শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

যুব সমাজে মাদকাসক্তি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সুস্থ ও নিরাপদ থাকতে হলে শিক্ষার্থী ও যুব সমাজসহ সকল স্তরের মানুষকে মাদকের গ্রাস থেকে মুক্ত থাকতে হবে। মাদকাসক্তি দেশের যুব সমাজকে দ্রæত ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। মাদকদ্রব্য তাই সমাজ ও জাতির জন্য বিষাক্ত বিষবাষ্প। পরম্পরায় ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম করে যারা জীবন উৎসর্গ করে, নব জীবনের সঙ্গীত রচনার ভার যাদের উপর নির্ভর করে, তারা আমাদের গর্বের যুব সমাজ। তারা সুন্দরের পূজারী, অসাধ্য সাধনের কারিগর। যেখানে প্রতিকারহীন মানবতা বারবার অশ্রæ ঝরিয়ে বোবা কান্নায় মুষড়ে পড়ে, সেখানে মন যাদের বিশ্বাসে ভরপুর, যাদের চোখে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন, যারা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না, পুরাতনকে ভেঙে নতুন কিছু করতে চায় সেই তরুণরা জীর্ণ জাতির বুকে আশার আলো জ্বালায়। পুরাতনকে পেছনে ফেলে তারা মেতে উঠে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। রাত কিংবা দিন, মরু বা সাগর কোনও কিছুই তাদের কাছে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠে না, ভরা যৌবন তাদের নিয়ে যায় সব ভয়ঙ্করকে অতিক্রম করে সুন্দরের কাছে। দেশ-কালকে তারা তুচ্ছ করে শুধু সৃষ্টির জয়গান গেয়ে যায়। তারা দেশের প্রাণ, দেশের সম্পদ। এ যুব সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলে দেশের চেহারা তারা রাতারাতি পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশের যুব সমাজের এক বড় অংশ আজ সর্বনাশা মাদকের করাল গ্রাসে বিলীন হতে বসেছে। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে ধ্বংস হচ্ছে যুব সমাজ। যে বয়সে পড়াশোনা ও খেলাধূলায় তাদের মনোযোগী হওয়ার কথা, সে বয়সে তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিচ্ছে মাদকের নেশা। যুবকদের পাশাপাশি স্কুলের কিশোর ও পথশিশুরাও আসক্ত হয়ে পড়ছে সর্বনাশা মাদকে। আর এ নেশায় আক্রান্ত হয়ে অন্ধকার জীবনে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক যুবক-যুবতী। নেশা গ্রহণকারী শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। ধূমপানের পাশাপাশি এসব যুবক গাঁজা, ফেন্সিডিল, জুতায় লাগানোর পেষ্টিং (ড্যান্ডি), চোলাই মদসহ সর্বনাশা ইয়াবা, হেরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। স্কুলের ছাত্রদের পাশাপাশি পথশিশুরাও মাদক সেবন করছে। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, হেরোইন, ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। আগামীতে যারা দেশের নেতৃত্ব দেবে সেই তরুণদের একটি বড় অংশ ইয়াবা সেবন করে বিপথগামী হচ্ছে। মাদক সহজলভ্য হওয়ায় দিন দিন সেবনকারী ও বিক্রেতাদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলছে। অন্যদিকে টাকা যোগাড়ে বাড়ছে চুরি, রাহাজানির মতো মারাত্মক অপরাধ প্রবণতা। এজন্য অনেকটা দায়ী বেকারত্ব, হতাশা, বন্ধু-বান্ধবের প্ররোচনা, পারিবারিক অশান্তি, পাশ্চাত্য জীবনের অন্ধ অনুকরণ ইত্যাদি। অশিক্ষিত যুবকরা না বুঝে বা এর ভয়াবহতা না জেনে ওই পথে ধাবিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের শিক্ষিত যুবকরা তো এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে, তারা কেন ওই পথে? দেখা যায়, কলেজ লেভেলের অনেক ছাত্র ধূমপানে আসক্ত। তারা অনেকে শৌখিনতা ও কৌতূহলবশত এই পথে। অনেকের আবার একটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, সিগারেট খেলে নাকি মেয়েদের আকৃষ্ট করা যায়। এই রকম কিছু কৌতূহলতার কারণে যুবকরা মারাত্মকভাবে বেগতিক হয়ে যাচ্ছে, যার লাগাম টানা এখনই দরকার। সর্বনাশা মাদকের মরণ ছোবলের কারণে যুব সমাজ শুধু মেধাশূন্য হচ্ছে তা নয়, মাদকাসক্তদের মনুষ্যত্ব, বিবেক ও বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। তারই প্রতিফলন তাদের আচরণে উচ্ছৃঙ্খলতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, অভিভাবকদের অবাধ্যতা সর্বোপরি অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে তারা। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে এ বিষয় নিয়ে ভাবছি কি আমরা? যে সন্তানকে জন্ম থেকে তিলে তিলে আদর-ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করে তুলেছে বাবা-মা সে কীভাবে ছুরি চালায় তাদের বুকে! সন্তানের কাছে যে বাবা-মা পরম আদর মমতার আশ্রয়স্থল সে সন্তান কীভাবে পারে বাবা-মাকে হত্যা করতে? বাবা-মা মাথার ঘাম পায়ে ফেলানো আর রক্ত পানি করা পরিশ্রম আর সাধনায়, জীবনের সমুদয় অর্জিত অর্থ-সম্পদ-আকাক্সক্ষা দিয়ে প্রিয় সন্তানকে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠায়, সেখানে গিয়ে কি শিখছে তারা? কাদের সংস্পর্শে মিশে বিপথে যাচ্ছে? কীভাবে, কী কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে প্রিয় সন্তান- সেই ভাবনা আজ বিদগ্ধ করছে সমাজ, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং অভিভাবকদের। মূলত মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতেই কিশোর বা তরুণরা নানা রকম অসামাজিক কাজ এবং অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। একটা সময় পর্যন্ত এই মাদকাসক্তি তরুণদেরই বেশি আকৃষ্ট করতে দেখা গেলেও এখন ভয়ঙ্করভাবে তা তরুণী এমনকি কিশোর-কিশোরীদেরও ধ্বংসলীলায় মাতিয়ে তুলেছে। এর আরেক কারণ ফেন্সিডিল, গাঁজা, মদ, সিগারেট বা এসব নেশাজাত দ্রব্যের পাশাপাশি আধুনিক মরণ ট্যাবলেট ইয়াবার সংযোজন। সমাজে ব্যাপকভাবে ইয়াবার ছড়াছড়ির খবর হতাশাজনক। ইয়াবার নেশাগ্রস্ততা, যৌনকামিতা কিংবা নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার এমন তথ্য তরুণ-তরুণীদের আরও কৌতূহলী করে তুলছে ইয়াবা আসক্তিতে। তার উপর দায়ী হয়ে আসছে বন্ধুত্বের প্ররোচনা। আছে এসব নেশাজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতাও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, শিক্ষক সমাজের অনাদর্শিক কার্যক্রম, অভিভাবকদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের উদাসীনতা এজন্য দায়ী।
সা¤প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের গণমাধ্যমে প্রতিদিন খুন, সন্ত্রাসী, মাদকাসক্তদের ঘটনা এবং তরুণ প্রজন্মের অপরাধ প্রবণতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের তরুণরা মাদকে আসক্ত হয়ে নিজ মেধা, সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা আর শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এই অধঃপতনের কারণ হিসাবে নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক সংস্কৃতির বিলুপ্তি, সুশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অসামঞ্জস্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো সামগ্রিক অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন সমাজ বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকরা। আমাদের সমাজের সর্বত্রই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে নেশা দ্রব্য বিক্রি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রক্ষকই যে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে, তা একেবারেই সত্য এবং এটা আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না। কারণ সা¤প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে যে, কিছু কিছু জায়গায় এমনকি গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলছে অবৈধভাবে মদকদ্রব্যের কেনাবেচা। দেশের কোণায় কোণায় গড়ে উঠছে অবৈধভাবে তামাকজাত সিগারেট, খৈনি, গুটখা, জর্দা, পান, মশলা ইত্যাদির দোকান। এর ফলে দেশের অনেক যুবক মাদকাসক্তির দিকে এগিয়ে চলছে এবং মাতাল হয়ে সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতীদের মাদকাসক্তভাব দেখে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোস্তাত্বিক বিভাগের অধ্যাপক্ষ হেরিংটন অভিমত ব্যক্ত করে বলেন- সমাজ, দেশ ও জাতিকে সুস্থ রাখতে হলে ছেলেমেয়েরা যাতে মাদকাসক্ত না হয় সেদিকে প্রতিটি নাগরিকের সচেতন হওয়া উচিত। এ বার্তা বিশ্বের প্রতিটি দেশের সচেতন নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি মিডিয়ার প্রতি উদাত্ত আহŸান জানান।
পরিশেষে যুব সমাজের প্রতি আহŸান রাখি, যৌবনের পরম দানকে নষ্ট করে ফেল না, স্থবির হয়ে জীবনের পরম সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতে যেয়ো না। যৌবনের শক্তির সদ্ব্যবহার কর। মহাকালের ঐশ্বর্য তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তোমাদের জীবনে বসন্ত জেগেছে, এ বসন্ত কি বৃথা হবে তোমার কাছে? তাই ফিরে এসো আলোর পথে, সত্যের পথে, সুন্দরের পথে, পাপ পঙ্কিলতাকে ত্যাগ করে সমাজের অগ্রদূত হয়ে জাতিকে আলোর পথ দেখাও। মাদককে তোমাদের না বলতেই হবে। কেন তুমি না বলবে না? তুমিই তো আগামীতে দেশের ভবিষ্যৎ। তোমার হাত ধরেই বাংলাদেশকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আসনের সম্মান নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট এবং সদস্য, সিলেট জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন