তাহমিনা কোরাইশী
দারুন মেয়েটির চলন-বলন। যেমন জুতোর হিলে শব্দ তুলে হেঁটে চলে তেমনি মুখেও প্রচন্ড বলিষ্ঠ ও দৃঢ়তার সাথে কথা বলে। মনে হয় উনুনে খই ফোটার মত চটাং চটাং শব্দে কথা বলে। কথায় তেমন সফ্টনেস নেই বললেই চলে। ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজিতে-বাংলায় কথা বলেই অভ্যস্ত। নেই কোন জড়তা। নেই কোন ভুল ব্যাখ্যা। নেই শব্দের বাহুল্যতা। নেই কোন রোমান্টিকতা। প্রথম দর্শনে আকৃষ্ট করে তার রুপ নয় সর্মাটলি বাচনভঙ্গি। ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে মনে হয় ওর কোন কষ্ট, দুঃখ, বেদনা, অভাব, দৈন্যতা কিছুই নেই। সেল্ফ মেইড একজন ওয়াম্যান। ঘাত-প্রতিঘাত থেকে বাঁচবার জন্য নিজেই নিজের বর্ম তৈরী করে নিয়েছে। একটাই দোষ অনর্গল কথা বলে।
নামটি ওর লিসা। অল্প দিনের পরিচয় আমার এক আত্মীয়ের বাসায় টরেন্টর মিসসসাওগাতে। ও থাকেও ঐখানে। আমাদের বাসা থেকে হাফ এন আওয়ার লাগে। আমার এরিয়া নর্থ ইয়র্ক। মাঝে মধ্যেই দেখা হয় কখনও সপিংমলে, কখনও ফাস্ট ফুড হট কফি হাউজে। প্রথম পরিচয়ে ভালো লেগেছে মেয়েটিকে।এখানকার সব কিছুতে কেমন এডজাস্ট করে নিয়েছে নিজেকে। লিসা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কাজ করে। আমিও সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে চাকুরীতে যোগ দিলাম। ওর সাথে দেখা হয় মাঝে মধ্যে। হুট করে সে দিন লিসার স্বামীর কথা জানতে চাইতে পারি নি। ভালো দেখায় না। এরই মাঝে হঠাৎ করেই একদিন প্রশ্ন করেই বসলাম তোমার সাথে তোমার সাত বছরের মেয়ে বেবীকেই দেখি। ওর বাবাকে একদিনও দেখলাম না যে। তোমার সাথে আসে না সে?
লিসার উত্তর চটাং চটাং- ও ধস ংরহমষব সড়ঃযবৎ. ওহ্, তুমি জানতে না মেরী?
আমি হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে মুহুর্তেই আমার হা করা মুখটি ঠাস করে বন্ধ করে দিয়ে বললো- ডযধঃ যধঢ়ঢ়বহ?
আমি একটু মাথা নাড়লাম। একটু হাসবার চেষ্টা করলাম। লিসা নিজের মত করে ওর আত্মজীবনী মুখস্ত বলতে আরম্ভ করলো।
সে পছন্দ করতো না চাইল্ড। সে পছন্দ করতো না এশিয়ান ওয়াম্যান। দেন তাদের মেন্টালিটিও। আমার প্রয়োজন ওর কাছে ফুরিয়ে গেছে। তাই আমারও প্রয়োজন নেই ঐ নামের বোঝাটি সারা জীবন বয়ে চলা। যে কোন কাজেই ঋধঃযবৎ’ং ঘধসব দরকার। কিন্তু কেনো আমি ঐ নাম আগলে রাখবো। আমি তাই ওর সাথে পার্মানেন্টলি আইনীভাবে সব সম্পর্ক শেষ কর নিলাম। ঝামেলা শেষ। নাও আই এম ফ্রী। নাও আই এম সিঙ্গেল মাদার।
আমার নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগলো অনেকক্ষণ। আমার দেশের সোদা মাটির ঘ্রাণের মত আমি একটু বেশী ইমোশনাল। বিদায় নিলাম লিসার কাছ থেকে। বেশ কিছুদিন দেখা হয় নি ওর সাথে। আমি নিজেও ব্যস্ত ছিলাম। অবশ্য সময় থাকলেই বেরিয়ে পড়ি এই মল থেকে সেই এরিয়ার মলে। এই রেস্টুরেন্ট ছেড়ে অন্য রেস্টুরেন্টে। পথের দূরত্ব কিছুই না। নেই যানজট। বেশ দূরের পথও কাছে হয়ে যায়। পনের বিশ মিনিটে বেশ অনেক দূর পথ পাড়ি দেয়া যায়। ঘুরে বেড়াতেও আনন্দ আছে। লং ড্রাইভে তো কথাই নাই। টরেন্টোতে বেশ অনেক বাঙ্গালী আছে। সেহেতু আত্মীয় স্বজন আছে অনেক। মনে হয় দেশেই আছি। সে দিন লিসা আর ওর মেয়ে বেবীর সাথে দেখা। ওয়ালমার্টের কিড্স কর্ণারে। ওর বেবীর জন্য গিফ্ট কিনছে মনে হলো। বললাম-
হাই লিসা- হাই বেবী সুইটহার্ট ....
লিসাও পাল্টা- হাই মেরী.... কিছু কিনছো?
আমি বললাম- এই তো নিজের জন্য কিছু টুকিটাকি। আর তুমি?
লিসা একটু অন্যমনস্ক ভাবে আমার কাছটিতে সরে এলো। কিছু বলতে চাইছে। আমিও ওর কাছে ঘেষে দাঁড়ালাম। লিসা বললো- বেবীর জন্য সামান্য কিছু গিফ্ট। গতকাল ঋধঃযবৎ’ং উধু ছিল তো। মনে হলো মেয়েটার মন খারাপ। ওর দিকে তাকাতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। আমার মনে পড়ে গেলো দেশের কথা। আমার দাদা আমাদের খুব ভালবাসতেন। তিনি মারা গেছেন। দাদী একলা হয়ে গেছে। আমার বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। অন্য মহিলার কাছে। আমার মা আমাদের একলাই মানুষ করেছেন। সেই বাবার নামটি আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। আর আমার মা মাথার তাজ করে রেখেছেন আজীবন। তিনি দিব্যি বেঁচে আছেন আনন্দেই আছেন। আজ দেখ আমার মেয়েটিরও ঐ এক অবস্থা। বলতে বলতে ওর দু’চোখের কোণে জল কিছু জমা হলো।
আমি তখনও ভাবছি কি বলবো। লিসা এক ঝটকায় চোখ মুছে নিলো। আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বললো- ঋড়ৎমবঃ রঃ. তবুও আমি কিছুক্ষণ যেনো জোর করেই বুকে টেনে জড়িয়ে একটু ওম দেবার চেষ্টা করলাম। ওর বেবীটাকে কাছে টেনে নিলাম। কিছু বলবার ভাষা হারিয়ে একেবারে বোবা হয়ে রইলাম।
ওর চলে যাওয়া পথটির দিকে চেয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। মনের ভেতর এক আকাশ মন্থর মেঘ জমে রইলো।
রবার্ট ফ্রস্ট-আমিরিকার জনপ্রিয় কবি। ১৮৭৪ সালে জন্ম নেয়া এই কবি মারা যান ১৯৬৩ সালে। মূলত প্রকৃতির কবি-আত্মা নিমগ্ন কবি। গ্রামীণ জীবনের বাস্তবানুগ বর্ণনা এবং আমেরিকান কথ্যভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল অমান্য। তাঁর রচনায় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের নিউ ইংল্যান্ডের গ্রামীণ বর্ণনা পাওয়া যায়।
ভাষান্তর : তহীদ মনি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন