বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নিরাপত্তা পরিষদের বার্তা

| প্রকাশের সময় : ৯ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ দফায়ও কোন প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির একটি বিবৃতি সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয়েছে। গত আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগসন্ত্রাসীদের রোহিঙ্গা বিরোধি অভিযান ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকার ও বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ এবং রোহিঙ্গা ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানের পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ওআইসিসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে মিয়ানমারে জাতিগত নিধন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনের বার্তা দেয়া হলেও গত আড়াই মাসেও অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ নারীধর্ষণ, শিশুহত্যার মত নৃশংসতা অব্যাহত রয়েছে প্রাণভয়ে এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখনো প্রতিদিনই বিপসঙ্কুল পথ পেরিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরনার্থীর আশ্রয় ও দীর্ঘমেয়াদে ভরণপোষনের ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। তা’ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের দাবী অনেক পুরনো ইস্যু। ইতিহাসের বাস্তবতা ও মানবিক দাবীকে উপেক্ষা করে মিয়ানমার সরকার অর্ধশতাব্দীর বেশী সময় ধরে রোহিঙ্গাদের অধিকার বঞ্চিত করার পাশাপাশি সামরিক তান্ডব চালিয়ে আসছে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হলেও তারা এসব দাবী অগ্রাহ্য করে এসেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সভাপতির বিবৃতি আকারে মিয়ানমারের প্রতি নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্রের সর্বসম্মত বার্তা একটি বড় ধরনের ক‚টনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদ সভাপতির বিবৃতিতে হত্যা নির্যাতনের মুখে ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিকের বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার হরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতিপূর্বে গঠিত আনান কমিশনের সুপারিশ এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এর প্রস্তাব অনুসারে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ, উপদ্রুত এলাকাগুলোতে ত্রান পাঠানোসহ বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহনকারিদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান নিরাপত্তা পরিষদ সভাপতির বিবৃতিতে আবারো উঠে এসেছে। নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মিয়ানমার সরকারের দায়িত্ব বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের কথা বলে কালক্ষেপনের আশ্রয় নিলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে তাদের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের দাবীর পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক সমাধানের জন্যও মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফরের পর হতাশা প্রকাশ করেছেন। কোন ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন না করেই উল্টো বাংলাদেশের অনাগ্রহের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছে।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিপিএ সম্মেলনে কমনওয়েলথভ্ক্তু দেশগুলোর পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নি:শর্তভাবে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি সর্বসম্মত আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তারা সংকট সমাধানে জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। বলা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের বৃহত্তম ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদ সভাপতির বিবৃতি এবং সিপিএ সম্মেলনের বিবৃতি বিশ্বসম্প্রদায়ের সেই ঐকমত্যেরই প্রতিফলণ। মিয়ানমারের ঘনিষ্ট মিত্র চীন ও রাশিয়াসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী সব সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতিতে প্রকাশিত বিবৃতির পর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানে তারা আন্তরিক নয়। সামরিক অভিযান ও হত্যা নির্যাতন বন্ধ করে বিশ্বসম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশ্বাস দেয়ার বদলে প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে কথা বলেছেন তিনি। নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতির প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সুচি বলেছেন, এই বিবৃতি রোহিঙ্গা ইস্যুকে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমাধানের পথকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে মিয়ানমার যা’ই বলুক রোহিঙ্গা ইস্যু এখন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিনত হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ সভাপতি এবং সিপিএ সম্মেলনের বিবৃতি গ্রহনের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগামী কয়েক সপ্তায় ব্যাপক আন্তর্জাতিক ক‚টনৈতিক তৎপরতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার জন্য মার্কিন, চীন, জাপান, জার্মান ও সুইডেনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঢাকা, নেপিদো, নিউইয়র্ক-বেইজিংয়ে ক‚টনৈতিক তৎপরতা চালাবেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার এবং নাগরিকত্বের প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত বিবৃতিকে গাইডলাইন হিসেবে গণ্য করা যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ঘনিষ্ট মিত্র ও উন্নয়ন সহযোগি হিসেবে চীনের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। বিশ্বসম্প্রদায়ের ন্যায্য ও মানবিক আহ্বানে সাড়া না দিলে মিয়ানমারের উপর বাণিজ্যি, অর্থনৈতিক ও ক‚টনৈতিক চাপ বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন