শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

নির্বিচারে পাহাড় কাটা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৮ এএম, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

সিডিএ কাটছে ছোটবড় ১৫টি : পরিবেশ বিপর্যয়েও নির্বিকার প্রশাসন
বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে থামছে না পাহাড় কাটা। বেপরোয়া পাহাড়খেকো ভূমিদস্যুদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তারা প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে মাটি লুট করছে, জমি দখল করে গড়ে উঠছে অবৈধ বসতি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএসহ বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও পাহাড় কর্তনের অভিযোগ উঠেছে। সিডিএ একটি সড়কের জন্য অন্তত ১৫টি পাহাড় নিধনের আয়োজন করেছে। নির্বিচারে পাহাড় কর্তনের ফলে এই অঞ্চলে প্রতিবছরই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। আর তাতে ঘটছে গণমৃত্যুর ঘটনা। গেল বছরের দুই দিনের ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ এই অঞ্চলে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড় ধসে সড়ক অবকাঠামো, বসতবাড়িসহ সহায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড় নিধন ঠেকানো না গেলে পরিবেশে মহাবির্পযয় নেমে আসবে। বাড়বে পাহাড় ধসে প্রাণ ও সম্পদহানীর ঘটনা।
নগরীর প্রাণ কেন্দ্রে পাহাড় নিধন চলছে প্রকাশ্যে। ভবন নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন কাজের অজুহাতে এসব পাহাড় কেটে মাটি লুট এবং সরকারী জমি দখলে নেয়া হচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। প্রশাসন কিছু উদ্যোগ নিয়েও থামছে না পাহাড়খেকোদের তৎপরতা। গত সোমবার পাহাড় কাটার দায়ে খুলশী ক্লাবকে দুই লাখ জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে জরিমানার টাকা জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসাথে পাহাড় কর্তন বন্ধ রাখারও নির্দেশনা দেয়া হয়। জানা গেছে, ওই নির্দেশনার পরও সেখানে পাহাড় কাটা চলছে। নগরীর ফয়’স লেক আনসার ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়টি কেটে সমতল করে ফেলে খুলশী ক্লাবের নিয়োজিত শ্রমিকেরা। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা খন্দকার মোঃ তাহাজ্জুত আলী সরেজমিন ঘুরে এসে জানান, খুলশী ক্লাবের শ্রমিকেরা গত কয়েকদিন ধরে পাহাড়টি কেটেছে। পাহাড়টির একটি অংশ দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট ও প্রস্থে ১৫ ফুট, আরেকটি অংশে দৈর্ঘ্য ১৫ ফুট ও প্রস্থে ১০ ফুট এবং আশেপাশে দৈর্ঘ্য ২০ ফুট ও প্রস্থে ১৫ ফুট খাড়াভাবে কর্তন করা হয়েছে।
মহানগরীর জালালাবাদ এলাকায়ও নির্বিচারে পাহাড় কর্তন চলছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী ওই এলাকা পরিদর্শন করে গত রোববার পাহাড় কাটার তিনটি স্কেভেটর জব্দ করেন। তবে এসময় পাহাড় কাটার সাথে জড়িতরা পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় গতকাল খুলশী থানায় মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। মামলায় জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড় কর্তনের অভিযোগে লোহাগাড়া হাউজিং সোসাইটির ১০ কর্মকর্তা এবং অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে আসামী করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, একই এলাকায় পাহাড় কাটার দায়ে একটি মামলায় গত বছরের ২ নভেম্বর পরিবেশ আদালতে আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। ওই মামলাটি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় একই আসামীরা একই স্থানে আবারও পাহাড় কাটছে। আবাসিক এলাকা নির্মাণের জন্য সেখানে পাহাড় টিলা কেটে সমতভূমি বানিয়েছে হাউজিং সোসাইটি। ইতোমধ্যে আড়াই একর পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে।
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পাহাড় কাটছে সিডিএ। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই সংস্থাটি কেটে ফেলেছে পাঁচটি পাহাড়। আরও অন্তত ১০টি পাহাড় কাটার আয়োজনও চূড়ান্ত। এসব পাহাড়ের অবস্থান সীতাকুন্ডের জঙ্গল সলিমপুর, সলিমপুর ও জঙ্গল লতিফপুর এবং মহানগরীর উত্তর পাহাড়তলী অংশে। পরিবেশ বিধংসী এই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা সিডিএকে দু’টি নোটিশ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। ডিটি-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে নগরীর সলিমপুর থেকে কাটা হচ্ছে একের পর এক পাহাড়। এরই মধ্যে কাটা হয়েছে জালালাবাদ হাউজিং পাহাড়, কৃষ্ণচূড়া পাহাড়, বাস্তুহারা পাহাড় এবং কাঁঠাল বাগান পাহাড়ের অনেকাংশ। রাতের আঁধারে পাহাড় কাটা হলেও দিনের বেলায় ট্রাকে করে মাটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে অন্যত্র।
এদিকে নগরীর দক্ষিণ পাহাড়তলী এলাকায় পাহাড় কাটার রীতিমতো মহোৎসব চললেও তা বন্ধে নেই প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ। স্থানীয়রা বলছেন, প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বিরামহীনভাবে এই পাহাড় কাটা হচ্ছে প্রশাসনের চোখের সামনেই, যা তারা নিজেরাও জানেন। ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ও এর আশেপাশের ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ বসতি, ইটভাটা, মুরগি ও মাছের খামার। এভাবে নগরীর আশপাশ থেকে শুরু করে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চলছে পাহাড় নিধন। এখন যেখানে পাহাড় সেখানে স্কেভেটর দেখা যাচ্ছে। কেউ পাহাড় কেটে বসতবাড়ি তৈরী করছে। কেউ মাটি লুট করছে। কোথাও আবার পাহাড় কেটে সমতল করে সেখানে মুরগির খামারসহ বিভিন্ন স্থাপনা করা হচ্ছে। গ্রামে পাহাড়ের মাটি চলে যাচ্ছে ইটের ভাটায়।
নির্বিচারে পাহাড় কাটা প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোঃ আলতাফ হোসেন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, কোথাও পাহাড় কাটার সংবাদ পাওয়ার পর আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। খুলশী ক্লাবকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করে ওই এলাকায় পাহাড় কাটা বন্ধ করা হয়েছে। জালালাবাদ এলাকায় লোহাগাড়া হাউজিং সোসাইটির নামে আইন অমান্য করে পাহাড় কাটা হয়েছে জানিয়েছে তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা মামলা করেছি। আগে থেকেই ওই এলাকায় পাহাড়-টিলা কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু তারা আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে পাহাড় কেটেছে। সংযোগ সড়কের জন্য সিডিএ ১৫টির মতো পাহাড় কাটছে বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সিডিএকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জনস্বার্থে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে পাহাড় কাটা যাবে তবে তার জন্য ছাড়পত্র নিতে হবে। আমার জানামতে, সিডিএ পাহাড় কাটার জন্য এখনও কোন পরিবেশ ছাড়পত্র পায়নি। অনুমোদন ছাড়াই পাহাড় কাটলে সিডিএ’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে পাহাড় কাটায় জড়িত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে চট্টগ্রামে মানববন্ধন ও নাগরিক সমাবেশ করেছে পিপলস ভয়েস নামের একটি সংগঠন। মঙ্গলবার বন্দরনগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে এ নাগরিক সমাবেশে বক্তাগণ বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রভাবশালীরা পাহাড় কাটলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ও মাটি ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষায় এবং মানবিক বিপর্যয় রোধে প্রভাবশালীদের কবল থেকে পাহাড় রক্ষায় প্রশাসনের জোর নজরদারির পাশাপাশি আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয় নাগরিক সমাবেশ থেকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন