মর্জিনা আফসার রোজী
প্রকৃতি ও প্রাণী একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শতাব্দীর অবক্ষয়ে আজ যেমন প্রকৃতি হারাচ্ছে তার মাধুর্য, ঠিক তেমনি মানুষের অন্তর থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে মহত্ত্ব আর মনুষত্ব। শুধুই ক্ষয়, পাপ আর ধ্বংস লীলায় মেতে উঠেছে বিশ্বভ্রমা-। মার্চ মাসের ৮ তারিখ এমন একটি দিবস, যেদিন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও নারী কল্যাণের কথা ভাবেন। কিন্তু কী প্রাপ্তি সে ভাবনায়, ক্রমশতো নারীর ওপর সহিংসতা বেড়েই চলেছে। সমৃদ্ধি ও পশ্চাৎপদতা সমান্তরালভাবে এগুচ্ছে। মানুষের অন্তর যদি মানবীয় গুণ শূন্য হয় তবে কোনো কল্যাণই সেখান থেকে আর বিস্তৃত হয় না।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ‘সূচ’ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম, কম মজুরি আর তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন ও খাদ্যের অভাবের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। ১৮৬০ সালে প্রতিবাদী নারী শ্রমিকরা নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। কালজয়ী উদ্যমী সংগ্রামে স্বীকৃত নারী শ্রমিকদের সেই তীব্র আকাক্সক্ষা। তারই ধারাবাহিকতার পরিণত ফসল হিসেবে ১৯১০ সালে ডেন মার্কের কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক নারীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব রাখেন জার্মান কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেৎ কিন। সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ এ দিনটিকে বহু প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হলো, আজ অবধি নারীরা তাদের প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেনি। বরঞ্চ নারীর প্রতি নির্মম বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে কখনো কখনো মনে হয়, আমরা বোধ হয় আদিমযুগের দিকেই ধাবিত হচ্ছি। নারী শ্রমিকেরা আজও সমপরিমাণের পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয়েই রয়েছেন। নারী-পুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। উল্টো দিকে বহমান ¯্রােতের গতি কেউ রুখতে পারে না। তবে সেক্ষেত্রে নিজের সবটুকু মেধা, বুদ্ধি আর আত্মবিশ্বাসকে প্রয়োগ করে অস্তিত্বকে দৃঢ়তার সাথে ধরে রাখতে হবে। হাত ধরে কেউ উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির সিঁড়ি দেখিয়ে দেবে না, সে পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। সমগ্র বাধা-বিঘœ পেরিয়ে স্থির মননে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে এগুতে হবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে নারীদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিজেকে স্বাবলম্বী হতে হবে। নিজেদের অসহায়, দুর্বল কিংবা সোভা বর্ধনকারী ভাবনা পরিত্যাগ করতে হবে। কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন দিবে না অধিকার। হে বিধাতা।’
রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বের শীর্ষে পুরুষের সমান সংখ্যায় আসতে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। এ কথা বলেছেন, বিশ্বের তিন প্রভাবশালী নারী হিলারি ক্লিনটন, মিলিন্ডা গেটস ও চেলছি ক্লিনটন। নারীর অধিকারই মানবাধিকার, মানবাধিকারই নারীর অধিকার সব সময়। বেইজিং সম্মেলনের ২১ বছর পর নারীরা বিশেষত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ‘এখনো সংখ্যালঘু’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইনসভায় নারীদের উপস্থিতির হার খুবই কম। দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে নারী মন্ত্রী আছেন মাত্র ৫ শতাংশ। তারা আছেন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো নির্দিষ্ট কিছু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। প্রতিরক্ষা কিংবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে তারা নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নারীদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। যেমন : স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি ইত্যাদি। সর্বোপরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্পিকার বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীরাই দায়িত্বে আছেন। বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৪টি দেশে নারীরা অর্থ বা আর্থিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে এমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘বিশ্বের ৫টি দেশের আইন সভায় সব সদস্য পুরুষ। ৮ দেশের মন্ত্রিসভায় নারীদের কেউ ঠাঁই পাননি। নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমিকা জোরদার করতে হবে।’
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে শীর্ষ নির্বাহীদের তালিকা ‘ফরচুন ৫০০-’তে ১৯৯৫ সালে একজনও নারী ছিলেন না। তবে এই তালিকায় ৫ শতাংশ নারী এখন প্রতিষ্ঠিত। পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে, নারীরা ক্রমশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করছেন। পর্তুগালে শীর্ষ রাজনৈতিক পদে নারীরা আছেন ৮ শতাংশ পদে, আর নরওয়েতে ৩৬ শতাংশ পদে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্ব কম হলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে এটা প্রমাণিত হয়েছে।
মানুষের হৃদয়ে তেমন মনুষত্ব আর মাধুর্য কোনকালেই ছিল না। এমনটি প্রত্যাশা করা দুর্বলের লক্ষণ যে সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, সুযোগ-সুবিধা কেউ ঝাপি ভরে এনে ঘরে তুলে দিয়ে যাবে। সুতরাং এ বৈরী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের সাথে সাথে নিজেকেও পরিশ্রমী আর চৌকস হতে হবে। দুর্বলের উপর সবলের, নারীদের উপর পুরুষের আবার শিশুদের ওপর অমানুষদের অত্যাচার মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আজ নারীদের সরব পদচারণায় বিশ্বের অধিকাংশ অঙ্গনই মুখরিত। কিন্তু আশানুরূপ বিস্তার ঘটেনি। তবে এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো অনেক দেশেই নারী নেতৃত্বের জাগরণ ও অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তথাপি হ্রাস পায়নি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, দমন-পীড়ন ও পাচারের মতো জঘন্য কার্যকলাপ।
সারাদেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এক পরিসংখ্যানে প্রতীয়মান হয় যে, গত বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ৬ মাস ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩০৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী। ধর্ষণের পর ৪৫ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৯০ জন নারী। আর নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ৮০ জন নারী। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের এ চিত্রটি আরো ভয়াবহ। সেখানে প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হয় ৯২ জন নারী। এনসিআরবি’র রিপোর্টে বলা হয়, ২০১২ সালের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ২০১৩ সালে, এভাবে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি বছরে তা তীব্রতার মাত্রাকেও অতিক্রম করেছে। ৫ মাসের শিশু কন্যা থেকে ৬০ বছরের নারীরও ইজ্জত লুট করা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মধ্যপ্রদেশে, চার হাজার ৩৩৫টি। এরপর আছে যথাক্রমে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশ। এই রাজ্যগুলোতে ধর্ষিত হয়েছে যথাক্রমে ৩২৮৫, ৩০৬৩ এবং ৩০৫০ জন। রাজধানী দিল্লিতে দিনে ৬ নারী ধর্ষিত ও ১৪ জন নির্যাতনের শিকার হয়। সে কারণে দিল্লীকে ধর্ষণের রাজধানী বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৫ নারীর মধ্যে ১ জন তাদের জীবনে অন্তত ১ বার ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে, কখনো সখনো নিজ পরিবার থেকে তাদের বাইরে আরো ৪০ শতাংশ নারী অন্য কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ধর্ম ও রীতি-নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করাই শ্রেয়। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে, ‘নারীগণ তোমাদের পুরুষগণের জন্য বসনস্বরূপ এবং তোমরা পুরুষগণ নারীদের জন্য বসনস্বরূপ।’ হাদিস শরিফে বর্ণিত, ‘নারী পুরুষের জননী, ভগিনী ও অর্ধাঙ্গিনী। সে বিপদে বন্ধু, সম্পদে সুখ, গৃহে শান্তিরক্ষাকর্ত্রী’।
বাংলাদেশের মেয়েরাও আজ ন্যায্য প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে। ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর ইডেন কলেজের মেয়ে ফারজানা বিয়ের অনুষ্ঠানেই স্বামীকে তালাক দিয়েছে, যৌতুক চাওয়ার কারণে। সেদিনের ‘সূচ’ কারখানার শ্রমিকদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। রক্ষণশীল সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ ২০১৩ সাল থেকে উপদেষ্টা পরিষদ বা সুরা কাউন্সিলে ৩০ জন নারীকে নিয়োগ দিয়েছেন। এর পূর্বে সুরা কাউন্সিলের সকল সদস্যই পুরুষ ছিল।
তবে অবক্ষয়ের মূল কারণ চিহ্নিত করা গেলে সফলতা ত্বরান্বিত হতো। অতি আধুনিকতা ও আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে প্রতিনিয়ত প্রচার মাধ্যমগুলো নেতিবাচক অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। আর মানুষের কৌতূহলী মন সর্বদাই নিষিদ্ধ কাজে আকৃষ্ট হয়। সেকারণেই সকল ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা আর সততার চর্চা করে এর বিস্তার রোধে উদ্যোগ নেয়া উচিত।
লেখক : সংগঠক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন