(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কাদম্বিনী বসুর সঙ্গে মেডিকেল কলেজে আরও দুজন মেয়ে ডাক্তারি পড়তেন। তাঁরা হলেন ভার্জিনিয়া মেরী মিত্র ও বিধু মুখী বসু। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রথম এমবি পরীক্ষায় ভার্জিনিয়া প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিধু মুখী ও এমবি পরীক্ষায় পাশ করেন। এই এমবি পরীক্ষায় কাদম্বিনী বসু (১৮৬১-১৯২৩ খ্রি.) অকৃতকার্য হন। ঐ সময় ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বেথুন স্কুলে মুসলিম মেয়েদের পড়ার অনুমতি ছিলনা (তথ্যসূত্র: মালেকা বেগম, বাংলার নারী আ’েদালন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পৃষ্ঠা নং ৪৭)।
আধুনিককালে প্রথম মুসলমান লেখিকা কে ? আমরাও সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারিনা। কিন্তু বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) অথবা ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নওয়াব (১৮৩৪-১৯০৩ খ্রি.) যে নন, তা’ নি:স’েদহে বলা যায়।
খো’দকার শামসুদ্দীন মুহম্মদ সিদ্দিকীর “উচিত শ্রবণ” অর্থাৎ “পারমার্থিক ভাব” (১৮৬০ খ্রি.) গ্রন্থকে প্রথম মুসলমান লিখিত গদ্যগ্রন্থ বলে দাবি করা হয়। এটি প্রকাশিত হয়েছিল উমেশ চ’দ্র দত্ত সম্পাদিত কলকাতার “বামা বোধিনী” পত্রিকায়।
খো’দকার শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিদ্দিকী (১৮০৮-১৮৭০ খ্রি.) বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে “ভাবলাভ” নামে তাঁর একটি কবিতা পুস্তক প্রকাশিত হয়। এসময় উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যিক চুড়ামনি মীর মোশারফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২ খ্রি.) বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। ১২৭১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে (এ হিসেব মতে ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এক পূর্ব পুরুষ মুন্সী বশারতুল্লাহ খো’দকার শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিদ্দিকী কর্তৃক রচিত “উচিত শ্রবণ” নামক একটি বই নকল করেন। খুব সম্ভব কোন মুদ্রিত পুস্তক থেকেই এটি নকল করা হয়েছিল। “উচিত শ্রবণ” (অর্থাৎ “পারমার্থিক ভাব”) একটি ধর্মপুস্তক। ইষঁব যধৎফ’ং পধঃধষড়মঁব ড়ভ ইবহমধষর ঢ়ৎরহঃবফ ইড়ড়শং রহ ঃযব খরনৎধৎু ড়ভ ঃযব ইৎরঃরংয গঁংবঁস থেকে জানা যায় “উচিত শ্রবণ” ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৬৬। ধর্মীয় বিষয়বস্তু ও গুঢ়তত্ত¡ বিষয় আলোচনা ছিল বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মীর মোশারফ হোসেনের প্রথম বই “রতœাবতী” প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। তারও বহু আগে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে “উচিত শ্রবণ” প্রকাশিত হয়েছিল। খো’দকার শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিদ্দিকীই যে প্রথম বাঙালি মুসলান গদ্য লেখক এ থেকে তা’ প্রমাণিত হয়।
জেনে রাখা ভালো বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের যুগে আরও দু’জন মুসলমান লেখকের নাম পাওয়া যায়। তাঁদের একজন গোলাম হোসেন এবং আর একজন শেখ আজিমউদ্দীন। তাঁরা উভয়েই পশ্চিমবঙ্গের লোক। গোলাম হোসেন “হাড় জ্বালানী” নামক একটি নক্সা জাতীয় রচনা লেখেন। “হাড় জ্বালানী” ১৬ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা। এটি ১২৭১ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে “কলিকাতা গরণ হাটা ষ্ট্রীটের ৯২ নং ভবনে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত হয়। শাশুড়ী বউয়ের ঝগড়া চিরন্তন। এই চিরন্তন বিষয় নিয়ে এ ক্ষুদ্র নক্সাটি রচিত। এতে লেখকের সমাজ সচেতনতার ছাপ সুস্পষ্ট।
শেখ আজিম উদ্দিন এর “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে” ও ১৬ পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র প্রহসন। বইটি ১২৭৫ বঙ্গাব্দের ৩’রা জৈষ্ঠ ইংরেজী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা গরণ হাটা ষ্ট্রীটে ২৬৮ নং ভবনে শ্রী কালিনাথ শীলের জ্ঞান দ্বীপক যন্ত্রে শ্রী সিদ্ধেশ্বর ঘোষ দ্বারা দ্বিতীয়বার মুদ্রিত হয়। সম্ভবত বছর খানেক পূর্বে এটি প্রথমবার মুদ্রিত হয়েছিল। “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে” মাইকেল মধুসূদনের (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.) “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো” (১৮৬০ খ্রি.) এবং দীন বন্ধু মিত্রের (১৮৩০-১৮৭৩ খ্রি.) “বিয়ে পাগলা বুড়ো”র (১৮৬৬ খ্রি.) মতো সমাজ সচেতন প্রহসন। আজিম উদ্দীনের “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে” গদ্যে-পদ্যে রচিত হলেও পদ্যের তুলনায় গদ্যের ভাগ বেশি।
গোলাম হোসেনের “হাড় জ্বালানী”র প্রকাশকাল ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। আজিম উদ্দীনের “কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে”র প্রকাশকাল ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। খো’দকার শামসুদ্দীন মুহম্মদ সিদ্দিকীর “উচিত শ্রবণ” প্রকাশিত হয় এগুলোর বহুপূর্বে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে। সুতরাং খো’দকার শামসুদ্দীনই প্রথম বাঙালি মুসলমান গদ্য লেখক সে বিষয়ে কোন স’েদহ নেই। সেই অন্ধকার যুগে বাঙালি মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে এঁরাই যে আমাদের সাহিত্য সাধনার পথ দেখিয়ে গেছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
তবে এক্ষেত্রে আরেকজনের নাম উল্লেখ করতে হয় তাঁর নাম শিমুয়েল পির বক্স। নাম দৃষ্টে মনে হয় যে ভদ্রলোক একসময় মুসলমান ছিলেন পরে ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হন। তাঁর খ্রিষ্টান হওয়ার সার্থকতার পরিচয় পাওয়া যায় “খ্রিষ্টীয় গীত সংহিতা”র একটি সংস্করণ সম্পাদনা করার মধ্যে দিয়ে। পির বক্স “বিধবা বিরহ নাটক” নামে একটি সামাজিক নক্সা-জাতীয় নাটক রচনা করেছিলেন। নাটকটি ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বিধবা-বিবাহের উদ্দেশ্য নিয়ে নাটকটি রচিত হয়। ছয় অঙ্কে সমাপ্ত নাটকটিতে তৎকালীন হি’দু সমাজ-জীবনের যে চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে, তাতে নাট্যকারের বাস্তব-সচেতনতা অসঙ্কোচে প্রকাশ পেয়েছে। নাটকের বিধবা নায়িকা মনোমোহিনী তাঁর অতিবৃদ্ধ কামাতুর পিতার বিবাহ প্রবৃত্তি দেখে এবং আপন যৌবনের ব্যর্থতার কথা ভেবে অসহিষ্ণু হয়ে কুল ত্যাগ করে। এ ঘটনাটিকেই পল্লবিত করে নাটকটি রচিত হয়েছে। নাট্যকার স্থানে স্থানে সংলাপ-রচনার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেহেতু শিমুয়েল পিরবক্স খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তাই তাঁর গ্রন্থকে মুসলমান গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবেনা।
উনিশ শতকের দিকে নারী শিক্ষার প্রতি সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিকুল পরিবেশের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। ফলে কিছু সংখ্যক হি’দু মহিলা এ সময় সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে রাস সু’দরী দেবী, বামা সু’দরী দেবী, হরকুমারী দেবী, কৃষ্ণকামিনী দাসী, কৈলাস বাসিনী দেবী, কৃষ্ণ ভাবিনী দাসী, জ্ঞানদান’িদনী দেবী, স্বর্ণ কুমারী দেবী, গিরি’দ্র মোহিনী দাসী, প্রসন্ন ময়ী দাসী, কুমুদিনী বসু, ই’িদরা দেবী প্রমুখ মহিলার নাম উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু পুরো উনিশ শতকে মাত্র সাতজন মুসলিম মহিলার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে চারজনের রচনা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এরা হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধূরানী, হাজী সহিফা বিবি, আজিজননেসা খাতুন ও খায়রুন্নেসা খাতুন। অন্য তিন মহিলা রচনা বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এদের মধ্যে বিবি তাহেরনন্নেসা, ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করে বামাবোধিনী পত্রিকায় একটি পত্র লিখেছিলেন। এরপর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের অছিমন্নেসা খাতুন সিদ্দিকার “শরৎ যামিনী” নামের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো। বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদক কবিতার শেষে মুসলিম মহিলার বাংলাভাষায় কবিতা চর্চায় আন’দ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের লতিফুন্নেসার বঙ্গীয় “মুসলিম মহিলার প্রতি” শীর্ষক একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত তিনিই ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন (ঝড়হরধ ঘরংযধঃ, ঞযব ড়িৎষফ ড়ভ গঁংষরস ডড়সবহ ঈড়ষড়হরধষ ইবহমধষ. ১৮৭৬-১৯৩৯, ঘবি ুড়ৎশ; ঊ.ঔ. ইজওখখ, ১৯৯৬, চ.২১৫)।
এই গুটিকয়েক মুসলিম মহিলার এ সামান্য সাহিত্য সৃষ্টি সমগ্র উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম মহিলার সাহিত্য সাধনারূপে বিরাজ করছে।
খো’দকার শামসুদ্দীন মুহম্মদ সিদ্দিকীর “উচিত শ্রবণ” অর্থাৎ “পারমার্থিকভাব” (১৮৬০ খ্রি.) গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পাঁচ বছরের মধ্যে বিবি তাহেরন নেসা নামক একজন মুসলমান মহিলার রচিত একটি গদ্য নিবন্ধ বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই মহিলাকেই সম্ভবত প্রথম মুসলমান গদ্য লেখিকা বলে আখ্যায়িত করা যায়। তাঁর পিতার নাম ছিল মুন্সি মোহাম্মদ তরিকুল্লাহ। তাঁর ১২ জন ছেলে মেয়ের মধ্যে একমাত্র কণ্যা ছিলেন তাহেরন নেসা। তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চ’দনবাড়ী গ্রামে। রংপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট ও বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কোরানের বাংলা অনুবাদক খান বাহাদুর তসলিম উদ্দিন (১৮৫২-১৯২৭ খ্রি.) ছিলেন তাঁর আপন ভাই। বিবি তাহেরণ নেসার পুত্র ছিলেন দিনাজপুরের প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট ও বি.এল উকিল খান বাহাদুর একিন উদ্দিন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩ খ্রি.) (সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন