শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মহীয়সী বেগম রোকেয়া

| প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। রংপুরের পায়রাবন্দের জমিদার সাবের পরিবারে ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। তার পিতা জহির মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাহেব উর্দুভাষী ছিলেন। তার দু’সন্তান খলিলুর রহমান আবু জায়গাম সাবের ও আবুল আসাদ মোহাম্মদ ইব্রাহিম সাবের ও কন্যা করিমুন্নেসা খাতুন ও হোময়রা খাতুন রোকেয়া। পিতা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে দু’পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, কন্যাদের জন্য গৃহে আরবি, ফার্সি ও উর্দু শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। বেগম রোকেয়া পিতার দৃষ্টি এড়িয়ে গোপনে বড় ভাই খলিল সাবেরের কাছে ইংরেজি এবং বড় বোন করিমুন্নেসার নিকট বাংলা শিক্ষা লাভ করেন।
১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুরের এক উচ্চশিক্ষিত, উদারমনস্ক পুরুষ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হলে রোকেয়া সেখানেই চলে যান। রোকেয়ার মতো সৈয়দ সাখাওয়াতও চেয়েছিলেন নারীর মুক্তি, নারী সমাজে শিক্ষা বিস্তার তথা নারী সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি। বেগম রোকেয়ার বিবাহিত জীবনমাত্র ১৩ বছরের। সাখাওয়াত হোসেনের অকাল মৃত্যু হয় ১৯০৯ সালে। অকালেই তাঁদের দুটো কন্যা সন্তানেরও মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাঁর সঞ্চিত টাকা থেকে স্ত্রী রোকেয়ার জন্য দশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখে যান। স^ামীর মৃত্যুর পর ভাগলপুরের বাড়িতেই রোকেয়া মাত্র ৫/৬ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল নামে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তী পর্যায়ে হাইস্কুলে পরিণত হয়। স^ামীর স্মৃতি ও উদ্দেশ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এ নামকরণ করা হয়। কিন্তু নানা কারণে একাকী তাঁর পক্ষে ভাগলপুরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়লে রোকেয়া কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন।
স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকা-ে ব্যস্ত রাখেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।
ইসলাম ধর্মে নারী সমাজের প্রতি উদারতা ও ন্যায়বিচার এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। নারীর অধিকার রক্ষা, ধর্মচর্চা ও ধর্মাদশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কোরআনভিত্তিক সমাজে জ্ঞানার্জন নারী কিংবা পুরুষ কোনও এক সম্প্রদায়ের জন্য সীমিত থাকতে পারে না। ইসলামের শেষ পয়গম্বর প্রত্যেক নর-নারীর জন্য শিক্ষাকে অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এদেশে বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল মুসলমান সমাজকে। মুসলমান নারীর জীবন এমনই করুণ দুর্বিষহ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তাঁরা জানতোই না ইসলাম কত মর্যাদাময় আসনে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ নিশ্চিদ্র অন্ধকারে এ দমবন্ধ পরিবেশে রোকেয়া এনেছিলেন খোলা হাওয়ার পরশ। কাঁপন ধরিয়েছিলেন অচলায়তনে। অচেতন নারীর মধ্যে অধিকারবোধ জাগানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাদের শিক্ষার আলোকে অবগাহন করানোর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, আত্মমর্যাদা জাগরণের প্রেরণা হয়েছিলেন।
মাত্র ষোল বছর বয়সে বিবাহ হয়ে যায় রোকেয়ার বয়সে দ্বিগুণ বড় সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। মাত্র ২৯ বছর বয়সে নিঃসন্তান রোকেয়ার স্বামীর মৃত্যুতে প্রকৃত অর্থেই সব রকম সাংসারিক বন্ধন ছিন্ন হয়। সমস্ত রকম পিছুটানহীন রোকেয়া নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করেছিলেন সামাজিক কুসংস্কারের অবরোধের অচলায়তন থেকে মুসলিম নারীকে মুক্ত করার কর্মযজ্ঞে।
বেগম রোকেয়া বুঝেছিলেন, শতকরা ১০০ জন অশিক্ষিত মুসলিম নারীর মধ্যে জাগৃতি আনতে হলে এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা বিবেচনা করে দেখুন, হযরত মোহা¤মদ (সঃ) তেরশত বৎসর পূর্বে শিক্ষার উপকারিতা সম্বন্ধে কী বলেছিলেন- বিদ্যা শিক্ষা কর, যে বিদ্যা- শিক্ষা করে সে নির্মল চরিত্রের অধিকারী হয়, যে বিদ্যা চর্চা করে সে আমার স্তব করে, যে বিদ্যা অন্বেষণ করে সে উপাসনা করে। ... বন্ধু সভায় বিদ্যা অলংকার স্বরূপ, শত্রু সম্মুখে অস্ত্র স্বরূপ।... যাঁহারা মোহাম্মদের (সাঃ) নামে প্রাণদানে প্রস্তুত হন, তারা তাঁর সত্য আদেশ পালনে বিমুখ কেন? ... কন্যাকে শিক্ষা দেওয়া আমাদের প্রিয় নবী ফরজ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলিয়াছেন, তবু কেন তাঁহার কন্যারা শিক্ষায় উদাসীন’ (মতিচুর ২য় খ-)।
সর্বক্ষেত্রেই রোকেয়া ছিলেন বিপ্লবী-সাহসী। বর্তমান শতাব্দীর শেষ সীমায় আমরা নারীকে কারখানা থেকে কৃষিক্ষেত্র পর্যন্ত কর্মরত দেখতে পাচ্ছি। রোকেয়া শুরুতেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় দুঃসাহসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। কোনও পারিবারিক আনুকূল্য রোকেয়া পাননি। কোনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ রোকেয়ার হয়নি। রোকেয়া নিজেই নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত রোকেয়া ছিলেন একাধিক ভাষায় সুপ-িত। কোন আগুনের পরশমণি এমন একটি প্রতিভার জন্ম দিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। যুগসন্ধির এক কঠিন সময়ে রোকেয়া কোনও সহযোগী ছাড়াই একা এদেশের নারী-জীবনে মুক্তির আলো আনার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রতিভা ছিল বহুমুখী। সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা, কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থা কুটির শিল্পের দুরবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে তিনি সুচিন্তিত ও নিপুণ আলোচনা করেছেন। শুধু নারী হিসাবে তাঁর মূল্যায়নে ত্রুটি থেকে যেতে বাধ্য। তিনি একজন মহান মানুষ- আপসহীন সংগ্রামী।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে সমাজে নারী শিক্ষার অনেকখানি প্রসার ঘটেছে। কিন্তু এতে সন্তুষ্টির অবকাশ নেই। অভিজাত জমিদারিত্বের প্রাচীর আজ ধরাশায়ী কিন্তু অন্তঃপুরের উঠোনে আজও ইসলাম ঘোষিত শিক্ষার আলোকে পৌঁছানো যায়নি। পৌঁছানো যায়নি কারণ, শিক্ষিত হলেও মুক্তবুদ্ধির চেতনা থেকে আজও আমরা বঞ্চিত। শিক্ষিত মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ কোরআন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ভুলে যেতে বসেছেন আর যারা আজও শিক্ষা বঞ্চিত তাদের কাছে এ উন্নত মানসিকতা আশা করা বাতুলতামাত্র। কারণ ইসলাম শিক্ষিতের ধর্ম, মূর্খ-অজ্ঞের ধর্ম নয়। আজও চতুর্দিকে দারুণ হা-হুতাশ ইসলাম ধর্মের জন্য মুসলমান নারীর জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দিয়ে বিখ্যাত হওয়া যাচ্ছে অতি সহজে। কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত গুণ মানুষের জানার আকাক্সক্ষা বাড়ায়, বুদ্ধির মুক্তি ঘটায়। বেগম রোকেয়া সে দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক সঙ্কটের বিচার করতে পেরেছিলেন। সৌন্দর্য ও শালীনতাবোধ এবং জ্ঞান পিপাসা ইসলাম ধর্মের অঙ্গ অশালীন ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনের ছাড়পত্র এখানে পাওয়া যায় না। বেগম রোকেয়া সৌন্দর্য ও শালীনতার একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন; সে সঙ্গে ছিল তাঁর অপরিসীম সম্ভ্রমবোধ। একটি প্রবন্ধে তাই সরাসরি বলতে পেরেছেন, উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ভগ্নীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তাঁরা প্রায়ই বোরখা ছাড়তে বলেন, বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তা কি কেবল বোরকার বাহিরে থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝবে যে, জেলেনী, চামারনী, কি ডুমনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের চেয়ে অধিক উন্নতি লাভ করেছেন? তিনি ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘আমরা অপ্রয়োজনীয় পর্দা রাখব?’ জীবন দর্শনের এ বলিষ্ঠ ভূমিকায় রোকেয়া ছিলেন আপসহীন। পণ্য নয় নারীকে বলিষ্ঠ মানুষের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর সাধনা। কিন্তু অবরোধ বন্দিনী নারী বহি জীবনের মুক্ত প্রাঙ্গণে কি প্রকৃত অর্থে মুক্তি পেয়েছে সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
বেগম রোকেয়া পর্দা প্রথার বিরোধী ছিলেন না; তবে গোঁড়ামির বিরোধী ছিলেন। তিনি উগ্র নারীবাদীদের মতো বোরকা ছিঁড়ে ফেলে দেননি বরং তিনি সমাজের কথা চিন্তা করে বোরকা প্রথা মেনে চলতেন। কেননা তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে আগে জাগিয়ে তোলা। তিনি ‘সওগাত’ সম্পাদককে লেখা চিঠিতে বলেছেন, আমি যে অনিচ্ছাকৃতভাবে অবরোধবাসিনী হয়েছি তার কারণ আছে। আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম-কানুনগুলোও পালন করেছি। অবস্থা এরূপ এখন যে আমি পর্দার আড়ালে থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এটাও হয়তো দোষণীয় হয়ে পড়ছে। আমি বাড়িতে বাড়িতে ক্যানভাস করে মেয়ে আনতে যাই, কিন্তু অভিভাবকরা আমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেন, পর্দাপালন করা হয় কি না? অতটুকু ছোট মেয়ের বেলায়ও এ প্রশ্ন। এখন বুঝুন, কী পরিস্থিতির মাঝে স্কুল চালাচ্ছি, আর ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থাই বা কীরূপ? স্কুলের জন্য আমি সমাজের সকল অবিচার, অত্যাচার সহ্য করেছি। পর্দা প্রথা সম্বন্ধে বোরকা প্রবন্ধে লিখেছেন, আমরা পর্দার অপ্রয়োজনীয় অংশ ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই, রোকেয়া কথাগুলো যে যুগে দাঁড়িয়ে বলেছেন সে যুগে নারীরা, বিশেষত মুসলিম নারীরা ছিলেন অন্তঃপুরচারিণী, অসূর্যস্পর্শা। শুধু সন্তানের জš§ দেওয়া এবং ঘরের অভ্যন্তরীণ কাজ চালানোই ছিল তাদের কাজ। কোনও অভিযোগ কিংবা আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করার কথা চিন্তাই করতে পারতেন না তারা। তার ওপর ছিল যখন তখন তালাক-এর নির্মম আঘাত। এ তালাক প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া তাঁর জীবনের শেষ প্রবন্ধ নারীর অধিকার- এ লিখছেন, আমাদের উত্তরবঙ্গে দেখেছি গৃহস্থ শ্রেণীর মধ্যে সর্বদা তালাক হয়, অর্থাৎ স^ামী স্ত্রীকে সামান্য অপরাধে পরিত্যাগ করে। মেয়েটির কোনও ত্রুটি হলেই স^ামী দম্ভ করে প্রচার করে আমি ওকে তালাক দেব, আজই দেব। এ রকম ঘটনা সবসময়ই ঘটত। রোকেয়ার চিন্তাধারা কত আধুনিক ছিল তার প্রমাণ মিলে নারী সমাজের শৃঙ্খলিত হওয়ার ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি লিখেছেন  আদিমকালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজে বন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোনও অজ্ঞাত কারণবশত মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানা বিষয়ে উন্নতি করতে লাগল, অপর অংশ (নারী) তার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করতে পারল না বলে পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিণী না হয়ে দাসি হয়ে পড়ল। আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলংকারগুলো এগুলো দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ।
বেগম রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ হল মতিচুর (১ম ও ২য় খ-), পদ¥রাগ, অবরোধবাসিনী এবং সুলতানার স^প্ন তার উল্লেখযোগ্য রচনা। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ হল বাসিফু, শশধর, নলিনী ও কুমুদ কাঞ্চনজঙ্খা, আপীল, চাঁদ ইত্যাদি। এ ছাড়া নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে পদ¥রাগ নামে একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন রোকেয়া। ষোলটি প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়। তার প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষার আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না তা বলেছেন। ১৯১৬ সালে তিনি নারীদের সচেতন ও সংগঠিত করার জন্য আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম নামে নারী সমিতি গঠন করেন। তাঁর সমিতিতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। সমাজের উঁচু তলার, লেডি ফারুকি, লেডি অবলা বসু যেমন এ সংগঠনের সদস্য ছিলেন তেমনি সমাজের অবহেলিত অশিক্ষিত নারীরাও ছিলেন। তাই শতাব্দী পার হয়েও বেগম রোকেয়ার জীবন দর্শন আজও নারী জীবনে এক অবিসংবাদী, প্রেরণাদায়ী সত্তা। তাঁর জীবনদর্শনে কোনও মোড়ক ছিল না, ছিল না কোনও লোক প্রদর্শনকারী উপাধি। তাঁর জীবনাদর্শ ছিল একান্ত সহজাত, আন্তরিক। কথায় ও কাজে তাঁর কোন ফারাক ছিল না। তাঁর চিন্তা, মন ও জীবনযাপন ছিল এক সূত্রে গ্রন্থিবদ্ধ। সেজন্যই বেগম রোকেয়ার জীবনাদর্শন সর্বকালে বরেণ্য- কালোত্তীর্ণ তিনি।
বাংলার নারীজাগরণের প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা বেগম রোকেয়ার জীবনদীপ নির্বাপিত হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ঊষালগ্নে। ৮ ডিসেম্বর রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি নিমগ্ন ছিলেন লেখাপড়ায়। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। ইহজীবনে সব অবহেলাকে হেলায় জয় করেছিলেন রোকেয়া। মৃত্যুতেও আপন সৃষ্টির মাঝেই তিনি অমলিন। রোকেয়ার মৃত্যুর পর ১১ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে এক বিরাট শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসন এক শোকবার্তায় তাঁকে pioneer of higher education among Muslim girls in this province বলে আখ্যায়িত করেন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন