হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার মান বাড়েনি। নিরসন হয়নি যাত্রীদের লাগেজ পেতে বিড়ম্বনা। বরং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করছেন বিমানের যাত্রীসেবার মান বেড়েছে। আর এ কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত পেতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়নের জন্য গড়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সংস্থাটি। তবে বাস্তবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং শাখায় নিয়ন্ত্রণ নেই বিমানের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার অভিযোগ থাকলেও তা সমাধান হচ্ছে না। বরং যাত্রীদের লাগেজ পেতে ভোগান্তি দিন দিন বেড়েই চলছে। ফ্লাইট অবতরণের ১২ মিনিটের মধ্যে লাগেজ ডেলিভারি শুরু করতে হবে এবং ২৯ মিনিটের মধ্যে সব লাগেজ ডেলিভারি শেষ করার কথা রয়েছে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন ও এয়ারলাইন্স ব্যবসার বিধি বিধানে। তবে শাহজালাল বিমানবন্দরে ঘটছে তার উল্টো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও যাত্রীরা তাদের লাগেজ পাচ্ছেন না। এমন অভিযোগ নিত্য দিনের। অথচ বিমান লাগেজ বিতরণের জন্য এক ঘণ্টার আগে বেল্টই চালু করতে পারছে না।
গতকাল আজিজুল হক নামের এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, সকাল ৭টায় কুয়েত থেকে এসে বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর সাড়ে ৯টা পর্যন্ত লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পর দেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকে বাড়িতে ফেরার জন্য সবাই ছটফট করেন। প্রিয়জনদের সাথে দেখা করা অপেক্ষা যেন শেষ হয় না। এছাড়া স্বজনেরা থাকে বিমানবন্দরের বাইরে অধীর আগ্রহে। তিনি বলেন, শাহজালালের মতো আর কোথাও লাগেজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয় না। একই ফ্লাইটে কুয়েত থেকে আসা শামসু মিয়া নামে অপর এক যাত্রীর অভিযোগ, ওই ফ্লাইট অবতরণের পর দেরিতে লাগেজ ডেলিভারি শুরু করার কিছুক্ষণ পরই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় যাত্রীরা জানতে চাইলে বেল্ট অপারেটর জানান, উড়োজাহাজ থেকে দ্রুততার সঙ্গে লাগেজ আনতে পারছে না বিমানের গ্রাউেন্ড হ্যান্ডলিং শাখার কর্মচারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিটি ফ্লাইট থেকে লাগেজসহ মালামাল ওঠানো ও নামানোর দায়িত্বে থাকেন বাংলাদেশ বিমানের কর্মচারীরা। মালামাল বা লাগেজ কখন বেল্টে আসবে, কখন সংশ্লিষ্ট যাত্রীরা পাবেন তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এ কারণে শাহজালাল দিয়ে যাতায়াতকারী যাত্রীরা বাংলাদেশ বিমানের কর্মচারীদের কাছে জিম্মি। বিশেষ করে লাগেজ পেতে যাত্রীদের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এ ব্যাপারে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, লাগেজ পেতে যাত্রীদের আগের মতো বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। অনেক পরিবর্তন এসেছে।
তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সেবাখাত উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ব্যবসায়িক বিষয়টি মাথায় রেখে বিমানকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিমানের লাভ অব্যাহত রাখতে বহরে আরো নতুন বিমান যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, বিমানের যাত্রী সেবার মান বাড়ানোর জন্য এবং লাগেজ পেতে আগে যে বিড়ম্বনা পোহাতে হতো এখন তা অনেকাংশে কমে এসেছে। লাগেজ হ্যান্ডেলিং ও বিমানে খাবারের মান বাড়াতে আমরা কাজ করছি।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকসানের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে লাভের মুখ দেখছে বাংলাদেশ বিমান। তারা বলছেন, গেল দুবছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। লাভের এ ধারা অব্যাহত রাখতে আধুনিকায়ন করাসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
কর্পোরেশন আমলের একের পর এক লোকসানের মুখে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের বৈধতা দিয়ে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ বিমানকে সরকারী মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। এরপর প্রথম দুই বছর লাভ করলেও সিবিএর আন্দোলন ও নানা সমস্যায় ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে আবারও লোকসান দিতে থাকে সংস্থাটি। বিমানের কর্মকর্তরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে আর কখনই যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে, সেজন্য এর আধুনিকায়নসহ বিমানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে। একারণেই বহরে আরো নতুন বিমান যুক্ত হচ্ছে।
বিমানের জনসংযোগ সূত্র জানায়, বিমান বহরে যুক্ত হচ্ছে আরও তিনটি উড়োজাহাজ। ড্যাশ ৮কিউ-৪০০এনজি টার্বোপ্রপ মডেলের উড়োজাহাজ তিনটি ক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অন্যদিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব এসএম গোলাম ফারুক বলেছেন, কানাডিয়ান কমার্শিয়াল কোম্পানি কর্পোরেশন (সিসিসি)-এর কাছ হতে বুমবারডিয়ার ইন্টারন্যাশনাল এর উৎপাদিত উড়োজাহাজ তিনটি জিটুজি ক্রয় ভিত্তিতে ক্রয় করবে সরকার।
তিনি আরো বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড (বিমান) দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা। বর্তমানে বিমান ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, সৈয়দপুর, যশোর, বরিশাল ও কক্সবাজার অভ্যন্তরীণ রুটে এবং ঢাকা, কলকাতা, কাঠমান্ডু, ইয়াংগুন আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী পরিবহন করছে। এসব রুটে পর্যাপ্ত যাত্রী সেবার সুযোগ থাকায় বিমান উড়োজাহাজ বহরে তিনটি ড্যাশ ৮কিউ-৪০০ এনজি বা এ ধরনের ৭০-৮০ আসন বিশিষ্ট টার্বোপ্রপ উড়োজাহাজ বিমানের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ক্রয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি নীতিগত অনুমোদনের জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবটি অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্তমন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিমানের উড়োজাহাজ বহরে বর্তমানে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ৪টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ২টি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর, ২টি এয়ারবাস ৩৩০-২০০, ২টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ অর্থাৎ মোট ১৩টি উড়োজাহাজ রয়েছে। যার মধ্যে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ২টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ অর্থাৎ মোট ৬টি উড়োজাহাজ বিমানে নিজস্ব এবং বাকি ৭টি উড়োজাহাজ ভাড়ায় সংগৃহীত।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র যায়, উড়োজাহাজ সংকটের কারণে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে বিমানের ফ্লাইড সিডিউল বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। উড়োজাহাজ তিনটি ক্রয় করা হলে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুটে ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেবার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে।
বিমানের মহাব্যবস্থাপক ও সিইও মোসাদ্দেক আহমেদ বলছেন, বিমান এখন ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে। লাভের মুখ দেখতে শুরু করার পর থেকে এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি এ বছরও বিমান লাভে থাকবে।
বিমানের হিসাব অনুযায়ী, সব খরচ-খরচা বাদ দিয়ে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিমান নিট মুনাফা করেছে প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা। পরের বছর কিছুটা কমলেও বজায় রয়েছে লাভের ধারাবাহিকতা। চলতি অর্থবছরেও লাভের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিমানের কর্মকর্তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন