হাসান সোহেল : দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যা নেপাল। পাহাড় ঘেরা দেশটির গোটা অর্থনীতিই আমদানি নির্ভর। বাজারটি এতোদিন ভারতের দখলে থাকলেও গত কয়েক বছরে ভাগ বসিয়েছে বাংলাদেশ। নেপালের বাজারে খাদ্যপন্য, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, ফার্নিচার ও ওষুধ যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। এছাড়া উভয় দেশের সরকারের ব্যবসা-বান্ধব নীতি বিশেষ করে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধিসহ দূরদর্শী পদক্ষেপের ফলে নেপালের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব কারনে নেপালে বাংলাদেশের পণ্যের আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া খুব শিগগিরই নেপালে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এখন দ্রæত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ হতে যাচ্ছে। এই সুযোগ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাও নিতে পারে। সম্প্রতি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের কার্যালয়ে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
দৈনিক ইনকিলাব : বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেমন ?
মাশফি বিনতে শামস : নেপাল-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই ভাল। এখানে বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও অনেক বেশী। সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর দেশ নেপাল। অভ্যন্তরীণ চাদিদার ৯০ শতাংশ পণ্যই আমদানি করতে হয় তাদের। যার অধিকাংশই আসে ভারত ও চিন থেকে। ভারত থেকেই আমদানি করা হয় ৭০ শতাংশ। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে কমই আমদানি হচ্ছে। যাকে এক কথায় ‘সম্ভাবনার তুলনায় কম’ বলা যেতে পারে। আমরা চাইলে নেপালের চাহিদার একটি বিরাট অংশ মেটাতে পারি। খাদ্য, প্লাস্টিক, ব্যাটারি, কনস্ট্রাকশন ম্যাটারিয়ালস, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স, মোটর সাইকেল, মেলামাইন-সিরামিক, ফুটওয়্যার ও তৈরি পোশাক খাতে বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। ভাল মানের গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাকের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে নেপালে। তিনটি এয়ারলাইন্স এখানে নিয়মিত সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফ্লাইট রয়েছে। কোনো দিন একাধিক ফ্লাইটও থাকছে। অনএরাইভাল ভিসা সুবিধা থাকায় অনেকেই আসছে।
দৈনিক ইনকিলাব : ট্যুরিজম নির্ভর দেশ হিসেবে নেপাল থেকে কি কোন সুবিধা নেওয়া যায়?
মাশফি বিনতে শামস : এখানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম নিয়ে প্রচারণা করা যায়। হিমালয় দেখতে বা এভারেস্ট জয় করতে সারাবিশ^ থেকে ট্যুরিস্ট আসে এখানে। বাংলাদেশে রয়েছে বিশে^ সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, পাশাপাশি বিশে^র সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের একটি অংশ এখানে রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন মন্ত্রণালয় ও করপোরেশন কাজ করতে পারে। দূতাবাস থেকে বিভিন্ন সময়ে কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ট্যুরিজম কোম্পানিগুলোকে নিয়ে সেমিনারও করা হয়েছে। তবে মূল কাজটি পর্যটন মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে। সেক্ষেত্রে দূতাবাস সার্বিক সহযোগিতা করবে।
দৈনিক ইনকিলাব : রপ্তানি বাণিজ্য সম্পর্কে বলুন ?
মাশফি বিনতে শামস : বাংলাদেশ থেকে চার বছর আগেও ১০ মিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি হতো। যেটি এখন প্রায় ৪৭ মিলিয়ন ডলার। গত তিন বছর ধরে এখানে দূতাবাসের পক্ষ থেকে একক বাংলাদেশী মেলার আয়োজন করছি। যাতে রপ্তানি বাড়াতে কাজ করছে। ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি থেকে ৪র্থ বাংলাদেশ মেলা হবে। পাঁচ দিনের এ মেলায় অর্ধশতাধিক বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান আসবে বলে আশা করছি। যেটি বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখছে।
দৈনিক ইনকিলাব : বাংলাদেশের ইমেজ বাড়াতে দূতাবাসের পক্ষ থেকে কি ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
মাশফি বিনতে শামস : আমার মনে হয় এখানে বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দূতাবাস থেকে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ২১ ফেব্রæয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে নিয়তিম অনুষ্ঠান হয়। ফটো এক্সিবিশন ও ফুড ফেস্টিভালের আয়োজন করা হয়। এছাড়া প্রবাসীদের কমিউনিটি থেকে ঈদ পূর্ণমীলনীসহ অনেক গেট টুগেদার অনুষ্ঠান হয়। এছাড়া বিভিন্ন চেম্বার ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাণিজ্য সম্প্রসারনের জন্য কথা বলেছি। সেমিনারের আয়োজন করেছি। মিডিয়াতে কথা বলেছি। যার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও ভাল হবে। এছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক ছাত্র বাংলাদেশে যাচ্ছে। তাদের ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দালালমুক্ত করেছি দূতাবাসকে। যার ফলে এখন প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয় শতাধিক ছাত্র যাচ্ছে। প্রধানত মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেই বেশী ছাত্র যায়।
দৈনিক ইনকিলাব : বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নেপালে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে কি ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?
মাশফি বিনতে শামস : বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে স্থলপথে পণ্য রপ্তানিতে অনেক জটিলতা ও ঝামেলা রয়েছে। ভারতের ভেতর দিয়ে পণ্য যাতায়াতে ভারত ঝামেলা সৃষ্টি করে। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই ভুল। বাংলাবান্ধায় নেপালের ওয়্যার হাউস আছে। সেখান থেকে সরাসরি কাঠমান্ডুতে পণ্য চলে আসতে পারে। মাঝে ভারত কোনো চেক আপ করে না। এছাড়া বাংলাদেশিদের ধারণা নেপালের মানুষের মাথাপিছু আয় কম। এজন্য নেপালে ব্যবসা ভালো হবে না। কিন্তু নেপালীরা সৌখিন জীবন যাপন করেন। তারা ভালো পণ্য কেনেন। এখানে মান সম্পন্ন পণ্যের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি পণ্য এখানে প্রতিযোগীতায় সক্ষম। কিছু কিছু বাংলাদেশি পণ্য এখানকার মানুষের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশী পণ্য সম্পর্কে তাদের ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ৭৮ টি পণ্য নেপালে বিক্রি হচ্ছে। এক সময় প্রতি বছর শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ পাট বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসতো। আমরা এখানে সিঙ্গেল কান্ট্রি এক্সপোর আয়োজন করছি। ব্যবসায়ীদের এখানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনারা এখানে আসুন, আমরাই গ্রাহক ধরিয়ে দিব।
নেপালে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এখন দ্রæত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ হতে যাচ্ছে। এই সুযোগ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা নিতে পারে। বাংলাদেশি পণ্য এখানে প্রতিযোগীতায় সক্ষম। নেপালীদেরও ধারণা নেই বাংলাদেশি পণ্য সম্পর্কে। তবে এই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। দেশটিতে প্লাস্টিক পণ্যের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ আমরা বাজারে গিয়ে দেখেছি, ভালো একটা টিফিন বক্স এখানে পাওয়া যায় না। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সিরামিক ও হোম টেক্সটাইল পণ্য যা এখানে বিক্রি হয় তা মানে নিম্নমানের হলেও দাম অনেক বেশি। এগুলোই আমাদের জন্য সুযোগ। সা¤প্রতিক বড় ভূমিকম্পের পর প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিংয়ের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে নির্মাণ সামগ্রীর বড় বাজার তৈরি হয়েছে এখানে। এটিও আমাদের জন্য সম্ভাবনা।
দৈনিক ইনকিলাব : নেপালের অধিকাংশ চিকিৎসক বাংলাদেশ থেকে পড়ালেখা করে এসেছে, এ খাতে সম্ভাবনা কেমন বাংলাদেশের?
মাশফি বিনতে শামস : মেডিক্যাল পড়তে নেপালী শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ। প্রতি বছর কয়েকশ’ শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে মেডিক্যাল ডিগ্রী নিয়ে নেপালে ফিরে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন। এতে করে নেপালে দ্রæত বাংলাদেশী ওষুধের বাজার স¤প্রসারণ হচ্ছে। বাংলাদেশের ৮টি ওষুধ কোম্পানী নেপালে ওসুধ রপ্তানি করছে। একই সঙ্গে নেপালের অনেক ডাক্তার বলছেন, বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের গুণগুতমানও অনেক ভাল। ###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন