সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে ¯্রষ্টা নারীকে শারীরিক গঠনশৈলী ও হৃদয়বত্তার দিক দিয়ে কিছুটা নমনীয় ও কমনীয় করে গড়েছেন। কিন্তু মেধাশক্তির দিক থেকে কোনো পার্থক্য রাখেননি। অথচ সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেও দেখা যাচ্ছে নারীর শারীরিক নমনীয়তাই অনিরাপ্তার কারণ। নারীর নিরাপত্তার বলয়টি একেবারেই সঙ্কুচিত। তার প্রমাণ প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় দৃষ্ট হয় ধর্ষণ, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, নারী পাচার, যৌতুকের দায়ে হাজার মামলার বিভিন্ন চিত্র, বাকি থাকে আরও প্রচারের আলোয় না-আসা অজানা হাজারো নারী নির্যাতনের ঘটনা। এসব অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নকে তাড়া করে। ইসলাম নারীকে পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। এরপরেও বিভিন্ন সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন নারীকে অনেক কিছু দিলেও বাইরের পোশাকি স্বাধীনতার নেপথ্যে রয়েছে অনেক কদর্য ও কন্টকার্কীণ চিত্র। নারীর সমস্যা এখনও যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই আছে। রাতের গভীর অন্ধকারে একা পথ চলতে যে-কোনো দেশের গন্যমান্য থেকে গৃহ পরিচারিকার পর্যন্ত একই অবস্থা । সেখানে জাতি-ধর্ম, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবারই এক দর। রক্তচক্ষু হায়েনারা নারীমাংসের জন্য ওত পেতে আছে সে হিং¯্র, অশিক্ষিত, বর্বর হোক আর শিক্ষিত ভদ্রবেশী সুপুরুষ হোক। সুযোগ সন্ধানে কেউই পিছিয়ে নেই। নারী নিজের বুদ্ধিবলে অনেকটা স্থান করে নিলেও কোনো কোনো সময়ে নিতান্ত ভীত, সঙ্কুচিত ও সন্ত্রস্ত। পর্বতারোহিণী, মহাকাশচারিণী থেকে করণিক পর্যন্ত সবার মনেই এক গোপন ভীতি তাড়া করে।
আজকাল নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত, প্রায় সব পরিবারেই কমেবেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে। দিন-দিন নারী জাতির ওপর হিংসাত্মক তথা নিষ্ঠুর অত্যাচার বেড়েই চলেছে। কারো উপর বিয়ের আগে তো কারো বিয়ের পরে। আমাদের সমাজে সাধারণত বিয়ের আগে অনেক মেয়ের উপর তাদের পরিবারের সদস্যরা ও অভিভাবকরা অত্যাচার করে থাকে। কারণ, মেয়েরা নিজেদের মনের মানুষটি খুঁজে নিক বা নিজেদের পচ্ছন্দ মতো একটু চলাফেরা করুক তা তাদের পরিবারের পছন্দের বাইরে। আর এর প্রতিবাদ করতে না-পেরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। আবার মেয়েকে অভিভাবকদের নিজেদের পছন্দের ছেলেটির সঙ্গে জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে সেই মেয়েটির বিবাহ-পরবর্তী জীবন অনেক কঠিন হয়ে পড়ে এবং কষ্টে অতিবাহিত হয়। এখানে নিজের মেয়েটির সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে তাকে কষ্টের সমুদ্রে ফেলে দেয় পিতা-মাতা বা অভিভাবক!
আজকাল বেশির ভাগ পরিবারে বউদের উপর অত্যাচার চলে যৌতুক নামক লোভের কারণে এবং তাদের গর্ভে মেয়ে জন্মের পর থেকে। যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া যে আইনত অপরাধ আমরা যদি সে বিষয়ে সচেতন হই এবং যৌতুকের বিরুদ্ধে আইনকে যথোপযুক্ত উপায়ে প্রয়োগ করি তাহলে যৌতুক নামক মারণব্যাধি আমাদের সমাজ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হবে। সেই সঙ্গে যৌতুকের জন্য কোনো নারীকে অত্যাচার ভোগ করতে হবে না বা আত্মাহুতিও দিতে হবে না। আবার অনেক পরিবারে মেয়ে জন্ম নেওয়ার পর নারী নির্যাতন বেড়ে যায়। এর কারণ হল, প্রায় পরিবারের সদস্যরা চায়, তাদের পরিবারে ছেলে সন্তান হোক যাতে তাদের বংশ দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু যখন কোন কোন পরিাবরে মেয়ে শিশুর জন্ম হয়, তখনই সেই পরিবারের বউয়ের উপর নেমে আসে অমানুষিক অত্যাচার। এই অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে অনেক গৃহবধূ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আমাদের জানা একান্ত দরকার যে, আসলে এ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে আল্লাহর উপর। কিন্তু কিছু পুরুষ তা স্বীকার না করে ঘরের বউয়ের উপর অত্যাচার চালায়। আসলে এখানে কারো কিছু করার নেই। আল্লাহর ইচ্ছায়ই সব হয়। কিন্তু আজকাল প্রায় সকলেই কন্যা সন্তানের জন্মের জন্য মহিলাদের দায়ী করে থাকে এবং তাদের উপর অত্যাচার চালায়। এছাড়াও নানাবিধ সমস্যা আমাদের সমাজে দেখা দিয়েছে। আজকাল অহরহই নারীদের উপর যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটে। আর এর শিকার হয় শিশু, কিশোরী থেকে শুরু করে যুবতী, বিবাহিতা মহিলা এবং প্রৌঢ়ারা সবাই। যৌন নিগ্রহের শিকার কেউই চায় না যে, যা ঘটেছে তা অন্যরা জানুক। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহের শিকার নারীরা ভয়ে মুখ খোলে না। কারণ, হয়তো ভাবে তারা আবার দুষ্কৃতদের শিকার হবে বা ভবিষ্যতে বিয়েতে সমস্যা হবে এটা ভেবে। যৌন নিগৃহীত প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলা পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়।
যতদিন না আমাদের দেশে নারী-পুরুষে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত অর্ধেক আকাশের বাসিন্দাদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের খুব একটা হেরফের যে হবে, না এবং নারী জাতির ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার যে চলতেই থাকবে, একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক সাংবাদিক-কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন