৭৫ বছরের বৃদ্ধার মর্মান্তিক মৃত্যু
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ইন্টার্ন বর্বরতার পূণরাবৃত্তি ঘটলো। ডিউটিরত এক নারী ইন্টার্র্নকে চিকিৎসার প্রয়োজনে সিস্টার বলে দৃষ্টি আকর্ষণের অপরাধে মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মাহেলা বেওয়া নামে ৭৫ বছর বয়সী এক মহিলা রোগীকে দেখতে আসা তার ছেলে ও নাতিকে বর্বরভাবে নির্যাতন করা হলো। নির্যাতনের পর ঘটনার কথা চেপে যাওয়ার শর্তে তাদেরকে গভীর রাতে হাসপাতাল থেকে বাইরে যেতে দেওয়া হয়। নির্যাতিতরা বর্তমানে জয়পুর হাট জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। অন্যদিকে শুক্রবার মাহেলা বেওয়াকেও হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিলে তাকে জয়পুরহাটে নেয়ার পথে তিনিও মারা যান বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিডিয়াকে জানালেও মাহেলার স্বজনদের দাবি পুত্র ও নাতিকে হাসপাতালে নির্যাতনের ঘটনায় তিনি মর্মাহত হয়ে হার্ট এ্যাটাকের শিকার হন। হাসপাতালেই তার মৃত্যু হলেও দায় এড়াতে কর্তৃপক্ষ তাকে রিলিজ করে দিয়েছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারী মাসে সিরাজগঞ্জ সদরের আলাউদ্দিন সরকার নামে এক বৃদ্ধ এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসলে তার বয়সী ছেলে রউফ সরকার এক নারী ইন্টার্র্নকে সিস্টার বলায় তাকেও বর্বরভাবে শারীরীক নির্যাতন করেছিল। পরদিন রউফের বোনসহ কয়েকজন মহিলাকেও ইন্টার্নরা শারীরীক নির্যাতন করে সেই সাথে রউফের বিরুদ্ধে ইভটিজিং এর অভিযোগ এনে তাকে পুলিশে সোপর্দ করেছিল। গত বৃহষ্পতিবার রাতের ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, শ্বাস কষ্টের সমস্যার কারণে জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল গ্রামের মৃত বজলুর রশিদের স্ত্রী মাহেলা বেওয়াকে (৭৫) শজিমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের মহিলা ওয়ার্ডে (ইউনিট-১, বেড নং-অতিরিক্ত ৫) গত ২৪ অক্টোবর ভর্তি করা হয়। ঘটনার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে রোগীর ছেলে গাজিউর রহমান (৪৫) ও নাতি রুম্মান হোসেন শান্ত (২৫) তাকে দেখতে আসেন। এ সময় রোগীর চিকিৎসা নিয়ে নাতী রুম্মান হোসেন শান্ত এক নারী ইন্টার্নকে আপা বলে সম্বোধন করে চিকিৎসার জন্য ডাক দেয়। এতে ওই মহিলা ইন্টার্ন চিকিৎসকের সাথে থাকা পুরুষ ইন্টার্ন চিকিৎসক তার কলার চেপে ধরে তাকে বলে, শালা ডাক্তারের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানোস না ? হতবাক শান্ত এর প্রতিবাদ করলে আরও খেপে যায় ইর্ন্টাণরা। সব্ইা মিলে শান্তকে মারধর শুরু করলে ছেলেকে রক্ষায় এগিয়ে আসে বাবা গাজিউর রহমান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটে আসে অন্যান্য ইন্টার্ন ও মেডিকেল কলেজের কিছু শিক্ষার্থী। সবাই মিলে পকেটমারের মত বাবা ছেলেকে মারতে মারতে তাদের একটি ঘরে নিয়ে আটকে রাখে। ঘটনার আকস্মিকতায় রোগী ও তাদের স্বজনরা ভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। খবর পেয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা রাতেই হাসপাতালে গেলেও তাদের কাউকেও ভিতরে যেতে দেওয়া হয়নি। হাসপাতালেই অপেক্ষমান গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে আসেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক নির্মলেন্দু চৌধুরী। তিনি নিজের মত করে পরিস্থিতি ব্যাখা দিয়ে বলেন, ‘ ইন্টার্নরা কাউকে মারেনি। বরং ইভটিজং করতে দেখে দুজনকে আটকে রাখা হয়েছে। যাদের হামলায় ৩/ ৪ জন ইন্টার্ন আহত হয়েছে, কেটে গেছে তাদের হাত।’ গণমাধ্যম কর্মীরা কাদের আটক করা হয়েছে, কোথায় আটক রাখা হয়েছে, কাকে তারা ইভটিজং করেছে জানতে চাইলে উপপরিচালক কোনো জবাব দেননি।
গণমাধ্যমকর্মীরা হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর আহত দু’জনকে পুলিশে দেয়া হবেনা, ইভটিজিং এর অভিযোগ করা হবেনা, মারপিটের ঘটনা পুরো চেপে যেতে হবে ইত্যাদি শর্তে তাদের শেষ রাতের দিকে হাসপাতাল ছাড়তে দেয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তারা সোজা জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় গণমাধ্যমকর্মীদের ওই ওয়ার্ডে একা যেতে দেয়া হয় তবে সাথে হাসপাতালের কর্মীদের পাহারার ব্যবস্থাও রাখা হয়। ফলে রোগী ও তাদের স্বজনরা ভয়ে মুখ খোলেনি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে। কেউ কেউ শুধু বলেন, কিছুই দেখেননি তারা। এসময় হাসপাতালে কোন ইন্টার্ন চিকিৎসককে ডিউটিতে দেখা যায়নি। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে চিকিৎসককে দেখা গেছে। একটি সূত্রে জানা যায়, কর্তৃপক্ষে যেন ইন্টার্নদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, সেজন্য তারা অঘোষিত কর্মবিরতিতে চলে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন রোগী জানান, এক বৃদ্ধার রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কথাকাটাকাটির পর হঠাৎ করেই একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে ওই রোগীর দু’ই আত্মীয়কে মারপিট করতে করতে একটি রুমে নিয়ে যায়। এ সময় তারা শুধু কান্নাকাটি আর্তচিৎকার চিৎকার করছিল। ঘটনার সময় আমরা ভয়ে ওয়ার্ড ছেড়ে বাহিরে চলে যাই। আমাদের বলা হয়, কেউ বাহিরের কাউকে এসব বিষয় বললে বিপদ আছে। ঘটনার পর গণমাধ্যমকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিতে রোগী সিসিইউতে সরিয়ে নেয়া হয়।
এদিকে হাসপাতালের উপ-পরিচালক নির্মলেন্দু চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, রোগীর অবস্থা আশাংকজনক হওয়ায় শুক্রবার মাহেলার স্বজনরা স্বেচ্ছায় রিলিজ নিয়েছেন। হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পর মাহেলার মৃত্যু হয়েছে বলেও শুনেছেন তিনি। ইন্টার্নরাও কর্মবিরতি ঘোষণা করেননি। তিনি আরো জানান, ঘটনার পর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম রসুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রোগীর সাথে পাশসহ দু’জনের বেশি কেউ থাকতে পারবেনা এবং সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত আনসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে মাহেলার স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, হাসপাতালে নিজের ছেলে ও নাতি মারপিটের খবর শুনেই তার শারীরীক অবস্থা খারাপ হয় ও তিনি হার্ট এ্যাটাকের কবলে পড়ে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনা ধামাচাপা দিতেই তাকে জোর করে রিলিজ করে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কোনাগাতি গ্রামের আলাউদ্দিন সরকার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাকে তার ছেলে আবদুর রউফ শজিমেক হাসপাতালে আসেন। একই কারণে তাকেও তার নারী আত্মীয়দের মারপিট করা হয়। তখনও নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককের ইভটিজিং-এর ধুয়া তোলা হয়। ওই ঘটনার পর আলাউদ্দিনও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ঘটনার তদন্তের পর অভিযুক্ত ইন্টার্নদের বিরুদ্ধে সাস্থ্য মন্ত্রনালয় শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিলেও ইর্ন্টার্ণ আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নেয়া শাস্তি মুলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়। তার পর থেকে ইন্টার্র্নদের ঔদ্ধতাপনা আরো বেড়েছে। প্রতিনিয়তই ইন্টার্র্নদের হাতে রোগী ও রোগীদের স্বজনরা অপমান অপদ্স্থ ও নাজেহাল হচ্ছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন