দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো কার্যত মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হচ্ছে মানুষ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৯৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৯৭ জন নিহত ও ৫৪৮০জন আহত হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সড়কে ১৯৪১ জন নিহিত এবং ৪৭৯৪ জন আহত হয়। জাতীয় সড়ক, আন্ত : জেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। গত শনিবার বেসরকারী সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির নিয়মিত জরিপ ও পর্যবেক্ষন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গত মাসে ২৬৫টি দুর্ঘটনায় ৩৪ নারী ৪২ শিশুসহ ৩৩৩ জন নিহত ও ৬৩২ জন আহত হয়। এর মধ্যে ২৩ জুন ঈদুল ফিতরের ছুটির প্রথম দিন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আট দিনে ৭৩টি দুর্ঘটনায় ১১ নারী, ১৫ শিশুসহ ১২০ জন নিহত ও ২২৬ জন আহত হয়। ঈদে যাতায়াত-ব্যবস্থাপনা ও আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এ বছর ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে কম বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। আট দিনের পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিন ৯টির বেশী দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং গড়ে প্রতি দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত এবং ২৮ জনের বেশী আহত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার ঈদের ছুটিতে হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে বলে, স্বস্তি লাভ করার কোনো অবকাশ নেই। পা বাড়লেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু-এটা আমাদের দেশে রীতিমত প্রবাদে পরিণত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাস্তবতা এই যে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনা বৃদ্ধি, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন এবং সরকারের তরফে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নেয়া সত্তে¡ও দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সারাবিশ্বে যে সব দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেশী হয়, বাংলাদেশের অবস্থান সেই দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু কল্পনা করা যায়! অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটাই বাস্তব সত্য। নিহত হয় যত মানুষ আহত হয় তার চেয়ে কয়েকগুন বেশী মানুষ। এদের একটা বড় অংশ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু ও কর্মযোগ্যতাহীন হয়ে পড়ে।
সড়ক দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণগুলো আমরা মোটামুটি সবাই জানি। বেপরোয়া গাড়ি চালনা, অদক্ষ-আধাদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো, বাঁকসর্বস্ব রাস্তাঘাট, ট্রাফিক বিধি লংঘন, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রæটি,অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহন চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, সড়ক-মহাসড়কে হাট-বাজার, সড়ক-ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, পুলিশের স্বল্পতা, পথচারী ও যাত্রীদের অসচেতনতা এবং ট্রাফিক বিধি সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন তদন্ত-পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বেশীর ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের কারণে। চালকদের একটা বড় অংশই অদক্ষ। তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। যাদের আছে, তাদের লাইসেন্সেরও একাংশ ভুয়া। টাকা দিলে লাইসেন্স সংগ্রহ করা যেখানে সম্ভব, সেখানে কী না হতে পারে! খবর প্রকাশিত হয়েছে, দেশে যানবাহনের সংখ্যার চেয়ে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা কম। এ থেকে বুঝা যায় লাইসেন্সকে কোনো ব্যাপার বলেই যেন মনে করা হয় না। প্রায়শই সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের প্রতিযোগিতা করে চলাচল করতে দেখা যায়। চালকরা এই অনাকাঙ্খিত প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটায়। চালকদের প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাইসেন্স নেয়া; এ ব্যাপারে ওই কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করার তাকিদ দেয়া হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ চালকের নিশ্চয়তা বিধান করা গেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রত্যাশায় চেয়েও কমে যেতে পারে। এ জন্য লাইসেন্সদাতা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা ও নজরদারি বৃদ্ধি, সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা ও নজরদারি বাড়তে হবে। অনিয়ান্ত্রিত যান চালনা, ট্রাফিক বিধি লংঘন ইত্যাদির তাৎক্ষানিক শাস্তির ব্যবস্থা ভালো ফল দিতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর দ্রæততার সঙ্গে তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি দুর্ঘটনা রোধে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। দেখা গেছে, কখনোই দুর্ঘটনার তদন্ত স্বল্প সময়ে হয় না এবং হলেও বিচারে শাস্তি হয় নমনীয়। শাস্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রবল জনমত থাকলেও ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক-মালিকদের সংগঠন ও সংঘশক্তি শাস্তি বৃদ্ধির বিরোধিতা করে আসছে। দু:খজনক হলো, সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ মালিক বা শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতা ও পৃষ্ঠপোষক। এই বাস্তবতায় সড়ক দুর্ঘটনা কমার কারণ নেই।
সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা ও তৎপরতা বৃদ্ধি, সড়ক-মহাসড়কের বাঁক হ্রাস ও সংস্কার, দখল ও হাটবাজার উচ্ছেদ দুর্ঘটনা কমাতে পারে। এসব ব্যাপারে তেমন উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেই। সড়ক ব্যবস্থাপনা বলতে গেলে নেই-ই। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তার চেয়েও কম তাদের দায়িত্বশীলতা ও কর্মকুশলতা। সড়ক-মহাসড়ক সংস্কারের অনেক বড় বড় প্রকল্পের কথা আমরা জানি; কিন্তুু তার কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সড়ক ও সেতু মন্ত্রী তার মত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদি এই চেষ্টা ও ছোটছুটিটা তিনি না করতেন তাহলে কি হতো, কে জানে! সড়ক-মহাসড়ক দখল ও হাটবাজার উচ্ছেদ নিয়ে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সকালে উচ্ছেদ, বিকেলে দখল-এটাই বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষিদ্ধ হলেও অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহন দিব্যি সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে এভাবে সব চললে সড়ক দুর্ঘটনা কখনোই কমানো যাবে না। এও লক্ষ্য করা গেছে, যাত্রী ও পথচারিরা তাদের নিজেদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও একগুয়েমির কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হয় ও হতাহতের শিকার হয়। সড়ক-মহাসড়কে অসর্তকভাবে চলাফেরা, অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যানবাহনে ওঠা, এমনকি মালামালবাহী ট্রাকে ওঠা অনেক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণ। পথচারী ও যাত্রীরা যদি সচেতন না হয়, তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সড়ক দুর্ঘটনা কেবল হতাহতের ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এর প্রতিক্রিয়া পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও পড়ে। পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তি দুর্ঘটনার মারা গেলে কিংবা পঙ্গু হয়ে গেলে পরিবারটি বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং সামাজের বোঝায় পরিণত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, দুনিয়াতে জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই; বেঘোরে তা চলে যাবে এটা কারোই কাম্য হতে পারে না। নিরাপদ সড়ক চাই, দুর্ঘটনা মুক্ত সড়ক চাই-এটা কোনো অসম্ভব, অস্বাভাবিক প্রত্যাশা নয়। সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত প্রয়াস ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবশ্যই সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। সেই কাজটিই জরুরিভাবে করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন