দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি শিকার হয়েছে হ্যাকিংয়ের। আর তাতে চলে গেছে রিজার্ভের ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার (৮শ’কোটি টাকা) সমপরিমাণ অর্থ। ৭ মার্চ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। বিস্মিত হওয়ার মতই খবর। বিষয়টি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তবে ইদানীং ব্যাংক সেক্টরে এ জাতীয় ঘটনা ঘটছেই। কিছু দিন আগে বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে গ্রাহকদের অর্থ উধাও হয়ে গেছে। দেশি-বিদেশি একটি চক্র জালিয়াতি করে গ্রাহকদের একাউন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেয়। ব্যাংকের ভল্টে চুরি, এটিএম বুথের টাকা লুট, ব্যাংকের দেয়াল কেটে অর্থ লুট, সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। এসব ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ব্যাংকের কাছে জনগণের গচ্ছিত অর্থের নিরাপত্তা কতটা অনিশ্চিত। আশার কথা, বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক হওয়া অর্থের একাংশ উদ্ধার হয়েছে। এর আগে এটিএম বুথের জালিয়াত চক্রক্রের সদস্যদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গ্রেফতার করেছে। চুরির ঘটনা জানাজানির অল্প সময়ের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অর্থ উদ্ধার এবং চোরকে আটক করে গ্রাহকদের আস্থার পাশাপাশি দেশবাসীরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ ঘটনায় প্রমাণ হলো অপরাধীর হাত যতই লম্বা হোক না কেন আইনের হাত তার চেয়েও লম্বা।
ফিলিপাইনের দৈনিক দ্য ইনকোয়েরার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ থেকে ১০ কোটি ডলার মানি লন্ডারিং হয়েছে। চীনা হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা সেখানকার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এতে আরও জানানো হয়েছিল, দেশটির মাকাতি শহরে অবস্থিত রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের একটি শাখার মাধ্যমে ওই অর্থ ফিলিপাইনে নেয়া হয়। অর্থ পাচারের এই ঘটনা তদন্ত করছে ফিলিপাইনের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল। রিজার্ভের অর্থ কোন দেশে, কোথায় বিনিয়োগ বা সংরক্ষণ করা আছে তা সুইফট কোডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী সুরক্ষিত হিসেবে বিবেচিত এ নেটওয়ার্ক হ্যাক করে রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইনে রয়েছে বলে ধারণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ফিলিপাইন সরকার তাদের অর্থ বাজারে ৮শ’ কোটি টাকা বেশি পায়। অর্থের উৎস খুঁজতে গিয়ে জানতে পারে এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে হ্যাকাররা এ অর্থ বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেয়। পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থের উৎস ও কীভাবে সরানো হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে। এরই মধ্যে দুইজন ব্যাংকারকে পাঠানো হয়েছে ফিলিপাইনে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন তারা। কোন পদ্ধতিতে টাকা সরানো হয়েছে তা নিয়ে চলছে অনুসন্ধান। টাকা কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। সূত্র মতে, চুরি হওয়া অর্থ ফেরত পেতে ইতোমধ্যে জোর তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নানা ফিকিরে ব্যাংকের অর্থ লুটের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে গেছে। হ্যাকিং করে, সরাসরি লুট করে, কখনোবা অস্ত্র দেখিয়ে, কোনো সময় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে, কখনোবা ছাদ ফুটো করে ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। সংঘবদ্ধ চক্র ব্যাংকের আর্থিক চুরি-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তা অবিষ্কার করার উপায় নেই। এও সত্য যে, ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এসব ঘটনার তদন্তে অগ্রগতিই হয় না, বিচারে বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রায়শই। সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এ জাতীয় অপরাধ রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাতের নিরাপত্তা জোরদারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, ঠিক একইভাবে দায়িত্ব রয়েছে সরকারেরও। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে ব্যাংকের শাখা স্থাপন ও ভল্ট নির্মাণ-রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় ব্যাংককে। ব্যাংকগুলো সেসব ঠিকমতো পালন করছে কিনা, তাও তদারক করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য শুধু প্রশাসনের ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয়। এজন্য নিজস্ব তদারকি প্রয়োজন। স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে সাইবার নিরাপত্তা জোরদারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর নিজস্বকর্মী, বিশেষত নিরাপত্তা রক্ষাকারী কর্মীদের ভেতর কেউ বুথ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।
একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনায় ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। মানুষের মাঝে আতংক তৈরি হয়েছে। গ্রাহকের একাউন্টের টাকা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে উধাও হয়ে যাওয়া এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাউন্টের টাকা গায়েব হওয়া দুশ্চিন্তারই কারণ। অধিকতর নিরাপত্তার আশায় মানুষ ঘরে টাকা না রেখে ব্যাংকে রাখেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষও গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে তার জন্য মাশুল নিচ্ছে। নিরাপত্তাই হলো ব্যাংকের সর্বাপেক্ষা বড়ো মূলধন। নিরাপত্তা না থাকলে মানুষ কখনোই ব্যাংকের দ্বারস্থ হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট হ্যাক করে অর্থ লুট, এটিএম বুথ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লুট, গাজিপুরে এটিএম বুথের অর্থ লুট, কিশোরগঞ্জে স্থানীয় সোনালী ব্যাংকের জেলা প্রধান শাখার ভল্ট হইতে চুরিসহ একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা ও ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। এসব ঘটনায় ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভীতি, আতঙ্ক বা আস্থাহীনতা যাই বলি না কেন এটা কিন্তু গোটা দেশের ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে যে বিরাজমান তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এটিএম বুথ জালিয়াতির ঘটনা। কয়েক মাস ধরেই জালিয়াতির ঘটনাগুলো আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। এটিএম বুথে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয় বড় হয়ে উঠেছে। ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেক গ্রাহক এটিএম কার্ড বাতিল করতে ব্যাংকের কাছে আবেদন করছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক মিলে ৯০ লাখের বেশি ব্যাংক কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৫ লাখ ডেভিট আর ৫ লাখ ক্রেডিট কার্ড। দেশে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ৭ হাজার এটিএম বুথ রয়েছে। এ বাস্তবতায় যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায় অথবা নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয় তাহলে সেটা হবে দুঃখজনক। চেকের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ঝামেলা এড়াতে এবং সময় বাঁচাতে এটিএম বুথ গ্রাহকদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়াও আবাসিক এলাকার কাছাকাছি, এমনকি অনেক গ্রামাঞ্চলে মানুষের একেবারে হাতের নাগালেই কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথ স্থাপন হওয়ায় অর্থ উত্তোলনে খুবই সুবিধা হয়েছে। অথচ সাম্প্রতিককালে অনেক বুথে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে গ্রাহকদের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। শুধু গ্রাহক নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও দুর্বৃত্তের দুষ্কর্মের শিকার হয়েছে। এটিএম বুথে টাকা লোড করার সময় লুটেরারা আক্রমণ চালিয়ে টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গত কারণেই ব্যাংকগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এর যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এটা লক্ষণীয় যে, সম্প্রতি সময়ে ব্যাংকে নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থার নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগজনক। আমরা মনে করি, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি নিরসন করার কোনো বিকল্প নেই।
ব্যাংকগুলোর কাজ হলো দেশের মানুষের অর্থ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দেয়া। আর সে ভরসায়ই মানুষ ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখে। যে কোন মাধ্যমেই হোক না কেন, গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থ খোয়া গেলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওপরই গিয়ে বর্তায়। এটা স্পষ্ট যে, বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবায় গ্রাহকের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। জালিয়াত চক্র যেভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তাতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। দেশের ব্যাংকগুলোয় অর্থের নিরাপত্তা বিষয়ক নির্দিষ্ট গাইডলাইন দ্রুত প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে উদ্যোগী হতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। তাতে করে এ জাতীয় অপরাধ কমে আসতে বাধ্য। সর্বোপরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী যদি সার্বিক পর্যালোচনাপূর্বক সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাহলে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করাও সম্ভব। দেশের ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোচ্চ কঠোর হোকÑআমরা সেটাই প্রত্যাশা করি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
newsstore13@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন