মাদরাসা কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি
নাছিম উল আলম : ‘দেশের পীর-মাশায়েখ, আলেম সমাজ এবং মাদরাসা শিক্ষকরা জঙ্গীবাদ বিরোধী অবস্থানে থেকে নিষ্ঠার সাথে সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন’ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন। তিনি বলেছেন, ইসলাম কখনো জঙ্গীবাদ সমর্থন করেনা বা লালন করেনা। জঙ্গীবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। দেশের অভ্যন্তরে কিছু অঘটনের পর বিদেশীরা যখন জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদের প্রচারণা শুরু করে; তখন আমরাই প্রথম জঙ্গী বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছি। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ব্যানারে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে সভা সমাবেশ-মিছিল করেছি। গতকাল বরিশাল মহনগরীর সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বিভাগীয় আঞ্চলিক প্রতিনিধি সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। দৃঢ়তার সাথে তিনি আরো বলেন, জঙ্গীবাদ নিয়ে মাদরাসার বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালিয়েছে এখন তারা হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। জঙ্গীবাদের ‘প্রকৃত চিত্র’ উঠে আসায় পশ্চিমাদের অপপ্রচারে সুর মিলিয়ে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা থেকে এখন তারা নিশ্চয়ই সরে আসবেন। তিনি বলেন, জমিয়াতুল মোদার্রেছীন দেশ ও সমাজে ইসলামী ঈমান-আকিদাসহ ধর্মীয় আদর্শ এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষা উন্নয়নে কাজ করছে। আমরা শুধু মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি বা শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কাজ করছি না; বরং দেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা উন্নয়নেও আমাদের ভ‚মিকা রয়েছে।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক প্রতিনিধি সম্মেলন শুরু হয়। ইবতেদায়ী থেকে কামিল পর্যন্ত সকল মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আয়োজিত এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন বরিশাল মহানগর সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আবদুর রব। প্রতিনিধি সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব মাওলানা সাব্বীর আহমদ মোমতাজী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ খলিলুর রহমান নেছারাবাদী। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা আবু সাইয়্যেদ কামেল কাওসার। আন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান, বরিশাল মহানগর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মো. নজরুল ইসলাম, মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মো. রফিকুল ইসলাম, পটুয়াখালি জেলা সভাপতি আলহাজ মাওলানা আবদুল হান্নান আজিজী, সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মাহমুদ ওমর জিয়াদ, মুলাদী উপজেলা সভাপতি মাওলানা মো. মহিউদ্দিন আহাম্মেদ, পিরোজপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মাওলানা মো. ফারুক আহাম্মদ, ভোলা জেলা সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মোবাশ্বেরুল হক নাইম, বরগুনা জেলা সহ সভাপতি মাওলানা মামুনুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মাওলানা হারুন, ঝালকাঠি জেলা সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ প্রমূখ। সম্মেলনে দোয়া-মোনাজাত পরিচালনা করেন সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আলহাজ হযরত মাওলানা মোহাম্মদ খলিলুর রহমান নেছারাবাদী।
এর আগে প্রধান অতিথি জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন সম্মেলন স্থলে পৌঁছিলে পটুয়াখালী-পিরোজপুর-বরিশাল-ভোলা-বরগুনা-ঝালকাঠি জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত বিপুল সংখ্যক মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারী শ্লোগানে শ্লোগানে উচ্ছাস প্রকাশ করে তাকে স্বাগত জানান। মঞ্চে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রধান অতিথিকে পুস্পস্তবক উপহার দিয়ে বরণ করে নেন। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতিকে কাছে পেয়ে উপস্থিত দক্ষিণাঞ্চলের আলেম-ওলামা-শিক্ষকরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁকে এক নজর দেখা এবং অতিথির সঙ্গে কথা বলার জন্য তৌহিদী জনতার ভীড় ঠেলে কাছে আসেন। মাদরাসা শিক্ষার উন্নতি এবং শিক্ষকদের মর্যাদা আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য প্রধান অতিথির প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনেকেই প্রধান অতিথির পিতা মরহুম হজরত মাওলানা এম এ মান্নান (রাহ.) মাদরাসা শিক্ষায় অবদানের কথা স্মরণ করেন।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মত শৃঙ্খলাবোধ এবং দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশের আর কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের নেই। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন দেশে কখনো জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসবাদের উত্থান হতে দেবে না। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা এবং পশ্চিমাদের ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ইসলামের নাম করে বাংলাদেশে কিছু অঘটনের পর বিদেশীরা যখন জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদের প্রচারণা শুরু করে; তখন আমরাই প্রথম জঙ্গী বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছি। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ব্যানারে মাদরাসার শিক্ষকরা টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সভা সমাবেশ-মিছিল করেছে। পীর মশায়েখগণ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের মূল চেতনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। শহর থেকে গ্রামের মসজিদের ইমামরা নৈতিক দায়িত্ব থেকেই মসজিদে মসজিদে খুদবায় জঙ্গী বিরোধী অবস্থান তুলে ধরে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্পর্কে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের এই সভাপতি বলেন, ইনশাআল্লাহ মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের পর্যায়ক্রমে সকল দাবি-দাওয়াও পূরণ হবে। পাবলিক ও ভর্তি পরীক্ষায় নকল, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অনিয়মসহ নানামুখী স্ক্যান্ডালের কারণে দেশের শিক্ষক সমাজের সম্মান কমে গেছে। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষকদের সম্মান বেড়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো মাদরাসা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর নেই। মাদরাসার ছাত্র হিরোইন-গাজা খায় এমন তথ্য নেই। জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মাদরাসা শিক্ষকদের সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক কথা বলেছেন। সুতরাং আমাদের অধৈর্য হওয়ার কারণ নেই। তাছাড়া বর্তমান সরকার মাদরাসা শিক্ষকদের বিষয়টি বেশ জোড়ালো ভাবেই দেখছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন উল্লেখ করে ইসলামী চিন্তাবিদ এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই জমিয়াতুল মোদার্রেছীন দলমত নির্বিশেষে মাদারাসা শিক্ষকদের ভাগ্যের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ সংগঠন কখনো কোন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেনি; কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করেনি। ভবিষ্যতেও আমরা কারো লেজুরবৃত্তি করবো না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ মোস্তফা কামালকে মাদরাসা শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবির বিষয়টি ইতোমধ্যেই অবহিত করা হয়েছে। তিনি সমাবেশে উপস্থিত সকলকে মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়নসহ সামগ্রীক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা সাব্বীর আহমদ মোমতাজী বলেন, সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে। সবার একটাই লক্ষ্য দেশের মাদরাসাগুলোয় মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে তার প্রতি সর্ব্বোচ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাদরাসা শিক্ষিতরা যেন সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রাধান্য লাভ করতে পারে। অন্যান্য বিষয়ের সাথে আরবি, ইংরেজি এবং তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের সাথে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে যাবার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, মাদরাসায় পড়বে অথচ আরবিতে কথা বলতে পারবে না এটা দুর্ভাগ্যজনক। মধ্যপ্রাচ্যে আরবি জানাওয়ালাদের চাকরির ক্ষেত্রে কদর রয়েছে। ইংরেজির কদর বিশ্বজুড়ে। মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি এ দুটো ভাষার বিষয়ে যত্মবান হবারও পরামর্শ দেন তিনি। মহাসচিব উপস্থিত শিক্ষকদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনারাই একটু ভেবে দেখুন আগে মাদরাসা এবং এর শিক্ষা ব্যবস্থার কি হাল ছিল, আর এখন কি হয়েছে। আসমান জমিন-ফারাক। এর অন্যতম কারণ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সঠিক দিক নির্দেশনা। যার কারণে অন্যদের মত মাদরাসা শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা এখন মাথা উঁচু করে চলতে পারে। শিক্ষকদের আর হেয় হতে হয় না। জীবনযাত্রার মানও আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। আরো ভাল করার জন্য জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কাজ করে যাচ্ছে। তিনি এজন্য সকল মাদরাসা শিক্ষকদের সহযোগিতা কামনা করে নিজেদের কল্যাণের জন্য সকলকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান।
মহাসচিব মোমতাজী বলেন, মাদরাসা শিক্ষকদের মানুষ অত্যন্ত সম্মান করে। হুজুর বলে সম্বোধন করে। কারণ আমরা মাদরাসাগুলোতে আদর্শ মানুষ বানানোর কারিগর হিসেবে কাজ করছি। আমাদের এ সম্মান ধরে রাখতে হবে। লেবাসে সুরতে ও ব্যবহারেও তার প্রতিফলন জরুরি। তিনি মাদরাসা শিক্ষক মন্ডলীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আমরা যে আদর্শ নিয়ে কাজ করছি তা থেকে যেন বিচ্যুত না হই। আমাদের অঙ্গীকার থাকতে হবে আদর্শ মানুষ গড়ার। আদর্শ মানুষ করতে পারলে আদর্শ নাগরিক পাব। আর দেশটাও ভাল মানুষের দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, প্রত্যেক মাদরাসায় লাইব্রেরী থাকতে হবে। আদর্শ মানুষ গড়তে হলে পড়াশোনার বিকল্প নেই এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলকে বই পড়ার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ, চাকরি মেয়াদকাল ৬০-৬৫ বছর করা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মত ইবতেদায়ী শিক্ষার্থীদের সকল সুবিধা প্রদানেরও জোর দাবি জানান। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন