দেশ থেকে ক্রমাগতভাবে অর্থপাচারের ঘটনা নতুন নয়। দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে পাচারকারিরা প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এর কোনো প্রতিকার নেই এবং কার্যকর কোনো উদ্যোগও লক্ষ্যণীয় নয়। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, জাতীয় নির্বাচনের বছরে অর্থ পাচার লাগামহীন হয়ে পড়বে। পাচারের সঙ্গে জড়িতরা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ত। ফলে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন না হওয়ায় তারা নির্বাধে টাকা পাচার করে দিতে পারছে। দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্জিত এসব অর্থ পাচার ঠেকাতে এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গেøাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকা। এর সাথে পরবর্তী তিন বছর অর্থাৎ ২০১৭ সাল যুক্ত করলে পাচারের অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ১ হাজার ২৪৩ কোটি ডলার বা ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে বিদেশ থেকে যে বিনিয়োগ এসেছে, তার ৬ গুণের বেশি পাচার হয়ে গেছে। অর্থ পাচারের তথ্য এসেছে জাতিসংঘের ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকেও। অর্থ পাচার প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, তেমনি সরকারেরও কোনো বিচলন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমনকি অর্থ পাচারের সাথে জড়িতদের অনেকে চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
সরকার প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বললেও দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচারের ফলে অর্থনীতি যে দুর্বল হয়ে পড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন সাধারণ মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে যদি পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে এবং বিপুল অর্থ পাচার হয়ে যায়, তাহলে উন্নয়নের বিষয়টি অসার কথাবার্তা ছাড়া কিছু নয়। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশ ছাড়ার আগে দুর্নীতিবাজরা তাদের বেশিরভাগ অর্থ বিদেশ নিয়ে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, এই পাচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। তারা পাচারকৃত অর্থ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছে। বিদেশে অ্যাপার্টমেন্ট ও মার্কেট কেনাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। কানাডায় গড়ে তুলেছে বেগম পাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম। মালয়েশিয়া সরকারের হিসাব মতে, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। সাধারণত বিদেশে টাকা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন লাগে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ থেকে যে বিনিয়োগ হয়েছে, তার বেশিরভাগের কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি। ফলে এ অর্থ যে পাচারকৃত তা নিশ্চিত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ পাচারের পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েস, দুর্নীতি, কর ফাঁকি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলেও নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে তা উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। বিনিয়োগের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তার প্রকট সংকট রয়েছে। বিগত প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ অত্যন্ত নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। এ থেকে কোনোভাবেই উত্তরণ ঘটানো যাচ্ছে না। এমনকি দেশের বড় বড় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকায় আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতিবাজরা অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ায় নিজেদের ও অর্থের নিরাপত্তার জন্য অর্থ পাচারসহ দেশ ত্যাগে প্রস্তুত থাকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ পাচার ঠেকানোর বেশি দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। এ প্রতিষ্ঠানটির একটি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের নজরদারির জন্য আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা দরকার। অর্থাৎ সর্ষের ভেতরেই ভূত রয়েছে। এ পরিস্থিতি হলে অর্থ পাচার রোধ হবে কীভাবে। দুর্নীতি দমন কমিশনও অর্থ পাচার রোধে ব্যর্থ হচ্ছে। মুখে বড় বড় কথা বললেও ক্ষমতার কাছাকাছি ও প্রভাবশালী কালো টাকার মালিক এবং দুর্নীতিবাজদের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। ক্ষমতার অপব্যবহারের কাছে সংস্থাটি অসহায় হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্নীতিবাজ ও কর ফাঁকিবাজরা নির্বিঘেœ বিদেশে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে।
যারা অর্থ পাচার করছে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন কিছু নয়। এটি ওপেন সিক্রেট। তাদের আয় ও অর্থের উৎস সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলে সহজেই তা ধরা পড়ার কথা। প্রয়োজন হচ্ছে এ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সততা ও আন্তরিকতা। এক্ষেত্রে সরকারকেও জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা জরুরী। দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই তা সরকারকে করতে হবে। দেশ থেকে যদি এভাবে অর্থ পাচার হয়ে যায়, বিনিয়োগ না হয়, তবে উন্নয়নের কথা বলা অর্থহীন ও অবিশ্বাসযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছি, লাল লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেলে সে স্বপ্নপূরণ যে সুদূর পরাহত হয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। যে হারে অর্থ পাচার হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে দেশ ‘শূন্য ঝুড়িতে’ পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। একদিকে অর্থ পাচার ঠেকাতে হবে, অন্যদিকে অর্থ বিনিয়োগের সুব্যবস্থাও করতে হবে। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম কারণ বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ করে দেয়া। আমাদের দেশেও অর্থ পাচার ঠেকাতে নির্ভয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অবারিত এবং বিনিয়োগের পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। দেশের টাকা যাতে দেশে থাকে এ ব্যবস্থা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন