সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বাংলা আধুনিক নাটকের সূচনা ক্রমবর্ধমান ধারা

মেহেদী হাসান বাপ্পী | প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাংলা আধুনিক নাটকের সূচনা ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’ থেকে। পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ এবং তাঁর ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এই নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই নাট্যশালায় ইউরোপীয় নাট্যমঞ্চের আদলে মঞ্চ (সামনে খোলা, তিন দিক বদ্ধ) তৈরি করা হয়। এর পূর্বে আমাদের দেশে যে মঞ্চ ছিলো তা মূলত চারদিক খোলা এবং অভিনয় শিল্পীকে তার চারদিকের দর্শকের কথা ভেবে খুব দক্ষতার সাথে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করতে হতো। সেই দক্ষ অভিনয় শিল্পটি অভিহিত হতো যাত্রাপালা নামে, যার মধ্যেই আমাদের আধুনিক নাটকের শিকড় বিদ্যমান। ১৮৫৮ সালে রামনারায়ণ তর্করতেœর (১৮২২-১৮৮৬) ‘রতœাবলী’ নাটক দেখতে এসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা নাটক লেখার প্রয়োজন অনুভব করেন এবং ১৮৫৯ সালে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক রচনা করেন। এটাই আধুনিক পাশ্চাত্য শৈলীতে রচিত প্রথম বাংলা সার্থক নাটক। শুধু নাটক রচনাই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো না, বরং সমাজের ক্ষতগুলোকে নাটকের মাধ্যমে প্রকাশ করাই ছিলো তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) ও ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) এর স্পষ্ট প্রমাণ। তরুণ বয়সে ইয়ং বেঙ্গলের অনুরাগী ও অনুসারী হয়েও পরিণত বয়সে এসে মাইকেল ‘একেই কী বলে সভ্যতা’য় ইরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য বাবু সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অধঃপতনের চিত্রই ব্যক্ত করেছেন ব্যঙ্গরসের মাধ্যমে। তাঁর সামসময়িক নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) তৎকালীন সমাজের বৃটিশ শোষণ ও সমাজের বাবু সম্প্রদায়ের নৈতিক স্খলনের চিত্রই তুলে এনেছেন নাটক ও প্রহসনের মাধ্যমে। বিশেষ করে জমিদার বাবুদের স্ত্রী থাকা সত্বেও রক্ষিতা রাখা, মদ পান করার যে প্রথা প্রচলন ছিলো তাই দীনবন্ধু মিত্র ‘সধবার একাদশী’র (১৮৬১) মাধ্যমে ব্যঙ্গরসাত্মক বর্ণনার মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। 

মাইকেল ও দীনবন্ধুর পরে অনেকেই নাটক রচনায় প্রয়াস পান, এদের মধ্যে মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২), রাজকৃষ্ণ রায়(১৮৪৯-১৮৯৪), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) প্রমুখ নাটক রচনা করলেও বিশেষ কোন ধারার প্রবর্তন করতে পারেন নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এসে তাঁর কাব্যপ্রতিভাকে নাটকে বিশেষভাবে প্রকাশ করেন। গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, কাব্যনাট্য প্রভৃতি নাটক রচনার মাধ্যমে বাংলা নাট্য সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত পারিবারিক ভাবেই নাটকের সাথে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মেজো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বড় নাট্যকার ও অভিনেতা। সেই পারিবারিক পরিমÐলই তাঁকে নাটক রচনায় বিশেষ ভাবে অনুরাগী করে তুলেন। মাইকেল ও দীনবন্ধু মিত্রের মতো রবীন্দ্রনাথের সামসময়িকে তীক্ষè প্রতিভা নিয়ে নাটক রচনা করেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। যদিও এ সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) সহ আরো অনেকে নাটক রচনা করেন, তবে এঁদের প্রতিভাকে স্পর্শ করতে পারেনি অন্যদের নাট্য-প্রতিভা।
নাটক ‘সমাজের দর্পণ’। সমাজের চিত্রকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরাই নাটক্যারের কাজ। সেই ধারাবাহিকতায় মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচনা করেন ‘কবর’ (১৯৬৬) নাটক। যদিও এই নাটকটিকে তাঁর মৌলিক নাটক বলা চলে না, কেনো না তিনি এর আঙ্গিক ও ঘটনা নিয়েছিলেন মার্কিন নাট্যকার আর উইন শ’র ‘বেরি দ্য ডেড’ (১৯৩৬) নাটক থেকে। তাঁর পরেও তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরাচারী মনভাবকে এ নাটকের মাধ্যমে পুরোপুরি বাঙালি মনোভাবাপন্ন করে রচনা করতে সচেষ্ট হয়েছেন, এখানেই তাঁর মহৎ নাট্যকারের পরিচয় স্পষ্টত বিধৃত। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের বাংলা সাহিত্যে নাটকের বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়। সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) তাঁর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) ‘নুরুলদীনের সারা জীবন’ (১৯৮২) নাটকের মতো কালজয়ী নাটক সৃষ্টি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের মত করে এতো বৈচিত্র্য আঙ্গিকে কেউ নাটক রচনা করতে না পারলেও সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) নাটকের আঙ্গিকে বিশেষ বিশেষ কিছু দিক আনতে সক্ষম হয়েছেন, যা তাঁর পূর্বে কেউ পারেনি। নাটক যে শুধু সংলাপ নির্ভর নয়! তা বাংলা নাট্য সাহিত্যে সেলিম আল দীনের পূর্বে কেউ করে দেখাতে পারেন নি, এর স্পষ্ট প্রমান তাঁর ‘চাকা’ (১৯৯১) নাটক। তবে সেলিম আল দীনের পরে বাংলা নাটকের বিশেষ কোন পরিবর্তন বা নতুন ধারার সূচনা হয়েছে বলে স্পষ্ট কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। নাট্যসাহিত্য অনেকটা তার বিকাশমানতা থেকে দূরেই অবস্থান করছে এ কথাটি বলতে দ্বিধা করার কোন অবকাশ নেই। তবে রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলতে পারি ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ আমাদের নাট্যকারদের উপরেও বিশ্বাসটুকুন হারাচ্ছি না। তাঁরাও সমাজের ক্ষতগুলোকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরবেন। নাটককে সমাজের দর্পন হিসেবে, সমাজের অবক্ষয় থেকে মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে নতুন উদ্দীপনায় দর্শকদের কাছে তুলে ধরবেন বলে প্রত্যাশা রাখছি। বাংলা নাটক আবারো নতুন সম্ভাবনায় বিকশিত হবে, বাংলা সাহিত্যে পূর্ণজন্ম নেবে ক্ষণজন্মা নাট্যসাহিত্যিক, বাংলা নাটক আবারো তাঁদের সুনিপুণ নাট্য প্রতিভায় বিশ্ব দরবারে স্থায়ী আসন লাভ করবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মাহমুদ ইউসুফ ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৩:১০ পিএম says : 1
বাংলাভাষা ও সাহিত্যের কিংবদন্তী নাট্যকার প্রফেসর ড. আসকার ইবনে শাইখের নাম কোথায়?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন