মো. ওসমান গনি : সরকারি হিসাব মতে গড়ে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ৪০০০। আর তার ২১ শতাংশ হচ্ছে ১৬ বছরের নিচের বয়সী শিশু। অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা কখনও পথচারী, কখনও সাইক্লিস্ট এবং কখনও গাড়ির যাত্রী হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হয় পথচারী হিসেবে। গবেষণা মতে, দুর্ঘটনায় যত শিশু মারা যায় তার শতকরা ৮০ ভাগই পথচারী হিসেবে, যাদের বয়স ৫ থেকে ১০ দশ বছরের মধ্যে। শিশু পথচারীদের প্রায় অর্ধেক মারা যায় রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এবং প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ রাস্তা পার হতে গিয়ে। ভারী যানবাহন বিশেষত বাস-ট্রাক প্রধানত দায়ী রাস্তায় শিশুদের হত্যা করার জন্যে। তবে বাইসাইক্লিস্ট হিসেবেও শিশুরা কিন্তু যথেষ্ট বিপন্ন; কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় যত সাইক্লিস্ট মারা যায় তার ১৬ ভাগ শিশু।
যে কোনো অপমৃত্যুই বেদনার। কিন্তু শিশুদের অপমৃত্যু যেন মেনে নেওয়া যায় না কোনোমতেই। শিশুরা জাতির ভবিষ্যত। আমাদের অবহেলার কারণে সেই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ অকালেই পতিত হবে মৃত্যুর অন্ধকারে, এর থেকে হৃদয়বিদারী আর কিছু হতে পারে না। মনে পড়ছে সেই মিরেশ্বরাই ট্রাজেডির কথা, যেখানে চালকের ভুলের কারণে প্রায় অর্ধশত নিষ্পাপ শিশুর প্রাণনাশ ঘটে। গোটা জাতি বেদনার্ত হয়ে উঠেছিল সে ঘটনায়।
গবেষকদের মতে, যে উপাদানগুলো সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে শিশুদের জড়িত করে ফেলে তার মধ্যে রয়েছে, চালক এবং শিশু উভয়েরই ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ; সড়কে শিশুদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে যে প্রকৌশল-পদ্ধতি তার অপ্রতুলতা ও অকার্যকারতা; অপর্যাপ্ত শিক্ষা আর অসন্তোষজনক আইন-প্রয়োগ কাঠামো। শিশুদের সড়ক নিরাপত্তার শিক্ষা দেওয়া হলে তা দীর্ঘমেয়াদে প্রতিরোধ করতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা, বাঁচিয়ে দিতে পারে অসংখ্য প্রাণ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শিশুদের জন্য সড়ক নিরাপত্তার শিক্ষা কী? এটি হচ্ছে এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি শিখন-পদ্ধতি যা সড়কে শিশুদের আচরণ পাল্টে দিয়ে তাদের দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস করতে পারে। এটা পুরোপুরি একটা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি, যা শিশুর বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে তাকে তৈরি করে দেয় একজন নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী হিসেবে। এটা একটা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি, যা শিশুর বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাকে তৈরি করে দেয় নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী হিসেবে।
১. সড়ক এবং যানবাহন সম্পর্কে তার জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে;
২. সড়কে যানবাহনের উপস্থিতিতে নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে;
৩. নিজেদের নিরাপদ রাখতে নিজেদের দায়িত্বশীল হতে হবে, সেই সত্য বোঝার মাধ্যমে;
৪. সড়ক দুর্ঘটনার কারণ এবং ফলাফল সম্পর্কে জ্ঞানবৃদ্ধির মাধ্যমে এবং
৫. নিজেদের নিরাপত্তা এবং এবং একই সঙ্গে অন্যদের নিরাপত্তার প্রতি দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির মাধ্যমে।
একটি অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংস্থা, গেøাবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপ (জিআরএসপি) রীতিমতো গবেষণা করে বের করেছে যে, একজন শিশু তার স্কুলজীবনের শুরু থেকে তার বয়স এবং উপলব্ধির ক্ষমতা অনুসারে ধাপে ধাপে কীভাবে সড়ক নিরাপত্তার পাঠ গ্রহণ করবে। এলোমেলো শিক্ষা তার জন্যে হিতে বিপরীত হতে পারে।
শূন্য থেকে চার বছর বয়সের শিশুরা নিজেদের দায়িত্ব নিতে পুরোপুরি অক্ষম। এই বয়সে তারা শুধু শিখবে যে, রাস্তায় বড়দের হাত ধরে রাখতে হবে। ফুটপাত অথবা রাস্তার কিনার ধরে হাঁটতে হবে। তাকে এটুকু বুঝতে হবে যে, রাস্তা তার জন্যে একটি বিপজ্জনক জায়গা, খেলাধুলার জায়গা নয়। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী শিশুরা সাধারণত নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। এই সময় তারা দেখে এবং শুনে যানবাহনের গতিবিধি নির্ণয়, রাস্তা পার হওয়ার জন্য কারও সাহায্য গ্রহণ করা, সুবিধাসম্পন্ন জায়গায় রাস্তা পার হওয়া, নিরাপদে স্কুলে যাওয়া-আসা, দুর্ঘটনার কারণে সে আহত বা নিহত হতে পারে ইত্যাদি বিষয় শিখবে। আট থেকে বার বছর বয়সী শিশুদের কাছ থেকে আশা করা হয় যে, তারা নিজেরাই সড়কে কিছু ঝুঁকি মোকাবেলা করবে। এই সময় তারা যা শিখবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ট্রাফিক বাতি, ট্রাফিক সংকেত, সড়ক চিহ্ন ইত্যাদি; যানবাহন পর্যবেক্ষণ করে তাদের গতিবেগের ভিন্নতা শনাক্তকরণ; বিরূপ আবহাওয়া, গাড়ির কন্ট্রোল এবং ব্রেকিং, দৃশ্যমানতা ইত্যাদি উপলব্ধি করা; এটা বোঝা যে, সড়কে সকল সড়ক ব্যবহারকারী সমানভাবে আইনকানুন মেনে চলে না; সড়কে শিশু, বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধীদের বিশেষ চাহিদার বিষয়ে ধারণা অর্জন; অন্য শিশুদের কাছে ভালো উদাহরণ তৈরি করা ইত্যাদি।
১২ থেকে ১৬ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ‘খুদে পূর্ণবয়স্ক’ হিসেবে দেখা হয়। তাই তাদের শিক্ষা-পদ্ধতি হবে ভিন্নতর। এ সময় তারা শিখবে গণপরিবহনে নিরাপদে চলাচলের পদ্ধতি; বাইসাইকেল চালনা, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুধাবন ও ঝুঁকি হ্রাসের উপায়; যানবাহনের গতি ও দূরত্ব বিবেচনা করা; মহাসড়কের আইনকানুন জানা এবং প্রাথমিক চিকিৎসায় করণীয়।
এই হচ্ছে সংক্ষেপে সড়ক নিরাপত্তা শিক্ষার সার্বিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে উপরের শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ সাজাতে হবে। আমাদের পাঠ্যবইগুলোতে সড়ক নিরাপত্তা শিক্ষার সার্বিক চিত্র কী? প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট পাঠগুলো বিশ্লেষণ করে সন্তোষজনক চিত্র মিলে না। বিভিন্ন শ্রেণিতে যে পাঠ যোজিত হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। জিআরএসপিএর নির্দেশনা অনুযায়ী এগুলে দেখা যে, প্রয়োজনীয় পাঠের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সংযোজিত হয়েছে মাত্র। তার মানে, সামনে অনেক পথচলা বাকি। বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভিন্ন বইয়ে সড়ক নিরাপত্তার পাঠ সংযোজনের প্রক্রিয়া চলছে, এ কথা সঠিক কিন্তু গতি অত্যন্ত শ্লথ। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিশুদের অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে এবং একটি দায়িত্বশীল ও সড়ক নিরাপত্তার প্রতি সংবেদনশীল জাতি গড়তে সড়ক নিরাপত্তা শিক্ষার বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন