শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মহাসড়কে মৃত্যুফাঁদ

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন : এপ্রিলে ৪২৭ দুর্ঘটনায় নিহত ৫৪৩ জন ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ সংসদে পাসের পর যথাযথ প্রয়োগ নেই : ইলিয়াস কাঞ্চন ঈদের ছুটির ৫ দিনে আহত ১০৪৭ জন পঙ্গু হাসপাতাল

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০২২, ১২:০৪ এএম

সড়ক-মহাসড়ক যেন হয়ে গেছে মৃত্যুফাঁদ। সড়কে নামলেই আতঙ্ক কখন দুর্ঘটনায় পড়তে হয়। ঈদের ছুটিতে ৫ দিনে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে এক হাজার ৪৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। গতকালও নাটরের বনপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে ৭ জন নিহত হন। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। ইদানিং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। ঈদের ছুটিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় একশ মানুষ। দেশের সড়কগুলোর যখন এই ভয়াবহ অবস্থা তখন গতকাল রোড সেফটি ফাউন্ডেশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয় গত মাসে দেশে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সড়কের এসব দুর্ঘটনায় ৫৪৩ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন আরও ৬১২ জন। নিহতদের মধ্যে ৬৭ জন নারী ও ৮১টি শিশু রয়েছে। গতকাল শনিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৬ জন নিহত হয়েছেন; যা মোট নিহতের ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। এপ্রিল মাসে দুর্ঘটনায় ১১৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৮৭ জন, অর্থাৎ ১৬ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এপ্রিল মাসে ৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত হয়েছেন এবং ৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। একই সময়ে ২১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়েছেন।
সংস্থাটি বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় গত মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হন ১৯ জন। এই হিসাবে মার্চের তুলনায় এপ্রিল মাসে প্রাণহানি কমেছে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। তবে এটা উন্নতির কোনও টেকসই সূচক নির্দেশ করছে না। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪৩১ জন, অর্থাৎ ৭৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ট্রাকসহ পণ্যবাহী দ্রুতগতির যানবাহন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। তাদের মতে, মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী যানবাহন চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। পথচারী নিহতের ঘটনাও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলেন না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।
যানবাহনভিত্তিক চিত্র : দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২০৬ জন (৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ), বাস যাত্রী ১৩ জন (২ দশমকি ৩৯ শতাংশ), ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ৬৩ জন (১১ দশমিক ৬০ শতাংশ), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-পুলিশ জিপ যাত্রী ১৪ জন (২ দশমিক ৫৭ শতাংশ), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক) ১০০ জন (১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-টমটম) ১৯ জন (৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান আরোহী ১২ জন (২ দশমিক ২০ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।
সড়ক-দুর্ঘটনা : রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৮৭টি (৪৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১২৩টি (২৮ দশমিক ৮০ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৬৫টি (১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৪৬টি (১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি (১ দশমিক ৪০ শতাংশ) সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরণ : দুর্ঘটনাসমূহের ৮৪টি (১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬৭টি (৩৯ দশমিক ১১ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১১৩টি (২৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৫২টি (১২ দশমিক ১৭ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১১টি (২ দশমিক ৫৭ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে। এতে আরো জানানো হয়, দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ৩০ দশমিক ১১ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রামট্রাক-তেলবাহী ট্যাঙ্কার-গ্যাস সিলিন্ডারবাহী ট্যাঙ্কার ৬ দশমিক ২০ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-পুলিশ জিপ ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৬ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-শিশুক) ১৫ দশমিক ৩২ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-টমটম- লাটাহাম্বা-ডাম্পার) ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
যানবাহনের সংখ্যা : দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৭৫৭টি। (ট্রাক ১৪৪, বাস ৭৯, কাভার্ডভ্যান ২৬, পিকআপ ৫৮, ট্রলি ৯, লরি ১০, ট্রাক্টর ১৭, তেলবাহী ট্যাঙ্কার ৩, গ্যাস সিলিন্ডারবাহী ট্যাঙ্কার ১, ডিএনসিসি’র ময়লাবাহী ট্রাক ১, ড্রামট্রাক ৭, মাইক্রোবাস ১৭, প্রাইভেটকার ১৪, অ্যাম্বুলেন্স ৩, পুলিশ জিপ ১, মোটরসাইকেল ১৯৭, থ্রি-হুইলার ১১৬ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-শিশুক) স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪৩ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-টমটম-লাটাহাম্বা-ডাম্পার) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান ১১ টি।
কখন দুর্ঘটনা বেশি ঘটে : দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৪ দশমিক ২১ শতাংশ, সকালে ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, দুপুরে ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, বিকালে ২০ দশমিক ৬০ শতাংশ, সন্ধ্যায় ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং রাতে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
বিভাগের দুর্ঘটনা : ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৩১টি দুর্ঘটনায় ১৫৬ জন নিহত। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৩৯টি দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত। সবচেয়ে কম ঝালকাঠি জেলায়। ৩টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ২২টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ৩০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, প্রাণহানি ২৮ দশমিক ৭২ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রাণহানি ১৩ দশমিক ০৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ২৪ দশমিক ১২ শতাংশ, প্রাণহানি ২২ দশমিক ০৯ শতাংশ, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ, প্রাণহানি ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, প্রাণহানি ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ, প্রাণহানি ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ ঘটেছে।
জানতে চাইলে অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংস্থা নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সরকার সড়কে দুর্ঘটনা রোধে সংসদে আইন পাস করেছে। কিন্তু সে আইন প্রয়োগে কোনো কার্যকর চিত্র নেই। আইনের যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা না থাকলে ড্রাইভার বেপরোয়া হবে; দুর্ঘটনা ঘটবে। তাছাড়া সড়কের বিভিন্ন দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের জবাবদিহিতা না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে; মানুষ মরছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন