প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা এবং ধৈর্য্য খুবই কাক্সিক্ষত। ছাত্র আন্দোলনকে ভয় নয়, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা দিয়ে আলাপ-আলোচনা করেই পরিস্থিতি করতে হবে।
সাত কলেজ ও নিপীড়নবিরোধী সমস্যার সমাধান খুবই দ্রুত শেষ করা উচিত। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা, হয়রানি সঙ্কট সুরাহার পথ নয়। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবে এটা স্বাভাবিক, অতীতেও হয়েছে। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষার্থীরা তাদের নানান ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করবে, এটি সভ্য সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকারে বাধা আসবে কেন? শক্তিশালী শিক্ষক সমিতি থাকার পরও ভিসিকে উদ্ধারে ছাত্রলীগ এলো কেন? তাহলে কি ব্যর্থ ঢাবি প্রশাসন? জনবলের অভাবের মধ্যে সাত কলেজকে ঢাবিতে অধিভুক্তিই ছিল অপরিকল্পিত এবং ঐতিহাসিক ভুল। কার স্বার্থে কেন করা হলো, এটি কারো জানা নেই। অজানা একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর নির্যাতন, ছাত্রীদের ওপর নারকীয় হামলা সত্যই লজ্জার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাজনীতিকরণে বাধ্য হচ্ছেন, না বাধ্য করা হচ্ছে, নাকি ভিসিরা ছাত্রলীগের করুণার পাত্র। অপশক্তি শিক্ষায় ভর করছে, শিক্ষা নিয়ে সঠিক জায়গায় দাঁড়াতে পারছে না সরকার। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় চরম অসন্তোষ-ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষোভ, অসন্তোষ, হামলা। এসব বক্তব্য শিক্ষাবিদ, লেখক, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষকসহ, বিশিষ্টজনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেয়ার অধিকার কোনো সংগঠনের নেই। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা আন্দোলন করবে। এটি সভ্য সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার। সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তকরণে শিক্ষার্থীদের মতামত নেয়া আবশ্যক ছিল, তা করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের সাথে প্রশাসনের কথা হবে, আন্দোলন হবে, বাধা দেয়ার দরকার আছে বলে মনে করছি না।
প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করল না, এগিয়েও এলো না, বরং আন্দোলন দমাতে পুলিশকে না ডেকে একটি সংগঠনকে ব্যবহার করল, এ ঘটনা সবার জন্য বড় দুঃখ ও লজ্জার। এমন ঘটনা ঘটেনি যাতে করে আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছে ঢাবি প্রশাসন। কেন এই নির্ভরতা? কীভাবে সম্ভব, যদি ভিসি আটকা পড়েই থাকেন উদ্ধার করবে পুলিশ, প্রক্টরিয়াল বডি আছে, তারা এগিয়ে আসবেন। এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বড় ক্ষতির কারণ মনে করছেন তিনি।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শিক্ষক, শিক্ষাউপকরণের ঘাটতি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই। তার ওপর নানা চাপ। সাত কলেজ অধিভুক্তকরণ বিষয়টি সঠিক পরিকল্পনায় হয়নি। কেন, কী স্বার্থ ছিল? ন্যায্য দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীরা, কিন্তু প্রশাসন তা আমলেই নিলো না। উল্টো বিতর্কিত ভ‚মিকা রাখল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিম্নশ্রেণীর আচরণ করল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা হলো, পুলিশে দেয়া হলো, একটি সংগঠন দিয়ে পেটানো হলো তাদের। এ আচরণ কারো কাম্য নয়। সবার আগে শিক্ষার্থী এবং তাদের অধিকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলো সব কলেজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য। অথচ সেশন জটে আটকে গেল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা। সাতটি কলেজকে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনতে হলো, তারা ব্যাখ্যা জানা নেই। সঠিক পরিকল্পনা ছিল না, থাকলে এমন হলো কেনো? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুরুতেই শিক্ষার্থীদের আলোচনা করে এটি সমাধান দিতে পারত। শিক্ষার্থীরা যখন শক্ত অবস্থান নিলো, তখন ছাত্রলীগ দিয়ে দমন করার চেষ্টা করল। এটি দায়িত্বশীল আচরণের মধ্যে পড়ে না। রাজনীতিকরণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, প্রাইমারি স্কুলে কী পড়ানো হচ্ছে? কারা পড়াচ্ছেন? আমি দেখেছি স্কুলে স্কুলে গিয়ে। সর্বনাশ! কিছুই জানছে না শিক্ষার্থীরা, না একাডেমিক, না নৈতিক। সবই যেন বিসর্জন গেল। শিক্ষার নামে কী হচ্ছে এসব। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার সব কাঠামো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হলো, কী দরকার ছিল। সরকার শিক্ষা নিয়ে সঠিক জায়গায় দাঁড়াতে পারছে না। লাখো শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায় না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক সমিতি, প্রক্টরিয়াল বডি থাকার পর ছাত্রলীগকে আসতে হলো কেন? কে ডাকল ছাত্রলীগকে? তার মানে ছাত্রলীগ যখন ভিসিকে উদ্ধারের দায়িত্ব নেয়, তখন ভিসি ছাত্রলীগের হয়ে যান। তিনি আর সাধারণের থাকতে পারেন না। চরম দলবাজি করতে গিয়ে যখন ঠিক ফুটবলের মতো ছাত্রলীগ তাতে হাওয়া দিয়ে লাথি মারে তখন কিছুই করার থাকে না।
লেখক গবেষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা আসবে কেন? ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার অধিকার নিয়ে কাজ করবে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করার কে? এতে শিক্ষার বিপদ বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষকরা মুখ খুলতে পারছে না নানা হুমকির কারণে। ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা নষ্ট করছে এখন। আগে এমনটি ছিল না। সম্মান ছিল, আনুগত্য ছিল, দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি চরম পক্ষপাতমূলক হচ্ছে। মানুষ এখন এ নিয়ে বিরক্ত।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন নবী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এই উপমহাদেশের অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান, যার ইতিহাস আছে, গৌরব আছে। এ অঞ্চলের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোলমডেল। সম্প্রতি যা ঘটছে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান চরমভাবে ক্ষুণœ হয়েছে।
ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে এলেও পাত্তা পায়নি শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গুরুত্ব দেয়নি। তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে ভিসি অফিস করলেন। ছাত্রলীগকে সঙ্গে নিলেন। আর এ ছাত্রলীগই সমস্যা তৈরি করল। কোনো সংগঠনের করুণা পেতে চাইলে তাদের আনুগত্য করতে হয় ভিসিকেও। ভিসিরা এখন ছাত্রলীগের করুণার পাত্র। এ ঘটনায় বহুমাত্রিক সমস্যার জন্ম দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন ভয়ে আছেন। প্রশাসনের অদক্ষতার কারণেই এটি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেছেন, এ কলেজ অধিভুক্তি প্রথম থেকে স্বস্তির ছিল না। কোনো ধরনের প্রস্তুতি এবং জনবল ছাড়াই এ অধিভুক্তি প্রশাসনিক নানা জটিলতা সৃষ্টি করেছে। সিলেবাস প্রণয়ন, প্রশ্ন করা, উত্তরপত্র দেখা, নম্বরের সমন্বয়, টেবুলেশন, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ করার কোনো আলাদা সেল করা হয়নি। গত বছর জুলাই মাসে দ্রুত ফল প্রকাশ এবং পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীদের প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় আন্দোলনের পাখা মেলে গত অক্টোবর মাসে পরীক্ষার ফল প্রকাশের দাবিতে। এ আন্দোলনে একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারিয়ে যায়। সর্বশেষ আন্দোলন দানা বাঁধে গত জানুয়ারি মাসে আবারো আন্দোলন ফল প্রকাশ ও ক্লাস শুরুর দাবিতে। নতুন এ সাত কলেজ ছাড়াও ঢাকা ও এর আশপাশের জেলার সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান অনেক দিন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। এ সাত কলেজ পরিচালনার বাস্তবতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। একটি বিষয় না বললেই নয়, যে ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে, সেটি খুব বেশি নতুন চিত্র নয়। ক্ষমতাবান সংগঠনের কাছে প্রশাসনের নতজানু চরিত্রই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাক্সিক্ষত সংস্কৃতি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছাত্রলীগের নেতাকে নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন। এরাই আমাদের কাছ থেকে সনদ নিচ্ছে। এ হলো উচ্চশিক্ষার হাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নৈতিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করল। প্রশাসন আমলে নিলো না। আন্দোলনকারীদের দমাতে ছাত্রলীগ এলো। ছাত্রলীগ যৌন নিপীড়ন করল। এর প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করল, ছাত্রলীগ যা করল তা খুব লজ্জার বটে। এর আগেও বিভিন্ন আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল শন্তিপূর্ণ। অথচ আন্দোলনকারী একজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হলো, তার খোঁজও মিলছে না দু’দিন, ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করা হলো। এখানে মূল সমস্যা হলো প্রশাসনে গিয়ে শিক্ষকরা তার নিজ পরিচয় ভুলে যান। আইনি কাঠামোতে নির্ভর না করে পেশিশক্তির ওপর পুরো ক্ষমতা চালাতে চায়, শিক্ষকরা নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তাহলে এমন নির্যাতনের পরও কি শিক্ষকরা ক্লাসে যেতে পারেন? শিক্ষকদের দলবাজি রাজনীতিই যদি মুখ্য হয়ে আসক্ত হন, তাহলে শিক্ষকতা করার কী দরকার? শিক্ষায় কলঙ্কের আরো একটি কালিমা পড়ল এবারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেছেন, কোনো প্রকার স্টাডি ছাড়া, গবেষণা ছাড়াই সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনিতেই অনেক কাজের চাপ রয়েছে। প্রায় ১০০টি বিভাগ রয়েছে। এখানে শিক্ষদের ওপর চাপ বাড়ছে। এর মধ্যে সাতটি কলেজকে অধিভুক্ত করা ঠিক হয়নি। আন্দোলনকারী এবং আন্দোলন দমনকারীদের দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। মামলা হলো, হামলাও হলো। একটি জরুরি সমাধান প্রয়োজন। না হয় শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই এর উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগ সকল ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে।
এদিকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, ঢাবি প্রশাসনের ঘটনার তদন্ত কমিটি পক্ষপাতমুক্ত নয়। আমরা এ বিষয়ে জুডিশিয়াল তদন্ত চাই। কারণ ঢাবি প্রশাসন কখনো নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবে না। এ বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন