বরিশালে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে ডিবি পুলিশ। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, বরিশালে ডিবির একটি অভিযানের সময় অভিযানের কারণ জানতে চাইলে প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ডিবিসি নিউজের ক্যামেরা পারসন সুমন হাসানের উপর চড়াও হয় ডিবি পুলিশ। সুমনকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। হাতে হ্যন্ডকাপ পরা অবস্থায় সুমনের অন্ডকোষে চেপে ধরে এবং অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফেরার পর পুনরায় তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন সুমন হাসান। একজন পেশাদার সাংবাদিকের উপর ডিবি পুলিশের এই অকথ্য নির্যাতনের খবর এবং ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে এবং সিনিয়র সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের হস্তক্ষেপে সুমন হাসান প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। সারাদেশে এই ঘটনার প্রতিবাদ ও ধিক্কার ধ্বণিত হচ্ছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অভিযুক্ত আট পুলিশ সদস্যকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্লোজ করা হলেও রহস্যজনক কারণে তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। একজন নিরপরাধ সাংবাদিকের উপর এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা থেকেই বুঝা যায়, সাধারণ মানুষের উপর ডিবি পুলিশের আচরণ কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানাই। শুধু ক্লোজ বা তিরস্কার করেই পুলিশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব শেষ করলে হবেনা। অভিযুক্তদের যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ায় বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।
পুলিশের জনবল, অস্ত্র, লজিস্টিকস এবং আইনগত ক্ষমতা জনসাধারণের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয়িত হওয়ার কথা। দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। পুলিশ জনগনের বন্ধু ও নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। সব সভ্য সমাজেই পুলিশ এই ভূমিকা পালন করে আসছে। কিছু অপরাধি পুলিশের কথা বাদ দিলে আমাদের দেশেও পুলিশ বাহিনীর গৌরবময় ভ‚মিকা ও কৃতিত্ব খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিছু অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যের কারণে পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ও তাদের কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা ম্লান হয়ে পড়েছে। বিশেষত সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশের অভিযান যেন এখন এক মূর্ত আতংকের নাম। ডিবি পুলিশের একশ্রেনীর সদস্যের বিরুদ্ধে সরকারী পদবি, পোশাক,অস্ত্র ও গাড়ী ব্যবহার করে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, গুম-হত্যাকান্ডের মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এই সুযোগে সংঘবদ্ধ অপরাধিচক্রও ডিবি পুলিশের ভ‚য়া পরিচয় ব্যবহার করে প্রকাশ্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড করছে বলেও অভিযোগ আছে। এহেন বাস্তবতায় মহামান্য হাইকোর্ট থেকে সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশের অভিযান পরিচালনা এবং বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনার পরও সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশের তান্ডব বন্ধ হয়নি। ডিবিসহ থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ ও রাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের একশ্রেনীর সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কারণে আমাদের পুলিশ বাহিনী জনগনের আস্থা হারাচ্ছে এবং জননিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নত হচ্ছে।
সাংবাদিক সুমন হাসানের বরিশাল ডিবি পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরে অস্ত্র উঁচিয়ে ডিবি পুলিশের ত্রাস সৃষ্টির ঘটনাও আমরা দেখেছি। প্রায় একই সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবীতে দলের শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন থেকে ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন মিলনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার তিনদিনের মাথায় তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে এইভাবে মৃত্যুর ঘটনা আরো অনেক ঘটেছে। পুলিশ আইনের রক্ষক ও প্রয়োগকারী মাত্র। পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ও যে কোন স্তরের আটক ব্যক্তির উপর দৈহিক নির্যাতন কোন অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশ বাহিনীর যে সব সদস্য সরকারী অস্ত্র ও সুযোগসুবিধাকে বেআইনী কাজে ব্যবহার করছে তারা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সংঘবদ্ধ অপরাধিচক্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসায়, চোরাচালানীসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নানা ধরনের অপরাধের কারণে বছরে গড়ে ১০-১৫ হাজার পুলিশ সদস্য বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হলেও পুলিশের অপরাধ প্রবণতা কমছেনা। এটি পুলিশের গুরুতর অপরাধে লঘুদন্ডের ফল। কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধকে শুধুমাত্র ক্লোজ, বদলি, তিরস্কার, অর্থদন্ড বা বরখাস্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কারণেই পুলিশের অপরাধ কমছেনা। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্বের বদলে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ ও পদায়ন প্রক্রিয়ায় দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়, আঞ্চলিকতাসহ ঘুষবাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতির কারণে পুলিশের অপরাধ প্রবণতা বন্ধ হচ্ছেনা। গত বছর চট্টগ্রামের ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরুকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হাত পা বেধে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করার অভিযোগের কোন তদন্ত বা বিচার এখনো হয়নি। এ সপ্তাহে জাকির হোসেন মিলনের মৃত্যুর পর বরিশালে ডিবি পুলিশের হাতে সাংবাদিক সুমন হাসান নির্যাতনের শিকার হলেন। দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্যের এমন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের দায় বাহিনীর কর্তৃপক্ষ নিতে পারেনা। অতএব তাদের এসব অপরাধ ও হন্তারক ভ‚মিকা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন