বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ইসলামী ইবাদতের চতুর্থ রোকন : হজ

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী | প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হজ্জের আদবসমূহ: হজ্জের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি যে, ইহরাম বাঁধা হতে শুরু করে ইহরাম খোলা পর্যন্ত প্রত্যেক হাজী সততা, পবিত্রতা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে থাকা। তারা লড়াই-ঝগড়া এবং দাঙ্গা, ফাসাদ করবে না। কাউকে কষ্ট দেবে না। এমনকি একটি ক্ষুদ্র পীপিলিকা পর্যন্ত মারবে না। শিকার করা তাদের জন্য জায়েয নয়। কেননা তারা তখন সার্বিকভাবে শান্তি, আপোষ মীমাংসা, বন্ধুত্ব এবং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে থাকবে। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “নির্দিষ্ট দিনগুলোর মাঝে যে হজ্জ করবে, তবে সে যেন স্ত্রীসম্ভোগ, গোনাহের কাজ এবং ঝগড়া-ফাসাদ না করে এবং তোমরা যে সকল উত্তম কাজ করবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ পাক অবশ্যই পরিজ্ঞাত।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৫) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে : “তোমরা ইহরামের অবস্থায় শিকার করাকে হালাল মনে করো না। (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১)
অনুরূপভাবে যারা হজ্জের নিয়তে ঘর হতে বের হবে, তাদেরকে রাস্তায় কষ্ট দেয়া, তাদের মাল-সামান লুট করা, অথবা চুরি করা নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহর গৃহের সন্নিকটে এ সকল কর্মকাÐ অবশ্যই আদবের খেলাপ। যেন আরবের মত নিরাপত্তাহীন দেশে এ সকল ডাকাত, লুটেরা ও বদমায়েশদের কারণে হাজীদের কাফেলাগুলোর আসা-যাওয়ার মাঝে কোন প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি না হয়। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং তোমরা এই মর্যাদাপূর্ণ গৃহের জিয়ারত প্রত্যাশাকারীদের যারা আল্লাহর রেজামন্দি ও খোশনুদী কামনা করে, তাদেরকে তোমরা হালাল মনে করো না। ” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১)
যদি কোনও হাজীর নিকট হতে কোনও পশু হত্যাকর্ম স্বেচ্ছাকৃতভাবে ঘটে যায়, তাহলে এর জন্য তাকে রক্ত বদলা কুরবানী করতে হবে। এর নাম হচ্ছে কাফ্ফারাহ। অর্থাৎ তাকে নিহত পশুর সমপরিমাণ কোনও হালাল জানোয়ার কুরবানী করতে হবে, কিংবা কয়েকজন দরিদ্রকে আহার করাবে, কিংবা সমপরিমাণ রোজা রাখবে। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “হে বিশ্বাসিগণ! যখন তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকবে, তখন শিকার করো না, তোমাদের মাঝে যে স্বেচ্ছয় হত্যা করবে, তাহলে তাকে এর বদলে হালাল গৃহপালিত পশু কুরবানী করতে হবে। এর ফায়সালা তোমাদের মাঝে দু’জন ন্যায়বান লোক সম্পন্ন করবে, যেন এই পশু কা’বা পর্যন্ত পৌছায়ে কুরবানী করা হয়; কিংবা এই গোনাহের বদলাস্বরূপ মিসকীনকে আহার দান করবে; কিংবা সমপরিমাণ রোজা রাখবে। যেন সেই অপরাধী স্বীয় অপরাধে শাস্তি ভোগ করতে পারে। (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১২) এই আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, হজ্জ হচ্ছে সার্বিকভাবে সোলেহ, মালামতি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক। এই উদ্দেশ্যের বিপরীত হাজীদের নিকট হতে যা কিছু কর্মকাÐই প্রকাশ পাবে, এর কাফফারা আদায় করা তার উপর অপরিহার্য।
হজ্জের মুসলিহাত ও হেকমত:
রাসূলুল্লাহ (সা:) শরীয়তের যে পরিপূর্ণতা নিয়ে আগমন করেছেন, এর সবচেয়ে বৃহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, “এতে দীন ও দুনিয়ার সমষ্টিগত কল্যাণ” নিহিত আছে। এই শরীয়তের সর্বত্র হেকমত এবং মুসলিহাতের প্র¯্রবণ প্রবাহিত। এই শরীয়ত স্বীয় আহকাম ও ইবাদতের উপকারীতা লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নির্ণয়ে বাইরের কোন বস্তুু বা মাধ্যমের প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। বরং এই শরীয়ত এ সকল বিষয়াদির গোপন রহস্যসমূহের মুখমÐল হতে যাবতীয় অবগুণ্ঠন অপসারিত করেছে। নামাজ, যাকাত, রোজার মত হজ্জের উদ্দেশ্যাবলী এবং উপকারীতাও স্বয়ং ইসলামী বিধানে সম্পৃক্ত হয়েছে।
কুরআনুল কারীমে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর যবানীতে খানায়ে কা’বার নির্মাণ ইসমাঈল (আ:)-এর মানত এবং মক্কায় তাঁর অবস্থান সংক্রান্ত যে সকল দোয়া ও মুনাজাত সন্নিবেশিত আছে, সেগুলোর মাঝে সর্বিকভাবে হজ্জের উপকারীতা ও উদ্দেশ্যাবলী বিধৃত আছে। এ সকল আয়াতের প্রতি একবার নজর দেয়া দরকার। ইরশাদ হচ্ছে : (ক) “এবং যখন আমি এই গৃহকে (কা’বা) মানুষের কেন্দ্রস্থল, প্রত্যাবর্তনস্থল ও শান্তির নিবাস করলাম এবং বললাম যে, মাকামে ইব্রাহীমকে (আ:) নামাজের স্থান বানাও এবং আমি ইব্রাহীম (আ:) ও ইসমাঈলকে (আ:) এই জিম্মাদারী প্রদান করলাম যে, তোমরা উভয়ে আমার গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, ই’তিকাফকারীদের জন্য, রুকুকারীদের জন্য এবং সিজদাহকারীদের জন্য পাক-সাফ রাখবে। এবং যখন ইব্রাহীম (আ:) প্রার্থনা করলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার স্থল করে দিন এবং এখানকার বাসিন্দাদেরকে ফলও ফসল দ্বারা জীবিকা দান করুন।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫) (খ) “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করে দিন, এবং আমাদের সন্তান-সন্ততিদের থেকে আপনার একদল অনুগত বান্দাহ তৈরী করুন, আমাদেরকে আমাদের হজ্জের তরীকা বলে দিন, এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, অবশ্যই আপনি তওবাহ কবুলকারী ও মেহেরবান। হে আল্লাহ! তাদের মাঝে তাদের মধ্য হতেই একজন রাসূল প্রেরণ করুন?” (সূরা বাকারাহ: রুকু-১৫) (গ) “এবং যখন আমি ইব্রাহীম (আ:)-কে গৃহের স্থানকে ঠিকানা বানিয়ে দিলাম (এবং বলে দিলাম) যে, আমার সাথে কোন কিছুর শরীক স্থাপন করো না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্য, ইতিকাফকারীদের জন্য, রুকু ও সেজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখ এবং মানুষের সামনে হজ্জের ঘোষণা জারী কর। তারা তোমার কাছে পদব্রজে এবং দুর্বল উটের উপর আরোহণ করে দূর-দূরান্ত হতে আগমন করবে, যেন তারা উপকৃত হওয়ার স্থানে এসে হাজির হয় এবং নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করে, কেননা আমিই তাদেরকে পশু সম্পদ হতে রিজিক দান করেছি”। (সূরা হজ্জ রুকু-৪) (ঘ) “এবং যখন ইব্রাহীম (আ:) দোয়া করলেন, হে আমার প্রতিপালক! এই শহরকে নিরাপত্তার স্থান বানিয়ে দিন, এবং আমাকে এবং আমার সন্তান-সন্তুতিকে মূর্তিপূজার অভিশাপ হতে বাঁচান। হে আমার পরওয়ারদিগার! এই মূর্তিগুলো বহু লোককে গোমরাহ করে দিয়েছে। সুতরাং যে আমার কথা মান্য করেছে, সে আমার দলভুক্ত এবং যে আমার নাফরমানী করেছে তার প্রতি অনুকম্পা ও ক্ষমা প্রদর্শনকারী একমাত্র আপনিই; হে আমার প্রতিপালক! অবশ্যই আমি আমার সন্তান-সন্তুতিকে এমন একটি ময়দানে, আপনার গৃহের পাশে বসতি স্থাপন করিয়েছি যেখানে ফল ও ফসল উৎপাদিত হয় না; হে আমাদের প্রতিপালক! যেন তারা সালাত কায়েম করতে পারে; সুতরাং আপনি মানুষের একটি শ্রেণীকে তাদের প্রতি সদয় করে দিন এবং তাদেরকে ফল ও ফসল দ্বারা রিজিক দান করুন, যেন তারা শোকরগুজার হতে পারে।” (সূরা ইব্রাহীম : রুকু-৬)
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের সারমর্ম নি¤œলিখিত পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা যায়। ১। খানায়ে কা’বা তাওহীদপন্থীদের প্রাণকেন্দ্র, প্রত্যাবর্তন স্থল এবং মিল্লাতে ইব্রাহীমীর বাসস্থান ও নিবাস। ২। হযরত ইব্রাহীম (আ:) সর্বপ্রথম স্বীয় সন্তান-সন্ততিদের এখানে এজন্য বসতি স্থাপন করিয়েছিলেন যেন এই পবিত্র গৃহের খেদমতগুজারী ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত তারা সুচারুরূপে করতে পারে এবং মূর্তিপূজারী সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে জীবন-যাপন করতে পারে। যাতে করে অতীত যুগের মত এই গৃহটি অনাবাদী ও নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়। এমনকি তাদের মধ্যে হতে যেন কাঙ্খিত রাসূল আগমন করতে পারেন। ৩। এই লোকজন জনমানবহীন বিরান স্থানে এজন্য বসতি স্থাপন করে, যাতে করে এই গৃহটি আবাদ করতে পারে এবং ফল ও ফসলহীন এই ভূমির অধিবাসীদের আহার সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে এবং মানুষের মনকে এর প্রতি আকর্ষিত করতে পারে। যাতে করে তারা এই স্থানকে ভালোবাসতে সক্ষম হয়। ৪। তাদের প্রতি এই হুকুম করা হয়েছিল যে, মানুষের মাঝে হজ্জের সাধারণ ঘোষণা প্রচার কর। নিকট ও দূরের অধিবাসীরা অবশ্যই এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাবে। যেন তারা এখানে এসে দীন ও দুনিয়ার ফায়দা হাসিল করতে পারে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর জিকির বুলন্দ করতে পারে। ৫। যে সকল লোক এখানে হজ্জের নিয়তে আগমন করবে, তারা এই ফরিয়াদ করবে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করুন। কেননা আপনিই ক্ষমাশীল মেহেরবান। ৬। হে আল্লাহ! আমার আওলাদ-ফরজন্দের মাঝে যারা যারা আমার আদর্শ, মাজহাব এবং আমার পথ অনুসরণ করবে, তারাই মিল্লাতে ইব্রাহীমীর পাবন্দ, তারাই আলে ইব্রাহীম নামে পরিচিত এবং তারাই ইব্রাহীম (আ:)-এর দোয়া ও বরকতের প্রকৃত হকদার।
মোট কথা, হজ্জের এ সকল উপকারিতা ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এর প্রত্যেকটির অভ্যন্তরেই রয়েছে অসংখ্য উদ্দেশ্য ও উপকারিতার ফল্গুধারা।
হজ্জের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য:
এই পৃথিবীতে খানায়ে কা’বা হচ্ছে আরশের ছায়া এবং এর রহমত ও বরকতের প্রত্যক্ষ রূপরেখা। এটা হচ্ছে স্বচ্ছ একটি আয়না। যার মাঝে এর রহমত ও অনুকম্পার গুণাবলী নিজের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত করে গোটা বিশ্বের প্রতিটি অনু-পরমাণুকে সমুজ্জ্বল করে তোলে। এটা এমনই এক ঝর্ণা বা উৎস, যেখান থেকে সত্যের প্র¯্রবণ উৎসারিত হয়েছে এবং তা সারা পৃথিবীকে প্লাবিত করেছে। এটা হচ্ছে রূহানী জ্ঞান ও মা’রিফাতের এমন উদয়স্থল, যার কিরণসমূহ পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণাকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছে। এটা এমন একটি ভৌগোলিক সেতুবন্ধন, যার মাঝে মিল্লাতের এমন সব ব্যক্তিত্ব সম্পৃক্ত রয়েছে, যারা বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন ভূখÐে বসবাস করে। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে। বিভিন্ন ভূখÐে বসবাস করে। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে। বিভিন্ন সভ্যতার মাঝে জীবন অতিবাহিত করে।
কিন্তুু তারা সকলেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলী এবং সহজাত পৃথক স্বভাবের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও একই খানায়ে কা’বার চতুদিকে প্রদক্ষিণ করে এবং একই কিবলাকে নিজেদের কেন্দ্র হিসেবে মনে করে এবং একই স্থানকে ‘উম্মুল কুরা’ মনে করে এবং আঞ্চলিকতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপ এবং অন্যান্য বিভেদ সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যাবলীকে মিটিয়ে দিয়ে একই দেশ, একই জাতি, একই সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একই স্থানকে ‘উম্মুল্্ কুরা’ মনে করে এবং আঞ্চলিকতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপ এবং অন্যান্য বিভেদ সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যাবলীকে মিটিয়ে দিয়ে একই দেশ, একই জাতি, একই সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একই ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এটা এমনই এক ভ্রাতৃত্ব যার মাঝে দুনিয়ার সকল জাতি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী ব্যক্তি, পৃথক পরিবেশে প্রতিপালিত সত্তা একই মুহূর্তে এবং একই সময়ে প্রবেশ করে। যার ফলে মানুষের বানানো যাবতীয় প্রতিবদ্ধক, শৃঙ্খল টুটে যায় এবং অল্প দিনের জন্য হজ্জ্বের সময়ে সকল জাতি একই দেশে, একই পোশাকে, একই ইহরামের ধারক ও বাহক হয়ে সম্মিলিতভাবে একই গৃহের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং একই ভাষায় আল্লাহর সাথে কথা বলে।
এটাই হলো একতার ঐ রং, যা এ সকল বস্তুভিত্তিক বিভেদকে মিটিয়ে দেয়, যা মানুষের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ফেতনা-ফাসাদের মূল কারণ। এজন্য এই হেরেমে রাব্বানী শুধু কেবল শান্তি ও নিরাপত্তার ঘরই নয়, বরং এখানে সকল প্রকার রক্তপাত, জুলুম, নির্যাতন, সর্বোতভাবে নিষিদ্ধ। আর একদিকে তা নিরাপত্তার ঘর। কেননা তা দুনিয়ার সকল মুসলিম মিল্লাতকে একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে, বাহ্যিক বিভেদের যাবতীয় মাজহাবী উপাদানকে মিটিয়ে দেয়।
মানুষ আজ এই স্বপ্ন দেখছে যে, জাতীয়তা ও আঞ্চলিকতার বেষ্টনী হতে বের হয়ে, তারা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বিস্তৃত পরিমÐলে প্রবেশ করুক। কিন্তু মিল্লাতে ইব্রাহীমীর প্রাথমিক দাওয়াত এবং মিল্লাতে মুহাম্মাদী (সা:)-এর সংস্কারমূলক নতুন দিক-নির্দেশনা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এই স্বরূপ কয়েক হাজার বছর পূর্বে এই স্বপ্নকে দেখিয়ে ছিলেন এবং দুনিয়ার সামনে এর বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিলেন।
মানুষ আজ সারা বিশ্বের জন্য একটি মাত্র ভাষা আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্যাপৃত। কিন্তুু খানায়ে কা’বার কেন্দ্রীয় ফায়সালা আলে ইব্রাহীমের জন্য দীর্ঘকাল যাবত এই সমস্যার সমাধান দিয়ে আসছে। মানুষ আজ দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মাঝে একতা ও ঐক্য পয়দা করার জন্য একটি বিশ্ব মজলিস আহŸান করার কথা ভাবছে। কিন্তু যতদূর পর্যন্ত মুসলমানরদের সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে, আজ প্রায় পরেনশ’ বছর যাবত এ মজলিসটি কায়েম আছে। এবং ইসলামের জ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতি, মাজহাব এবং নৈতিক একতা বিশ্বের বুকে একতার পতাকা সমুন্নত করে রয়েছে। আজ দুনিয়ার জাতিগুলো ‘হেগ’ ভিত্তিক (হল্যাÐ) বিশ্ব আদালতের বুনিয়াদ রেখেছে। কিন্তু এই আদালতের রায় কোনও শক্তির দ্বারা প্রয়োগ করতে পারছে না। কিন্তু মুসলমানদের মাঝে একট্ িবিশ্বজনীন আদালত সব সময়ই কায়েম রয়েছে। যে আদালতের কুরসীতে উপবেশন করে আছেন স্বয়ং সকল বিজ্ঞানীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আহকামুল হাকেমীন। যার ফায়সালাকে অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই।
মুসলমনাগণ দেড়শত বছর পর্যন্ত যতদিন এক সা¤্রাজ্যের নিয়ম-শৃঙ্খলা অথবা খেলাফতের অধীনে ছিল, এই হজ্জের মওসুমটি তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা, মাজহাবী নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং নীতি নির্ধারণের বড় উপকরণ ছিল। এ সময়টি ছিল এমনই যে, এর মাঝে খেলাফত সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এ সময়ে ফায়সালা কর হত। সুদূর স্পেন হতে ভারতবর্ষের সিন্ধু-প্রদেশ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের প্রশাসকগণ ও গভর্ণরগণ এ সময়ে একত্রে সমবেত হতেন। এবং খলীফার সামনে বিভিন্ন বিষয়ে শলা-পরামর্শ করতেন। এখানেই কার্য পদ্ধতি নির্ধারণ করা হত। বিভিন্ন দেশের প্রজা সাধারণ এ সময়ে উপস্থিত হয়ে কোনও প্রশাসকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তা তুলে ধরতেন। এবং খলীফা উদ্ভুত সমস্যার ইনসাফ করতেন।
সম্ভবত : এ কারণেই হজ্জের মাসায়েল বিবৃত করার সাথে সাথে আল্লাহ পাক এ কথাও বলে দিয়েছেন যে, দেশে ফাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি করা খুবই জঘন্যতম অপরাধ। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “কোন কোন লোক এমন হয় যে, তাদের কথাবার্তা দুনিয়ার জীবনে ভাল মনে হয় এবং তাদের অন্তরে যা আছে এ বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী বানায়; অথচ তারা খুবই ঝগড়াটে; যখনই তারা মুখ ফিরায়, তখন দেশে দৌড়াতে থাকে, যেন দেশে অশান্তি ছড়াতে পারে, ক্ষেত-ফসল ও বংশধরদের ধ্বংস করতে পারে; অবশ্যই আল্লাহপাক ফেতনা-ফাসাদকে ভালবাসেন না।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
এই আয়াতের দু’টি আয়াত পরেই মহান আল্লাহপাক ঘোষণা করছেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই পরিপূর্ণরূপে শান্তি ও ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, কেননা অবশ্যই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রæ।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
ইসলামের আহকাম, মাসায়েল তড়িৎগতিতে একই বছরে দূর-দূরান্তের দেশগুলোতে, শহরও নগরগুলোতে এবং মহাদেশসমূহে এমন এক সময়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল, যখন সফর, আসা-যাওয়া ও সংবাদ পেঁছৈানো সহজসাধ্য ছিল না। এর বিস্তৃতি ও প্রসারের মূল চালিকাশিক্ত ছিল এই হজ্জ অনুষ্ঠান। স্বয়ং রাসূলুলুল্লাহ (সা:) নিজের জীবনের সর্বশেষ হজ্জ যাকে বিদায় হজ্জ বলা হয়, এই নিয়ম-নীতির উপরই সম্পন্ন করেছিলেন। যে মুসলমানরা দীর্ঘ তের বছর যাবত মক্কা মুয়াজ্জমাতে একাকী ও কোণঠাসা ছিলেন, ঠিক তেইশ বছর পরেই সেই সুযোগ এসে গেল, যখন এক লাখ জনসমষ্টিকে খেতাব করে কথা বলার অবসর মিললো। তাদের সবাই একান্তভাবে তাঁর বাণীকে গ্রহণ করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পর খোলাফায়ে রাশেদীন, অন্যান্য খলীফাগণ, সাহাবায়ে কেরাম, সুবিজ্ঞ ইমামগণ একইভাবে প্রতি বছর একত্র হয়ে আহকামে ইসলাম শিক্ষা দিতেন এবং তাবলীগের খেদমত আদায় করতেন। এরই ফলশ্রæতিতে নিত্য নতুন ঘটনাবলী ও সমস্যা সম্পর্কে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের ফতুয়াসমূহ ও সমাধানের বিষয়াবলীর খবর পৌঁছতে থাকে। এমনকি এখানো তা সমভাবে প্রযোজ্য রয়েছে।
এই কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রভাবেই বড় বড় সাহাবী, আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফকীহগণ ইসলামী বিজয়ের সাথে সাথে দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়েন। তারা বছরের বিভিন্ন সময় পরিভ্রমণ করে হজ্জের মওসুমে মক্কায় এসে সমবেত হতেন। তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে ছুটে এসে হেরেমে ইব্রাহীমীতে জড়ো হতেন। এবং একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে এই জ্ঞানকে এখানো পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছেন। সুদূর বুখারার অধিবাসীরা, স্পেনের অধিবাসীরা, মরক্কো, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, হিজাজ, বসরা, কুফা, নিশাপুর, জর্ডান, তুরস্ক, হিন্দুস্তান, ইরান, ইয়েমেন এবং অন্যান্য দেশের অধিবাসীরা পরস্পর মিলিত হয়ে জ্ঞান চর্চা করতেন এবং জ্ঞান বিতরণ করতেন। আর এভাবে তড়িৎ গতিতে সিন্ধু দেশের জ্ঞান স্পেন দেশে এবং স্পেন দেশের অভিজ্ঞান ভারতে পৌঁছে যেত। এতে করেই মিসরে লিখিত গ্রন্থাবলী ও রেওয়ায়েত সমূহ তুর্কীস্তানে এবং তুর্কীস্তানের সিদ্ধান্ত মিসরে ও সিরিয়ায় পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ত। এভাবেই হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর শাগরিদগণ হযরত ইবনে ওমর এবং হযরত আয়েশা (রা:)-এর শিষ্যদের নিকট হতে জ্ঞান লাভ করতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (সা:)-এর শিষ্যগণ হযরত আবু হুরায়রা (রা:)-এর শিষ্যদের নিকট জ্ঞান চর্চা করতেন। এমনিভাবে হযরত আনাস (রা:)-এর দরবারের শিক্ষার্থীরা হযরত আলী (রা:)-এর শাগরিদগণের নিকট বিদ্যা শিক্ষা করতেন।
এটাই ছিল এমন এক মহাসম্মেলন, যেখানে ‘আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন’ পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলিত হতেন এবং একে অন্যের জ্ঞানবত্তার দ্বারা উপকৃত হতেন। এই বংশ পরস্পরা নিঃসৃত পরিচয়ের সেতুবন্ধনই ছিল মূল অবলম্বন, যার বদৌলতে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁদের শিষ্যগণ, দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর অবস্থা ও ঘটনাবলী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আহকাম ও ফরমানসমূহ এবং অসীয়তের যাবতীয় বিবরণ বিন্যস্তরূপে এক হয়ে গেছে এবং রাসূলূল্লাহ (সা:)-এর জীবন-চরিত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ, আহাদীস ও তালিম সমূহ পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত হয়ে মুসলমানদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে এবং মুয়াত্তা, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিজী এবং আহাদীসের একাধিক গ্রন্থ আত্মপ্রকাশ করেছে। আর এতে করেই আমিম্মায়ে মুজতাহিদীনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন মাসয়ালা সম্পর্কে অন্যান্য ইমামদের খেয়ালাত ও অভিজ্ঞান সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সামগ্রিক মাসয়ালাগুলোকে পৃথক করা। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল গ্রন্থাদি প্রণয়ন করা এবং এগুলোকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা। যাতে করে এক দেশের আলেম সম্প্রদায় অন্যান্য দেশের আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনীষা সম্বন্ধে অবহিত হতে সক্ষম হয়। যুগ ও কালের চাহিদা মোতাবেক অদ্যাবধি এই সিলসিলা জারী রয়েছে।
এটা হচ্ছে সেই কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতিফল যে, সাধারণ মুসলমান যারা নিজেদের দেশে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে, তারা দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে এবং সকল প্রকার দু:খ-কষ্ট সহ্য করে, দরিয়া, পাহাড়, জঙ্গল, আবাদী এবং ময়দানসমূহ পার হয়ে এখানে একত্রিত হতেন। একে অন্যের সাথে মিলিত হতেন, একে অপরের বেদনা, দুশ্চিন্তা ও অবস্থা সম্বন্ধে অবহিত হতেন এবং এভাবেই তাদের মাঝে পরস্পর একতা, পরিচয় ও সহানুভূতির আকর্ষণ পয়দা হত। এখানে এসেই মরক্কো, তিউনিসিয়া, হিন্দুস্তানী, তাতারী, হাবশী, ফিরিঙ্গী, আরবী, আজমী, ইয়েমেনী, নজদী, তুর্কী, আফগানী, মিসরী, তুর্কীস্তানী, আলজেরিয়ান, রোমান, আফ্রিকা, ইউরোপীয়ান ও বুলগেরিয়ার অধিবাসীগণ একত্র মিলিত হতেন এবং সবাই একত্রে মিলে-মিশে এক জাতি, এক বংশ, এক গোত্র ও একই খান্দানের মত একাকার হয়ে যেতেন।
সুতরাং এরই ফলশ্রæতিতে সাধারণ হতে সাধারণতর মুসলমানও নিজের দেশের বাইরের জগতকে পরিভ্রমণ করে আসতে পারেন এবং বহির্বিশ্বের সাথে পরিচিত হতে সক্ষম হন। যুগের চাহিদা ও রং-রূপ চিনতে পারেন, রাজনৈতিক জটিল চিন্তাধারা অনুধাবন করতে পারেন, আন্তর্জাতিক বিষয়াদিও ঘটনাবলীর সাথে পরিচিত হতে পারেন এবং দুনিয়ার ঐ প্রান্তের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন, যেখানে প্রতিটি মীনারায় আল্লাহ আকবর ধ্বনি উত্থিত হয়। এতে করে সে আরও উদ্বেল ও উদগ্রীব হয়ে উঠে। আর এরই ফলশ্রæতিতে প্রত্যেক মুসলমান ইসলামী দুনিয়া ও ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা ও ঘটনাবলী শিশুকাল হতেই দেখতে পারে। এরই বদৌলতে সামান্য হতে সামান্যতর পদমর্যাদার অধিকারী মুসলমানগণের মাঝে এমন একটি বৃহৎ দল পাওয়া যাবে, যাদের পৃথিবী পরিভ্রমণ সম্বন্ধে সুষ্ঠু অভিজ্ঞতা আছে। স্থলপথ ও পানি পথ সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে। দুনিয়ার ভৌগোলিক অভিজ্ঞানের পরিসীমা পরিবর্দ্ধনের ক্ষেত্রে হজ্জ ভ্রমণ এক সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মুসলমানদের মাঝে এমন সব নাবিক, পরিব্রাজক ও ভৌগোলিক অতিবাহিত হয়েছেন, যারা মূলত: হজ্জের নিয়তেই বের হয়েছিলেন। পরিশেষে এই ভ্রমণ বিশ্ব পর্যটকের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ইয়াকুত রূসী তার ভূগোলগ্রস্থ ‘তাকবীমূল বুলদানের’ ভূমিকায় লিখেছেন, “মুসলামনদের ভৌগোলিক জ্ঞানের উন্নতির মূলে রয়েছে হজ্জ সফরের অভিজ্ঞতা।”(চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন