শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জেনারেল বিপিন রাওয়াত বিজেপির মুখপাত্রের মতো কথা বলেছেন

| প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
উগ্র হিন্দুত্ববাদী, মুসলিমবিদ্বেষী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি ভারতকে হিন্দুরাজ্য বা রামরাজ্য করার রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করছে। হিন্দুত্ববাদ জাগাতে দলটি মুসলিম বিদ্বেষকে শুরু থেকেই হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে আসছে। দলটির মতে, ভারত কেবলমাত্র হিন্দুদের আবাসভূমি। অন্যান্য জাতি-ধর্মের লোকেরা, বিশেষ করে মুসলমানরা বহিরাগত। হয় তাদের ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে, না হয় হিন্দু হয়ে যেতে হবে। বিজেপির নেতারা কথায় কথায় মুসলমানদের ভারত ছেড়ে চলে যেতে বলেন। তাদের অন্যান্য অধিকার তো পরের কথা, খাদ্য অধিকার পর্যন্ত দিতে তারা নারাজ। গোরক্ষার নামে মুসলমানদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, অন্য কোনো সভ্যদেশে তা কল্পনা করা যায় না। ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি ঘর ওয়াপস নামে এক কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই কর্মসূচীর লক্ষ্য, মুসলমানদের হিন্দুত্বে দীক্ষা দিয়ে হিন্দু বানানো। জোর করে মুসলমানদের হিন্দু বানানোর চেষ্টাও করা হয়। এ কর্মসূচী কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কোনো মুসলমান স্বেচ্ছায় হিন্দু হতে যায়নি। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়, এক কোটি ‘বাংলাদেশীকে’ বিতাড়ন করা হবে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের তরফে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের অভিযোগ করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে কখনো কখনো ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ ফেরৎ পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, যাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে, তারা সবাই ভারতীয়। মূলত তারা বাংলাভাষী মুসলমান, যাদের বংশপরম্পরা বসবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কিংবা অন্য কোনো রাজ্যে। অনুপ্রবেশের অভিযোগ যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মুসলিম বিদ্বেষজাত তা প্রমাণিত। বিজেপির অভিযোগ, বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী বিভিন্ন সময় আসামে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ী বসবাস গড়ে তুলেছে। তারা আসামের জনবিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। তাদের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে এবং এমন একটা সময় আসতে পারে যখন আসামের রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে চলে যাবে, ভারতের নিরাপত্তা ও অখন্ডতার প্রতি যা হুমকি স্বরূপ। অতএব, এখনই অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়ন করতে হবে। এই লক্ষ্যে বিজেপি কাজ শুরু করেছে। নাগরিক তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। এর মধ্যেই এক কোটি ৯০ লাখ বৈধ নাগরিকের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সে তালিকায় স্থান পায়নি প্রায় দেড় কোটি বাংলাভাষাভাষী। এ নিয়ে নয়াদিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। প্রতিবাদকারীরা বলেছে, শুধু বাংলাভাষী হওয়ার কারণে নয়, দেড় কোটি ভারতীয়কে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেয়ার প্রধান কারণ, তারা মুসলমান। সরকারের পক্ষ থেকে এর জবাবে বলা হয়েছে, এসব বাংলাভাষী মোটেও ভারতীয় নয়। তারা অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে এসে সেখানে বসবাস, চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, নাগরিক তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই সেখানে বাংলাভাষী মুসলমানেরা নানাভাবে ধরপাকড়, অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অন্তত ছটি স্থানে ‘অবৈধ অভিবাসী’ চিহ্নিত করে কারাগারের মতো করে ডিটেনশন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। ওই সব সেন্টারে হাজার হাজার বাংলাভাষী মুসলমানকে আটকে রাখা হয়েছে।
ঘটনা প্রবাহের এই প্রেক্ষপটে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত দিল্লীতে এক সেমিনারে (২৬ ফেব্রুয়ারী) যে বক্তব্য রেখেছেন, তা কোনো বিজেপি মুখপাত্রের পক্ষেই রাখা সম্ভব। তার বক্তব্যে বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন ও লক্ষ্যের প্রতিফলন রয়েছে। আসামে বিজেপি যা করছে, তার প্রতি সমর্থন রয়েছে। এই বক্তব্য রাখার সময় তিনি সাধারণ কান্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতেও ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসাবেই পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশে মদদ দিচ্ছে। আর সে কাজে তাদের সাহায্য করছে চীন।’ তার এ বক্তব্য আরো একটু সহজ করে বুঝতে চাইলে কথা দাঁড়াবে এই : বাংলাদেশ তার নাগরিকদের আসামে ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটাচ্ছে। পাকিস্তান সেই অনুপ্রবেশে ‘মদদ’ দিচ্ছে। আর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে ‘সাহায্য’ করছে চীন। কেন এই তিন দেশ মিলে এটা করছে? জেনারেল বিপিন রাওয়াতের ভাষায়, ভারতের এই আঞ্চলকে ‘অস্থির করে তুলতে’ বা ‘গোলযোগ বজায় রাখতে’। জেনারেল বিপিন রাওয়াত আরো বলেছেন, আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতকে পাকিস্তান দখলে নিতে চায়। তাই বাংলাদেশ থেকে মুসলমানদের নিয়ে গিয়ে আসামের জিলাগুলো ভরে ফেলছে। সাধারণ ভুগোল জ্ঞান যাদের আছে, তারা জানেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আসাম বা উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো সীমান্ত নেই। আসাম বা উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পাকিস্তান অন্তত দেড় হাজার মাইল দূরে। মাঝখানে ভারত। কীভাবে এতদূর পাড়ি দিয়ে আসাম বা উত্তর-পূর্ব ভারতকে পাকিস্তান দখল করবে, এটা মোটেও বোধগম্য নয়। প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের দখল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ তার নাগরিক পাঠিয়ে সহায়তা দেবে কেন? চীনই বা এই অবাস্তব, অসম্ভব উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় সাহায্য করতে যাবে কেন? আসলে ভারতীয় মানসে পাকিস্তান বিদ্বেষ আজন্ম। সব কিছুর পেছনেই ভারতীয়রা পাকিস্তানের হাত আবিষ্কার করে। এই সঙ্গে চীনের প্রতি বৈরিতা ও ভীতি তাদের মজ্জাগত। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তাদের ধারণা খুব ভালো বা মসৃণ নয়। একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ কখনোই ভারতের স্বাভাবিক মিত্র হতে পারেনি। জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বক্তব্যে এই দিকগুলো বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে রীতিমতো মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। ওই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী এদেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, অকথ্য নির্যাতন ও জুলম করেছে। অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে। সেই যুদ্ধ ও যুদ্ধের স্মৃতি এদেশের মানুষের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্ভবত এ কারণেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এত বছরেও খুব সহজ হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ইতিহাসের এক অচ্ছেদ্য অধ্যায়। ওই সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। বর্তমান সরকার গত ৯ বছর ক্ষমতায় আছে। এ সময়ে দু’ দেশের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে বলে সরকারের দাবি। ভারতের পক্ষ থেকেও একই দাবি করা হয়। অথচ জেনারেল বিপিন রাওয়াত বাংলাদেশকেও ছেড়ে কথা বলেননি। ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে পাকিস্তান-চীনের সঙ্গে বাংলাদেশও শামিল, একথাই তিনি বলেছেন।
আসামে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বিজেপি ভীত। ভীত হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ থাকতে পারে না। তবে মুসলিম বিদ্বেষ যার রাজনৈতিক পুঁজি, হিন্দুত্ববাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যার দর্শন তার পক্ষে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি বরদাশত করার কথা নয়। আসাম থেকে বাংলাভাষী মুসলিম বিতাড়নের নীলনকশা সে জন্যই। তাদের বাংলাদেশী বলে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া সহজ বলে মনে করছে বিজেপি। যেভাবে নাগরিকত্ব খারিজ করে, সকল রাষ্ট্রীয় ও মানবিক অধিকার হরণ করে বাংলাদেশী বলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে, আসামে সেই একই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বিজেপি সরকার। জেনারেল বিপিন রাওয়াত সেই পরিকল্পনাকেই সমর্থন করেছেন। এমন কি তিনি তার মুসলিম বিদ্বেষকে আড়াল করতে পারেননি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে মুসলিম পাঠানোর ফলে আসামে বছর কয়েক আগেও মাত্র পাঁচটি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এখন সে রাজ্যে আট থেকে নয়টি জিলা সে অবস্থায় চলে গেছে। এখানেই তার এই মুসলিম ভীতি বা বিদ্বেষ থেমে যায়নি, তিনি আসামভিত্তিক একটি দল, অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএফ) বিরুদ্ধেও এক হাত নিয়েছেন। দলটির প্রধান একজন মুসলমান, যার নাম সৈয়দ বদরুদ্দিন আজমল। দলটি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী, কোনো মুসলিম দল নয়। হিন্দু-মুসলিম সবার দল গত লোকসভা নির্বাচনে দলটি। আসামে তিনটি আসন পেয়েছে। দলটিকে তিনি আসামে মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধির বহি:প্রকাশ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, দলটি বিজেপির চেয়েও দ্রæত বিকাশ ও বিস্তার লাভ করছে।
এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, ব্রিটিশ ভারতের নানা অংশ থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাভাষীরা আসামে বসতি স্থাপন করে। বস্তুত তারাই দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলেঘেরা আসামকে আবাদ করে। এই বসতি স্থাপনকারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া হিন্দু-মুসলমান। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা প্রভৃতি এলাকা থেকেও সেখানে অনেক মানুষ যায়। এক দেশ থাকায় এই জনস্থানান্তর অস্বাভাবিক ছিলনা। ৪৭ সালের ভারতবিভক্তির পর বসতি স্থাপনকারীদের প্রায় সবাই সেখানে থেকে যায়। শুরু থেকে যুগযুগ ধরে স্থানীয়দের সঙ্গে বহিরাগতদের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল। কিন্তু ভারতবিভক্তির পর সেই মধুর সম্পর্কের মধ্যে বিষ ঢেলে দেয় কংগ্রেস ও বর্ণহিন্দুরা। এই বিষের অন্যতম ফল ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। বাঙ্গাল খেদা আন্দোলন আসলে ছিল ‘বাঙ্গাল মুসলমান খেদা আন্দোলন।’ বাঙ্গাল হিন্দুদের এই আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। এই সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতির নির্বিচার শিকার হয়েছে সেখানকার বাংলাভাষী মুসলমানরা। দাঙ্গার পর দাঙ্গা হয়েছে। তাতে যারা মারা গেছে, তাদের অধিকাংশই মুসলমান। তাদের বাড়িঘর লুণ্ঠিত ও ভস্মিভূত হয়েছে। কোনো কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা গণহত্যায় রূপ লাভ করেছে। ১৯৮৩ সালে নেলীতে সংঘটিত নির্বিচার হত্যাকান্ডর ঘটনা এর একটি উল্লেখযোগ্য নজির। ওই ঘটনায় ৭ থেকে ১০ হাজার লোক নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। বলা যায়, অনুপ্রবেশের অভিযোগ এবং কথিত অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়নের দাবি ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিজেপি এই রাজনৈতিক ইস্যুটি বাস্তবায়নের চেষ্টায় কোমর বেধে নেমেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত তাতে ইন্ধন দিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, সেনাপ্রধান এরূপ রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ করতে পারেন কিনা। ভারতেরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, না, এ ধরনের বক্তব্য সেনাপ্রধান দিতে পারেন না। তারা অভিযোগ করেছেন, এই প্রথম কোনো সেনাপ্রধানকে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে দেখা গেলো। ভারতের সেনাবাহিনী বরাবরই দলনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে আসছে। এই প্রথম বারের মতো কোনো সেনাপ্রধান কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অবস্থান নিলেন। এটা সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের খেলাপ এবং সেনাবাহিনীর মধ্য রাজনীতি প্রবেশ করানোর চেষ্টার নামান্তর হিসাবেই গণ্য। সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণ হলে কী ফল হয় বা হতে পারে, তা ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্টজনদের অজানা নয়। এ জন্য তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একমাত্র বিজেপি ছাড়া ভারতের অন্যকোনো দল জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বক্তব্য সমর্থন করেনি। বিজেপি নেতা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিজয় কুমার সিংহ বলেছেন, সেনা প্রধান যা বলতে চান, তা বলতে পারেন। অন্য নেতাদেরও অনেকে তাকে বাহাবা দিয়েছেন।
সেনাপ্রধান সংবিধান লংঘন করেছেন কিনা, এমন প্রশ্নও উঠেছে। সংবিধান মতে, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের সমঅধিকার সংবিধানে স্বীকার করা হয়েছে। কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, বিদ্বেষ ছড়ানো কিংবা বৈরি আচরণ প্রদর্শন করা সংবিধানের নীতির সঙ্গে যায়না। ভারতে সেসব রাজনৈতিক দল আছে, সংবিধান ও আইনের আওতাতেই সেগুলো অস্তিত্ববান হয়ে আছে। কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা বাড়ে, কখনো কমে। এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু জেনারেল বিপিন রাওয়াত এআইইউডিএফ-এর জনপ্রিয়তাকে আসামে মুসলমান সংখ্যা বৃদ্ধির প্রমাণ হিসাবে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেটা কতদূর সীমিচীন হয়েছে সে প্রশ্নটি উপেক্ষাযোগ্য নয়। এ বিষয়ে কথা বলা তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কিনা সেটাও কম বড় প্রশ্ন নয়।
যা হোক, এসব বিষয় বিবেচনা ও মূল্যায়ন করার দায়িত্ব ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞজনদের। আমরা এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চাই না। আসাম থেকে মুসলিম বিতাড়নের এবং বাংলাদেশী বলে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে আয়োজন চলছে, সেটাই আমাদের উদ্বেগের বিষয়। আমাদের স্পষ্ট। কথা, বাংলাদেশ থেকে কোনো মুসলমান আসামে প্রবেশ করছে না। তাদের প্রবেশের যুক্তিসঙ্গ কোনো কারণ নেই। বাংলাভাষী মুসলমান বলে যাদের বিতাড়নের টাগেট করা হচ্ছে তারা ভারতেরই নাগরিক। তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার রাজনৈতিক উদ্যোগ দূরভিসন্ধিমূলক। এক্ষেত্রে জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বক্তব্য সেই দূরভিসন্ধিকে শক্তিশালী করেছে। এটা আমাদের উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের নাগরিক সমাজের কারো কারো মতে, এটা বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি বা মনস্তাত্তি¡ক চাপ বাড়ানোর চেষ্টা। তাদের অভিমত, চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার পর থেকেই ভারতের সেনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছেন। যেহেতু বর্তমান সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ‘মধুচন্দ্রিমা’ চলছে, সুতরাং সরকারের উচিৎ, আসাম থেকে মুসলমান উৎসাদনের চলমান প্রক্রিয়া ও জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বক্তব্য বিষয়ে ভারতের কাছে একটি ব্যাখ্যা চাওয়া। অত্যন্ত বিস্ময় ও আশ্চর্যের বিষয়, এখন পর্যন্ত সরকারের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি, ব্যাখ্যা চাওয়া তো পরের কথা। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিষয়টি মোটেই হেলাফেলার নয়। সরকারের পক্ষ থেকে যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া জানানো ও ভারতের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া জরুরি। এই সঙ্গে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। সরকারের লোকজনেরা যতই ‘বন্ধুত্বের’ জয়গান প্রচার করুন না কেন, বাস্তবতা তো এই যে, ভারতের সেনাপ্রধান পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশকেও একই ব্রাকেটভুক্ত করেছেন। অতএব, সাধু সাবধান!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন