কাটতে শুরু করেছে গুমোট পরিবেশ : কূটনীতিকদের প্রত্যাশার পারদও বাড়ছে
দেশের রাজনীতিতে ‘আশা জাগানো বার্তা’ দেখা যাচ্ছে। কাটতে শুরু করেছে গুমোট পরিবেশ। দীর্ঘদিনের রাজনীতিবিহীন ঢাকার বাতাসে রাজনীতির উত্তপ্ত ঢেউ। সবার অংশগ্রহণে ‘নির্বাচন’ প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তা ‘শান্তিপূর্ণ ভোটের ব্যাপারে’ বিদেশী কূটনীতিকদের প্রত্যাশার পারদও বাড়ছে। এতদিন মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে আইনশৃঙ্খলাজনিত অজুহাতে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ায় দেশে রাজনীতির চর্চা হয় একপক্ষীয়। কার্যত নির্বাসনে চলে যায় গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির আবহ।
‘রোডম্যাপ’ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সব দলের কাছে ইসির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির চেষ্টাও করছে। ইসির সঙ্গে সংলাপ করে বিএনপি নিরপেক্ষ ভোটের জন্য ২০ দফা দাবিনামা দিয়েছে। দলটি বলছে, সিইসির আচরণ এবং ইসির কর্মপন্থায় তারা খুশি। আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১১ দফা দাবিনামা নিয়ে ইসির সঙ্গে সংলাপে বসবে। বিএনপির সঙ্গে সংলাপে সিইসির ‘জিয়াউর রহমানই দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন’ বক্তব্য নিয়ে ছোট ছোট দু-তিনটি দল সিইসির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে উসকানোর চেষ্টা করলেও দলটি তাতে কর্ণপাত করেনি। বরং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উল্টো বলেছেন, সিইসি হয়তো একাদশ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়া নিশ্চিত করার কৌশল হিসেবে এটা বলেছেন।
চিকিৎসার জন্য তিন মাস বিদেশে অবস্থানের পর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ দেশে ফিরছেন। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ প্রস্তুতিতে এখন পর্যন্ত ‘আইনশৃঙ্খলাজনিত’ কারণ দেখিয়ে বাধা দেয়ার খবর পাওয়া যায়নি। বাধাহীনভাবে বিএনপি যদি আজ বেগম জিয়াকে স্বাগত জানাতে পারে তাহলে এর ধারাবাহিকতায় দলটি একের পর এক রাজনৈতিক কর্মসূচি এগিয়ে নেবে। আবার ইসির সঙ্গে সংলাপে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে সিইসির মূল্যায়ন বিএনপিকে আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণে বেশ আশাবাদী করছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কিছু মেরুদন্ডহীন ও ১৪ দলীয় জোটের কিছু গণবিচ্ছিন্ন নেতা নৌকায় উঠে মন্ত্রী হওয়ায় বিএনপির বিরুদ্ধে উগ্র মনোভাব দেখালেও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কথাবার্তায় বেশ সংযত। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে দেশের রাজনীতির বাতাসে নির্বাচনী ঢেউ এর পাশাপাশি সুুস্থ ধারা, গঠনমূলক ও প্রতিযোগিতার রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে।
দীর্ঘদিন থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন কার্যত স্থবির। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও উত্তপ্তের পর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটির ইস্যুটি এখনো ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এ নিয়ে কমবেশি সর্বমহল সোচ্চার। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। রাজনীতির অন্দরমহলে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে এক ধরনের গুমোট পরিবেশ বিরাজ করলেও রাজনৈতিক অঙ্গন সরব হচ্ছে। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও ঘরের ভেতরে বক্তৃতাবাজির রাজনীতি এখন রাজপথ-মাঠে ফিরে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সুস্পষ্ট মেসেজ না থাকলেও সরকারের সা¤প্রতিক কর্মকান্ডে ধারণা করা যায় ভেতরে ভেতরে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তাছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রভাবশালী দেশগুলোসহ সারাবিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে। তারা যেমন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছেন; তেমনি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়েও বেশ তৎপর। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশে জনগণের ভোটের অধিকার ও গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে এরই মধ্যে নড়েচড়ে বসেছেন। তাদের তৎরপরতা দৃশ্যমানও হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বিদেশী কূটনীতিকদের আনাগোনা, দফায় দফায় বৈঠক-আলোচনা চলছে। সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
ক্ষমতাসীন দলের হাইব্রিড, কাউয়াখ্যাত এবং নানা কারণে বিতর্কিত কিছু নেতা ও শরিক দলের ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া কিছু নেতা বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ‘রাজনৈতিক বিরোধ জিইয়ে’ রেখে ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ মহলকে চাপ দিচ্ছে। আর এ জন্য তারা নানা হাত-অজুহাত তুলছেন। কিন্তু বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং চলমান বাস্তবতায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একদলীয় নির্বাচন করা সরকারের পক্ষে কঠিন। কারণ বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য গণতন্ত্র সংকুচিত হওয়ায় দেশে বিদেশী বিনিয়োগ কমে গেছে, বেকারত্বের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। রাজনীতির গুমোট পরিস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার আবহের অনুপস্থিতি দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দুই ক্ষেত্রেই সরকার অসুবিধাজনক অবস্থায়। সংসদ আর বিচার বিভাগের মধ্যেই শুধু বিরোধ নয়; বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের দ্ব›দ্ব এতদিন রাখঢাক থাকলেও তা প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি এবং দেশ ছাড়ার সময় লিখিত বক্তব্য; পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আনীত ১১ অভিযোগ এবং আইনমন্ত্রী-অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যই বলে দেয় বিচার ও শাসন বিভাগের সম্পর্ক কতটা জটিল আকার ধারণ করেছে। আবার প্রধান বিচারপতি ইস্যুতে আওয়ামী লীগের পরম বন্ধু হিসেবে পরিচিত ভারতের মিডিয়াগুলো সুস্পষ্টভাবে এস কে সিনহার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দেশের উন্নয়নের গতিধারা থাকলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপক টানাপড়েন চলছে। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সহায়তা করতে দিল্লি পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছে। ভোট-পরবর্তী ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; সেই পরম বন্ধু ভারত এখন ইউ-টার্ন দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি ইস্যুতে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাও মাধব গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করেছেন। আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাদের মাত্র ২০ মিনিট সময় দেন। ওই বৈঠকে রাও মাধব স্পষ্ট জানিয়ে দেন, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি চায় বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। তা ছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বর্তমান সরকার ভারতকে পাশে পাবে প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু সরকার যতটা ধারণা করেছিল ভারত, চীন ও রাশিয়া পাশে থাকবে তা মোটেও হয়নি। শরণার্থীদের জন্য কিছু ত্রাণসামগ্রী পাঠালেও কার্যত তিন প্রভাবশালী দেশ মিয়ানমারের অনৈতিকতার পক্ষেই শক্ত অবস্থান নিয়েছে। আর নরেন্দ্র মোদি নিজেই মিয়ানমার সফর করে অং সান সু চির পাশে থাকার ঘোষণা দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে প্রশাসনিক কর্মকান্ড চালালেও অনেকটাই বিশ্রামে রয়েছেন। সরকারি কার্যক্রম ছাড়া দলীয় প্রোগামে তেমন অংশ নিচ্ছেন না। রাজনৈতিক কোনো কড়া বক্তব্যও দিচ্ছেন না, যা বলছেন তার অর্থ সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তারা বদ্ধপরিকর। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন পর আজ দেশে ফিরছেন। তার আগমনের পর বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি দেবে বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা। তার ওপর একাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানাও ঝুলছে। পরিস্থিতি যা-ই ঘটুক বাংলাদেশে ইতিবাচক রাজনীতির পরিবেশ ফেরাতে পর্দার অন্তরালে থেকেই দূতিয়ালি করছেন ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা। প্রার্থী-ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘সহিংসতা-সন্ত্রাস’ থেকে দেশকে মুক্ত হতে সহায়তা করা, একটি বিতর্কমুক্ত এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন নিশ্চিত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া দেশের সুশীলসমাজ এবং পেশাজীবীরা এ নিয়ে বেশ সক্রিয় মনে হচ্ছে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে দেশে অচিরেই ঘরবন্দী রাজনীতির বদলে মানুষ মাঠের রাজনীতি দেখতে পাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন