শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নামই নেতৃত্ব

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিরোধ যখন তুঙ্গে ওঠে, ঠিক তখন নেতৃত্ব প্রকাশের সময়। মানুষের বিপদে যে সামনে এসে দাঁড়ায়, তাকেই মানুষ নেতার মর্যাদা দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সেই বিভীষিকাময় রাতে নিরীহ মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে নেতারা আত্মগোপন করেছিলেন, পক্ষান্তরে সেদিন জিয়াউর রহমান মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন; তার সাহসী অবস্থানের কারণেই একজন মেজর থেকে তিনি রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন, হয়েছেন কোটি কোটি মানুষের নেতা। তিনি জেল-জুলুম ও জীবনের পরোয়া করেননি। জেল রাজনীতির একটি অংশ, জেল নেতাদের আরেক আবাসন; যারা রাজনীতি করেন, মানুষের জন্য কাজ করেনÑতারা জেলকে ভয় করেন না। জেলকে ভয় করলে নেলসন ম্যান্ডেলা পৃথিবীর অবিসংবাদিত নেতা হতেন না। এই মহাপুরুষ প্রায় তিন দশক জেলে কাটিয়েছেন। জেল তার জন্য বয়ে এনেছে সৌভাগ্য, তিনি ইতিহাসে নিজের নামই শুধু লিখে জাননি; ইতিহাস সৃষ্টিতেও রেখে গেছেন সুস্পষ্ট অবদান। কাজেই জেলের ভয়ে রাজনীতিকরা পালিয়ে থাকতে পারেন না, তাহলে ইতিহাসে তারা রাজনীতিবিদ হিসেবে স্থান করে নিতে পারবেন না।
বাংলাদেশের মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে একদলীয় শাসক। কেড়ে নেয়া হয়েছে মানুষের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার। দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম ও অত্যাচার-নির্যাতনে তারা সৃষ্টি করেছে এক কলঙ্কজনক ইতিহাস। চলমান সময়ে বাংলাদেশের সবচে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধানকে তার বাসভবনে গৃহবন্দি করে, আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে অসুস্থতার কথা বলে সিএমএইচে ভর্তি করে ও অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে কথা বলে জেলে আটকে রেখে এবং সব পেশাজীবী সংগঠন, বিশিষ্ট নাগরিক ও জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনুরোধ উপেক্ষা করে ভোটবিহীন, প্রার্থীবিহীন এক হাস্যকর ও তামাশার নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে তারা। মানুষ অসহায়ের মতো চেয়ে দেখেছে এই তামাশার নির্বাচন আর ত্রেুাধে ফুসেছে তাদের পাশে কোনো নেতৃত্ব নেই, যারা মাঠে থেকে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা, তারা চলে গেছেন আত্মগোপনে, রাজনীতির মাঠ হয়ে পড়েছে কর্মীশূন্য। এ অবস্থায় শাসকগোষ্ঠী ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে আবার বসে গেছে ক্ষমতায়। বিরোধী দলের নির্লিপ্ততায় তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে।
জোর করে ক্ষমতায় থাকার ফল যে কারো জন্যেই ভালো হয় না, এই চির সত্যটি শাসকগোষ্ঠী মনে হয় ভুলে গেছে। তাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার পালাবদলে প্রাকৃতিক ইশারা কাজ করে। আজ যিনি ক্ষমতায়, আগামীকাল তিনি ক্ষমতায় নাও থাকতে পারেন। পৃথিবীতে বহু শাসক ঘুম থেকে জেগে দেখেন তিনি ক্ষমতাচ্যুত। তবে হাতগুটিয়ে বসে থাকলে হবে না, সত্য কথা বলতে হবে; অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।
সত্য কথা বলতে ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে যদি কোনো রাজনীতিবিদকে জেলে যেতে হয়, তাহলে সেই জেল অবশ্যই সৌভাগ্যের। পলায়নপর মন নিয়ে কোনো গণআন্দোলন হয় না বরং আন্দোলন আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়ে মাঠ ছেড়ে দেয়; বর্তমান পরিস্থিতিতেও আমরা তাই দেখছি, নেতাদের আত্মগোপনের কারণে একটি গণআন্দোলন নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো গণদাবি পরিত্যক্ত হয়েছে এমন নজির ইতিহাসে নেই। বিএনপির নির্বাচকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিরেট গণদাবি। রাজপথে জনগণ এই দাবি আদায় করেই ছাড়বে, জয় তাদেরই হবে; তারাই চূড়ান্ত হাসি হাসবে।
রাজনীতিতে সিদ্ধান্তহীনতা বলতে কোনো বিষয় নেই। রাজনীতিবিদরা কোনো সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন না। কেননা রাজনীতিতে সিদ্ধান্তহীনতার পরিণাম কোনদিন ভালো হয় না। রাজনীতিতে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, রাজনীতিবিদদের চরম মূল্য দিতে হয়। কোন কাজটি এ মুহূর্তে করতে হবে, কোনটির জন্য করতে হবে অপেক্ষা, রাজনীতিতে এটি নির্ধারণ করা জরুরি। বিরোধ যখন তুঙ্গে উঠে, তখনই নেতৃত্ব প্রকাশের সময়। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিতে পারেন, তারাই নেতৃত্বের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; ইতিহাস তাদের গলায় নেতৃত্বের মালা পরায়।
একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে দেশের চলমান রাজনীতি। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে পাইকারিহারে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমনে সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করার নগ্ন কৌশল দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছেÑএতে কোনো সন্দেহ নেই। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার দমন-পীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ দুর্বল করতে চাচ্ছে; যাতে বিরোধী দল কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে।
কথায় বলে, নিজের সম্মান বা মর্যাদা না থাকলে অন্যকেও সম্মানিত করা যায় না; অবিসংবাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে চাচ্ছে শাসকগোষ্ঠী। সরকারের ইজ্জত-সম্মানবোধ থাকলে, এহেন ন্যাক্কারজনক আচরণ প্রতিপক্ষ শীর্ষ রাজনীতিকের ওপর করার আগে তাদের শতবার চিন্তা করতে হবে। নয়তো আত্মসম্মানবোধহীন এক দুর্বল শাসকের প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠবে তাদের আচরণে!
শাসকগোষ্ঠী আন্দোলন দমাতে চূড়ান্ত কৌশল হিসেবে ন্যাক্কারজনক পথের আশ্রয় নেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে তাদের একটা যুক্তি আছে, মানুষ শেষ রক্ষার জন্য অনেক কিছুই করে। কিন্তু বিরোধী দলের মামলাকে ভয় পাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। কেননা দেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট তাদের পক্ষে। আন্দোলনের গতিকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া জনগণের অধিকার আদায় হবে না।
আওয়ামী লীগ সময়-সুযোগ বুঝে রাজনীতিতে অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা অব্যহত রেখেছে। একটার পর একটা ইস্যু তারা তৈরি করে রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। তাতে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তারা উপকৃত হয়। যুদ্ধাপরাধের ইস্যুকে তারা জিইয়ে রেখেছে বিরোধী দলকে ঘায়েল করতে। তারা যথা সময়ে এটা ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলে নিচ্ছে।
দেশে বেপরোয়া বন্দুকের ব্যবহার চলছে। ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার উৎস হিসেবে বন্দুককে বেছে নেয়া হয়েছে। কিন্তু বন্দুকের নল ক্ষমতার একমাত্র উৎস নয়, ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ; জনগণের ওপর গুলি ও দমন-পীড়ন চালিয়ে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। অপেশাদারিত্ব ও দল বাজির এক ভয়াল চেহারা ফুটে উঠেছে পুলিশের বিতর্কিত ও ন্যাক্কারজনক আচরণেও। পুলিশের এমন বেপরোয়া আচরণ অতীতে লক্ষ করা যায়নি। আসলে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে, এর পেশাদারিত্ব ও ঐতিহ্য নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে হলে দলটিকে রাজনৈতিক চাপে না ফেলে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চুল পরিমাণ ছাড়ও শাসকদল বিএনপিকে দিচ্ছে না। উল্টো হামলা-মামলা, গুম-গ্রেফতার করে এবং বিভিন্ন নন ইস্যুকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে সারাক্ষণ বিএনপিকে ভয়ানক তটস্ত ও প্রচ- চাপের মধ্যে রেখেছে শাসকদল। বিএনপির নেতা-কর্মীরা পালিয়েও বাঁচতে পারছেন না! বাঁচতে পারছেন না জোটের অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীরাও।
একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে তারা শুধু জনগণ থেকেই নয়, গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। একতরফা নির্বাচন তাদের করুণ পরিণতি ডেকে আনবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীব্যাপী পত্র-পত্রিকাগুলোয় বাংলাদেশের একতরফা নির্বাচনের কুফল নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। ফলে সরকার উভয় দিক দিয়ে এক মারাত্মক চাপে পড়তে যাচ্ছে। রাজপথে বিরোধী দলের শক্ত অবস্থান বজায় থাকলে, সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হবেÑএটা বিবেচনায় রেখেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারী পক্ষের নেতৃত্বকে।
লখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
babul ১১ মার্চ, ২০১৬, ১২:১৮ এএম says : 0
excellent write up
Total Reply(0)
mamal hossain ১১ মার্চ, ২০১৬, ১২:১৯ এএম says : 0
good write up
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন