শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বেগম রোকেয়া দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা

কুতুবউদ্দিন আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বেগম রোকেয়া দৃশ্যত একজন নারী হলেও বস্তুত তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। আপাত দৃষ্টিতে আটপৌরে একজন নারীকে আমরা যেমন দেখি; ঘরসংসারেই তাদের দিনের সিংহভাগ সময় অতিবাহিত হয়। সাংসারিক কর্মব্যস্ততা তাকে এতোটাই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, বাইরের অন্যকোনো বিষয়ে মনোসংযোগ করা তার জন্য দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বিষয়ে এ-কথাগুলো একেবারেই মানানসই নয়। ঘরসংসারের চে’ তার কর্মক্ষেত্র খুব বেশি করে টেনেছে। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলই ছিল তাঁর প্রকৃত সংসার। এই স্কুলের মেয়েরা ছিল নিজসন্তানতুল্য, এর অফিস ছিল এই মহিয়সী নারীর কিচেনরুম। এই কিচেনরুমেই তিনি অহরাত্র পড়ে থাকতেন। তাঁর চিন্তাচেতনায় ছিল নারীশিক্ষা, নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের রোডম্যাপ। সমস্ত দিন তিনি এসব নিয়ে এতোটাই মগ্ন থাকতেন যে, নিজেকে নিয়ে, নিজের স্বাস্থ্য-শরীর নিয়ে, আত্মীয়স্বজন নিয়ে সামান্য চিন্তার সময় পেতেন না। নারী শিক্ষার প্রসার নিয়ে সারাদিন তিনি এতো কাজ করতেন, এতো কর্মব্যস্ত থাকতেন যে, তাঁর সমকক্ষ কোন কর্মঠ পুরুষও এদেশে খুব কম আছে। অর্থাৎ তাঁর জীবনে যে সাফল্যের মালা গ্রন্থিত হয়েছে; নারী জাতি যে আজ এতোটা দূরের পথে অভিষিক্ত হতে সক্ষম হয়েছে; এ-সবের মূলে রয়েছে এ মহিয়সী নারীর সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম। এ কঠোর পরিশ্রমই তাঁকে সফলতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি কতটা পরিশ্রমী ছিলেন, তা আমরা তাঁর স্বহস্তে লিখিত কয়েকটি চিঠি পড়লে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারব:
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর ছোটবোন মরিয়মকে তিনি লিখেছেন:
¯েœহাস্পদ মরিয়ম,
তোমার ১৯ শে আগস্টেও প্রাণ জুড়ানো চিঠিখানা পাইয়া সুখি হইয়াছি। আমার মত জ্বালাপোড়া মরুভূমি তোমার মধুর ¯েœহের যোগ্য নহে। তাই দেখ না, তোমার সরস চিঠিখানা মরুভূমি একেবারে শুষিয়াই লইয়াছিল।
চিঠি না লিখিবার একমাত্র কারণ সময়াভাব। বুঝিতেই পার এখন খোদার ফজলে পাঁচটি ক্লাস এবং ৭০টি ছোট-বড় মেয়ে, দু’খানা গাড়ি, দুই জোড়া ঘোড়া, সইস, কোচম্যান ইত্যাদি ইত্যাদি সবদিকে একা আমাকেই দৃষ্টি রাখিতে হয় । রোজ সন্ধ্যাবেলা সইসেরা ঠিকমত ঘোড়া মলে কিনা তাও আমাকে দেখিতে হয়। ভগিনীরে! এইযে হাড়ভাঙা গাধার খাটুনিÑ ইহার বিনিময় কী, জানিস? বিনিময় হইতেছে “ ভাঁড় লিপকে হাত কালা” অর্থাৎ উনুন লেপন করিলে উনুন তো বেশ পরিষ্কার হয়, কিন্তু যে লেপন কওে তাহারই হাত কালিতে কালো হইয়া যায়। আমার হাড়ভাঙা খাটুনির পরিবর্তে সমাজ বিস্ফারিত নেত্রে আমার খুঁটি-নাটি ভুলভ্রান্তির ছিদ্র অন্বেষণ করিতেই বদ্ধপরিকর। কচি মেয়েরা মা-বাপের কাছে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা যা বোঝে, তাহাই বলে। তাহা নিয়া একটু রঙ্গ হয়। এইরূপ সুখে-দুঃখে একরকম চলিয়াছে ভালোই। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা কেয়ামতের পরদিন দেওয়া হইবে। এখন পড়া তৈরি করিতেছি।
তোমার ¯েœহের ভগিনী
রোকেয়া

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল তাঁর বোন মরিয়মকে ব্যস্ততার কথা জানিয়েছেন:
প্রাণাধিকা মেরি,
গতকল্য তোমার পত্র পাইয়াছি। হ্যাঁ বোন স্কুলের প্রাইজ গত ১৫ই মার্চে হইয়া গিয়াছে। আমি আল্লাহ চাহে এবার তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই বোম্বে যাইব। কিন্তু বোন! তুমি যদি এই মাসের আরম্ভে যাও, তবে পারিব না। কারণ আমাদের স্কুল জুন মাসে বন্ধ হইবে। তুমি যদি ১৫ই বা ১৫ইর পরে যাও, তবে আমার যাওয়া হইবে। অতএব দয়া করিয়া পত্রপাঠ মাত্রই কিংবা তোমার যাত্রার তারিখ ঠিক হওয়া মাত্রই আমাকে জানাইও। মনে রাখিও ল²ী বোনটি আমার, ১০দিনের নোটিশ না পাইলে আমি ছুটি মঞ্জুর করাইতে এবং যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারিব না।
তোমার ¯েœহের আপা
রোকেয়া

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্টে ছোটবোনকে লেখা চিঠিতেও তাঁর একইরকম ব্যস্ততার কথা জানা যায়:
¯েœহাস্পদা মরিয়ম,
অবসর অভাবে তোমার চিঠির উত্তর দিতে পারি নাই, সেজন্য দুঃখিত হইও না। আমার অবসর নাই বলিয়াই এতদিন মরিতেও সময় পাই নাই। দাঙ্গায় আমরা প্রত্যক্ষ শহিদ হই নাই বটে, কিন্তু পরোক্ষ অনেক ক্ষতি সহ্য করিতেছি, তন্মধ্যে প্রধান দুইুটি এইÑ (১) অনেক লোক কলকাতা ত্যাগ করায় স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা কমিয়াছে।
(২) সইস, কোচম্যান, দারোয়ান প্রভৃতি চাকর পাওয়া যায় না।
বোন, বলিলাম ত’ মরিবার অবসর পাই না। পূর্বের চেয়ে খাটুনি বাড়িয়াছে বই কমে নাই।
তোমার শুভাকাক্সিক্ষনী ভগিনী
রোকেয়া

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২ মে কবি শামসুন্নাহার মাহমুদকে লেখা চিঠি:
¯েœহাস্পদা নাহার,
আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন। গতকল্যকার মিটিং এ যে সব রিজিলিউশান পাশ হইয়াছে তার নকল যদি আজই দিতে পার তো বেশ হয়। কারণ ডি. পি. আই দেখতে চাচ্ছেন। শুভস্য শীঘ্রম।
তুমি আজ ও কাল দুদিন বিশ্রাম করে আগামী পরশু সকাল ৯টা ও ১১টার মধ্যে দয়া করে নিশ্চয় এখানে আসিও। হয়ত খোদা তোমাকে দিয়েই আমার শেষ আকাক্সক্ষা পূর্ণ করিবেন। তাই তোমাকে চাই।
তোমার ¯েœহের
আপা

প্রিয় পাঠক, বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না, মুখের কথায় কাজ হয়নি; নারী শিক্ষা উন্নয়নে মহিয়সী রোকেয়া কতটা আত্মত্যাগ করেছিলেন; কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। শ্রম, ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিজের চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি শ্রমের বিনিময়ে সফলতা কিনে এনেছিলেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন