঘুরেফিরে আবার ঝুঁকি সত্তে¡ও পাহাড়ে ফিরে আসে। যেহেতু বিকল্প নেই। তিনি জানান, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরানোর পর দ্রæত সেখানে বনায়ন করতে হবে। নিবিড় বনায়ন হলে গাছের শিকর মাটিতে শক্ত করে ধরে রাখে। আলগা হতে দেয় না। পাহাড় ধস বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, পাহাড়ের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট অর্থাৎ পাহাড়কে প্রতিনিয়ত ‘ডিসটার্ব’ করা হচ্ছে। পাহাড় টিলার বন উজাড় ও ন্যাড়া করা, মাটি কেটে খুঁড়ে, পাহাড়ের ঢালু বা শানুদেশ (¯েøাপ) কেটে নষ্ট করার কারণে টানা বৃষ্টিপাত হলেই ভূমিধস বাড়ছে। অথচ যেখানে পাহাড় এখনও অক্ষত আছে সেখানে ধস হচ্ছে না অথবা কম হচ্ছে। পাহাড় ধ্বংসকরণ বন্ধ করতেই হবে। সেই সাথে বনায়নের বিকল্প নেই।
চট্টগ্রামের সুশোভিত পাহাড়ের উঁচুনিচু ভূমির আগ্রাসীরা দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের বেদখলে থাকা নগরীর ১৭টি জরাজীর্ণ ও নাজুক পাহাড়ে, পাদদেশে বসবাস করছে ছিন্নমূল ৫ লাখ মানুষ। তারা অতিলোভী প্রভাবশালী ভূমিদস্যু চক্রের কাছে কার্যত জিম্মি হয়ে আছে। শুধুই বন্দরনগরীতে অধিকতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে- লালখানবাজার মতিঝর্ণা, কুসুমবাগ, খুলশী পাহাড়, বাটালি হিল, জয়পাহাড়, হামজারবাগ নবীনগর, বার্মা কলোনী, গোল পাহাড়, দেবপাহাড়, বায়েজিদ, পাহাড়তলী, জালালাবাদ পাহাড়, নাছিরাবাদ পাহাড়, এনায়েত বাজার পাহাড়, জামতলা পাহাড় টিলায় বসবাসরতরা। আর বৃহত্তর চট্টগ্রামে, চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, মিরসরাই, সীতাকুÐ, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালীতে এবং কক্সবাজার শহর ও জেলা, তিনটি পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে শতাধিক কম-বেশি ঝুঁকিবহুল পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ।
পাহাড়-টিলা খাদক ভূমিদস্যুদের প্রভাবের কাছে সরকারি প্রশাসনের বাধা-বারণ, নিষেধাজ্ঞা তুচ্ছ প্রমাণিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, ওয়াসা, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থার উপর্যুপরি অভিযান চালানোর কিছুদিন পরই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠিকে নেপথ্যে সেই চক্রটি ফের পাহাড়ে বা ঢালে বসবাস করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে কোনমতে মাথাগোঁজার ঠাঁই না থাকার সুবাদে ছিন্নমূলদের নিয়মিত ভাড়া ও চাঁদা উসুল করে নিচ্ছে চক্রটি। এতে করে পাহাড় টিলার ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসরত লাখ লাখ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় টিলার ভূমি, মাটি ও বালি বেচাকেনাসহ তাবৎ অসৎ ও অবৈধ বাণিজ্যে লাখ লাখ টাকা হাতবদল হচ্ছে প্রতিদিনই। ইটভাটায় পাহাড় টিলার মাটির চাহিদা বেশিই রয়েছে। এ কারণে ভূমিদস্যু রাঘব-বোয়ালরা অবৈধভাবে পাহাড় দখল করে দিনে ও রাতে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। ইটভাটাকে ঘিরে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, সাতকানিয়ায় সারি সারি পাহাড়-টিলা কাটা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড় ধস ট্র্যাজেডির (নিহত ১৩৬ জন) ঘটনায় তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এএমএন সিদ্দিকের নেতৃত্বে গঠিত একটি টেকনিক্যাল কমিটি পাহাড় ধসের পেছনে ২৮ কারণ চিহ্নিত করেন। আর পাহাড়ধস রোধে সরকারের কাছে ৩৬টি সুপারিশ পেশ করেন। তবে ধারাবাহিক সমন্বয় ও উদ্যোগের অভাবে তা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন