শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

অবিলম্বে এই সম্পত্তি হস্তান্তর বন্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১৩৫ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী হোটেল শৈবালকে পানির দরে ওরিয়ন গ্রুপ নামের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ বছরের জন্য ছেড়ে দেয়ার সকল বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার সম্পত্তি মাত্র ৬০ কোটি টাকায় হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পর্যটন করপোরেশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারির সাথে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি যোগসাজশে অতি গোপনীয়ভাবে এ কাজ সম্পন্ন করেছে। টেন্ডারের কাজটিও গোপনে সারা হয়। পর্যটন করপোরেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারি ইউনিয়ন ও অফিসার্স এসোসিয়েশনের অধিকাংশ নেতাদের মোটা অংকের টাকার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি কাজ আদায় করে নেয়। এতে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত এবং কক্সবাজারের বিশিষ্টজনরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে দেয়া হচ্ছে। এটা না করে হোটেল শৈবালের বিদ্যমান ভবনগুলো সুরক্ষিত রেখে খালি জায়গা টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হস্তান্তর করা যেত। বেসরকারি খাতে হোটেলটি ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে যদি ব্যাপকভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে প্রচার করা হতো, তবে প্রতিযোগিতার যেমন সৃষ্টি হতো, তেমনি সরকারও লাভবান হতো। তা না করে ভয়াবহ দুর্নীতির মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে নামমাত্র মূল্যে হোটেলটির হস্তান্তরে সরকার যে বিপুল লোকসানে পড়তে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।
কক্সবাজারের হোটেল শৈবাল পর্যটকদের কাছে অর্ধ শতাব্দী ধরে আকর্ষণীয় হয়ে আছে। সাধারণত কক্সবাজার যাওয়া মানে শৈবালে উঠা বোঝায়। ১৯৬৫ সালে সাগরিকা রেস্তোঁরা চালুর মধ্য দিয়ে শৈবালের যাত্রা শুরু হয়। রেস্তোঁরাটি ভোজন রসিকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৫ সালে এখানে আবাসিক হোটেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন তালা ভবন নির্মাণ করে এতে সুইমিংপুল, লাইভ ফিস রেস্তোঁরা, গলফ বারসহ আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে একটি পরিপূর্ণ হোটেলে পরিণত করা হয়। পর্যটকদের কাছে এটি অন্যতম আকর্ষণীয় হোটেল হয়ে উঠে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারকে অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগও চলমান রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে পাঁচ তারকা হোটেল স্থাপনসহ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। সমুদ্রতীর ঘেঁষে মনোরম মেরিন ড্রাইভ নির্মিত হয়েছে। এখনো সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। ফলে কক্সবাজার বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল মুক্তারমালায় পরিণত হচ্ছে। প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে কক্সবাজার হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এই হাইওয়ে হলে কক্সবাজার পরিণত হবে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রে। বিদেশি পর্যটকদের ব্যাপক আগমনে কক্সবাজার অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। নির্মিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বিভিন্ন হোটেল-মোটেলসহ অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। এখনই কক্সবাজারে জমির দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে উঠেছে। প্রতি শতক জমির দাম গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে হোটেল শৈবালের যে ১৩৫ একর জমি রয়েছে, তার মূল্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার উপরে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পর্যটন করপোরেশনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারি এই নামী-দামী হোটেলটিকে জমিসহ পানির দামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। বলা যায়, সরকারি সম্পত্তি নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তারা ছিনিমিনি খেলছে। বেসরকারি খাতে হোটেলটি ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে একটি প্রতিষ্ঠানকে এত টাকার সম্পত্তি পানির দামে লিজ দেয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং কেউই তা মেনে নেবে না। এ ধরনের ঘটনা যেমন ভয়াবহ, তেমনি তা বরদাস্ত করা যায় না।
হোটেল শৈবাল শুধু রাষ্ট্রের সম্পত্তি নয়, এটি জনগণেরও সম্পত্তি। এ সম্পত্তি নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি বড় ধরনের অপরাধ। বেসরকারি খাতে হোটেলটি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যে চক্রটি জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাল-জালিয়াতি করে রাষ্ট্রের সম্পত্তি গোপনে কেউ নিয়ে নেবে, তা হতে পারে না। পর্যটন করপোরেশনের অধীনে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক সম্পত্তি রয়েছে। সেগুলোর ক্ষেত্রেও যদি এ ধরনের অপকর্ম ঘটে, তবে পর্যটন খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। এমনিতেই আমাদের পর্যটন খাতটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সেসব দেশ পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণে ব্যাপক আয়োজন করে চলেছে। এক পর্যটন খাত থেকে দেশগুলোর বিপুল অংকের রাজস্ব আসে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেন উল্টো পথে হাঁটছি। সিলেটে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষনীয় হয়ে উঠলেও সেখানে পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেনি। সেখানের জায়গা দখল হয়ে যাওয়া নিয়েও পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এ সম্ভাবনার সাথে পাল্লা দিয়ে অনিয়মও বাড়ছে। তার সর্বশেষ উদাহরণ হোটেল শৈবালকে সামান্য মূল্যে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া। এ ঘটনা যদি প্রশ্রয় পায়, তবে অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রেও সরকারি সম্পত্তি গোপনে পানির দামে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার হিড়িক পড়বে। আমরা মনে করি, যে প্রক্রিয়ায় শৈবালকে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি খাতে ছেড়ে না দিয়ে সরকারিভাবেই এর উন্নয়ন করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন