গত অর্থবছরে সংস্কার কাজে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা : ৫ বছরে শুধুমাত্র রাজশাহী অঞ্চলে ব্যয় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা : বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জনপ্রতিনিধিরা সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশার চিত্র তুলে ধরছেন
চলতি বর্ষা মৌসুমের আগে থেকে চলছে সড়ক-মহাসড়কের সংস্কার কাজ। ধীর গতির এই কাজ কবে শেষ হবে তার নির্ধারিত কোনো দিন তারিখ নেই। তবে ঈদ এলে সংস্কার কাজের গতি বেড়ে যায়। তখন কোনো মতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করে সড়ক-মহাসড়কগুলো যান চলাচলের উপযোগী করা হয়। ক’দিন পরেই সেগুলো আবার ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরে যায়। সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা সেই জোড়াতালিমার্কা কাজেরই সাক্ষী। প্রতি বছর সড়ক-মহাসড়ক সংস্কারে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। তারপরেও দেশজুড়ে সড়ক-মহাসড়কের করুণ দশা। মহাসড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট এখন নিত্যদিনের ঘটনা। ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-রাজশাহীসহ দেশের বেশিরভাগ মহাসড়কে যানজট এখন নিত্যসঙ্গী। এর প্রধান কারন ভাঙাচোরা সড়কে নির্ধারিত গতিতে গাড়ি চলতে না পারা এবং সংস্কারের জন্য একদিকের রাস্তা বন্ধ থাকা। সড়কের মানোন্নয়নে গত অর্থ বছরে সড়ক পরিবহন, মহাসড়ক বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর মিলে ব্যয় করেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। তারপরেও কমেনি ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণ। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলছে। সওজ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে (২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর) শুধুমাত্র রাজশাহী অঞ্চলের সড়ক উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ গত অর্থবছরেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় অঞ্চলটিতে ৪৯৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। তারপরেও রাজশাহী অঞ্চলের সর্বত্রই সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা। এদিকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাঙাচোরা সড়ক নিয়ে সংসদ সদস্যদের অভিযোগ বাড়ছে। বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জনপ্রতিনিধিরা সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থার নানা চিত্র তুলে ধরেন। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা নিরসনে তারা সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে নতুন প্রকল্প গ্রহণ এবং চলমান প্রকল্প দ্রæত বাস্তবায়নের দাবি জানান। চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এলজিইডি’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, সবকিছু মূলে হলো অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সুশাসন ছাড়া কোনোদিন উন্নয়ন হবে না। মানুষের ভোগান্তি দুর করা যাবে না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) জরিপ মতে, ২০১৬ সালে সারাদেশে ভাঙাচোরা অবস্থায় ছিল জাতীয় সড়কের ২০ শতাংশ, আঞ্চলিক সড়কের ৩১ শতাংশ ও জেলা সড়কের ৪৭ শতাংশ। এসব সড়কের মানোন্নয়নে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা চাহিদার উল্লেখ করেছিল এইচডিএম। চাহিদা মোতাবেক সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং সওজ মিলে গত অর্থবছরে ব্যয় করে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। চাহিদার কাছাকাছি অর্থ ব্যয় হলেও ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণ কমেনি। সওজের আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে বন্যা ও অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণ আরো বেড়েছে। এবারের বর্ষায় সড়ক-মহাসড়কের ক্ষতির পরিমাণ এখনও পুরোপুরি নিরুপণ করা যায়নি। এর মধ্যেই চলছে সংস্কারের কাজ। বর্ষার আগে তৈরী করা এইচডিএম প্রতিবেদনের এর তথ্য মতে, দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩ হাজার ৮১৩ ও ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার। আর জেলা সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জেলা শহরের ৪৭ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। অতি বৃষ্টি ও বর্ষায় এর পরিমাণ আরও বেড়েছে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কটি ঢাকার সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কটির বেহাল দশা বর্ষার শুরু থেকেই। ঈদুল আযহার আগে তড়িঘড়ি করে এই মহাসড়কটির কিছু অংশ মেরামত করা হয়। মাত্র কয়েকদিনর ব্যবধানে সেগুলো আবার আগের অবস্থায় যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগিদের মতে, মহাসড়কটির বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড় থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত বহু স্থানে খানাখন্দে ভরা। কোনো যানবাহনই ৩০ কিলোমিটারের অধিক গতিতে চলতে পারে না। এর মধ্যে সংস্কারের কাজ চলায় মহাসড়কের একদিক বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই এই মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ময়মনসিংহের সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল জাতীয় মহাসড়ক। মহাসড়কটির মধুপুর-ময়মনসিংহ অংশের মুক্তাগাছা এলাকায় ১০ কিলোমিটার জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। অন্যদিকে, রংপুর অঞ্চলের ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৪৭৭ কিলোমিটার ভাঙাচোরা। এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও কিছু সড়ক ও মহাসড়ক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কগুলোর অবস্থা বর্ষার আগে থেকেই বেহাল। বন্যায় সেগুলোর অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়েছে। ঈদুল আযহার আগে তড়িঘড়ি প্রাথমিক কিছু সংস্কারকাজ হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বেশিদিন টিকেনি। রাজশাহী অঞ্চলের সড়কের মানোন্নয়নেও গত অর্থবছরে ৪৯৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সওজ। অথচ সওজের রাজশাহী অঞ্চলের (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) সড়কগুলোর বেশির ভাগই ভাঙাচোরা। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কের গোদাগাড়ী অংশের বিভিন্ন স্থান দেবে গেছে। কার্পেটিং উঠে দেখা দিয়েছে বড় বড় গর্ত। যদিও সড়কটি সংস্কারে চলতি বছরের জুনে প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সওজ। বগুড়া-রাজশাহী মহাসড়কসহ এখনও বহু স্থানে সড়ক-মহাসড়ক যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী।
অপরদিকে, এক বছর যেতে না যেতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক নষ্ট হতে শুরু করেছে। মহাসড়কের উপর থেকে পাথর উঠে ক্রমে অসমান হয়ে যাচ্ছে। চার লেনের সাথে যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত ৮ লেনের মহাসড়কও ভেঙ্গে একাকার হতে চলেছে। অথচ মাত্র এক বছর হতে চললো এই মহাসড়ক উদ্বোধন হয়েছে। ৮ লেনের মহাসড়কে কুতুবখালী ও রায়েরবাগের অংশে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কের উপরের অংশ থেকে পাথর উঠে গেছে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থেকে রায়েরবাগ পর্যন্ত ২ লেনই বেদখল হয়ে আছে বহুদিন যাবত।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ অংশ ছাড়া বাকীটা চলাচলের যোগ্য। কিন্তু সিলেটের আঞ্চলিক সড়কের বেহাল দশা বহুদিন ধরে। সিলেটের গোলাপগঞ্জ-চারখাই-জকিগঞ্জ ও সিলেট-জাফলং সড়ক দুটি আগে থেকেই ভগ্নদশায় ছিল। বন্যায় এ দুটি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত তো হয়েছেই, সঙ্গে ফেঞ্চুগঞ্জ-মাইজাগাঁওসহ আরো কয়েকটি সড়কেও দেখা দিয়েছে খানাখন্দ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলেরও একই অবস্থা। যশোর অঞ্চলের বেশির ভাগ সড়কই ভাঙাচোরা। যশোর সওজ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, যশোর-খুলনা মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটার, যশোর-বেনাপোল সড়কের ৩৮ কিলোমিটার, যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটারই ভাঙাচোরা দশায়। একই অবস্থায় যশোর-মাগুরা সড়কের ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও যশোর-নড়াইল সড়কের ২০ কিলোমিটারও। অপরদিকে, দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। বছরের পর বছর অবহেলিত থেকে গেছে এটি। স্থানীয়দের মতে, মহাসড়কের চন্দনাইশ উপজেলার বিজিসি ট্রাস্ট, বাগিচার হাট, দোহাজারী, সাতকানিয়া উপজেলার নয়াখাল, কেরানীহাট, চারা বটতল, মিঠাদীঘি, রাজঘাটা ও লোহাগাড়া উপজেলার নোয়াপাড়া, চুনতি ফরেস্ট অফিসসহ ২০ স্পটে প্রায় ১০ কিলোমিটারজুড়ে ছোট-বড় গর্ত। দেশজুড়ে খানাখন্দের এসব সড়ক-মহাসড়ক ভোগান্তি বাড়াচ্ছে যান চালক ও যাত্রীদের। সময় নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে ঝুঁকি। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। একই সাথে পরিবহন ব্যবসায়ীরাও নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সারাদেশের খানাখন্দের সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে পরিবন মালিকরা খুবই ত্যক্ত-বিরক্ত। তাদের মতে, স্বাধীনতার পর দেশের সড়ক-মহাসড়কের এমন দশা কখনও হয়নি।
এদিকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাঙাচোরা সড়ক নিয়ে সংসদ সদস্যদের অভিযোগ বাড়ছে। সা¤প্রতিক মাসগুলোয় সংসদের বিভিন্ন কমিটির কার্যবিবরণীতে সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগের কথা উঠে এসেছে। সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি প্রতিশ্রæতি-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ৩২তম বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা বিভিন্ন সড়কের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। কমিটির সভাপতি ও রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী তার জেলার জামতলা-হাবাশপুর সড়কের কাটাখালী থেকে গুদারবাজার পর্যন্ত সড়কের অবস্থা খুব খারাপ বলে উল্লেখ করেন। একই বৈঠকে নওগাঁ-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. শহীদুজ্জামান বঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে কাজের ধীরগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। চলতি বছরের মে মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে চাঁদপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কসহ তার নির্বাচনী এলাকার অনেকগুলো সড়ক একেবারেই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বলে জানান। জুন মাসে অনুমিত হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও সারা দেশের ভাঙাচোরা সড়কের বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে একাধিক সংসদ সদস্য তাদের জেলার বেহাল সড়কের কথা তুলে ধরে দ্রæত মেরামতের উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে ঠিকাদারদের কাজের গুণগত মান বৃদ্ধির ওপরও জোর দেয়ার সুপারিশ করেন। সূত্র জানায়, সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে বিভিন্ন কমিটির বৈঠকে আলোচনায় সংসদ সদস্যরা রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতাকেই সড়কের দুরবস্থার জন্য দায়ী করেন। তাদের মতে, সড়ক তৈরি বা মেরামতের পর রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগ দেয়া হয় না। কোনো সড়ক কোথাও ভেঙে গেলে মেরামতে দ্রæত উদ্যোগ নেয়া হয় না বলেও সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন