দৃশ্যটি খুবই করুণ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জড়িয়ে ধরে আছে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি মিজানুর রহমান রাজ। পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। মির্জা ফখরুলও তাকে বাঁচানোর জন্য আঁকুতি জানাচ্ছেন। যেন এক পুত্রকে বাঁচাতে এক পিতার করুণ আর্তি। শেষ পর্যন্ত তার এই আঁকুতিকে পুলিশ পাত্তা না দিয়ে জোর করে তাঁর কাছ থেকে রাজকে ছিনিয়ে নেয়। যেন চিলের ছোঁ মেরে মুরগীর ছানা নিয়ে যাওয়া। পুলিশ রাজের পরনের শার্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি ছিঁড়ে মাটিতে শুইয়ে চেপে ধরে। হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে খালি গায়েই চ্যাঙদোলা করে নিয়ে যায়। গত ৮ মার্চ প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপির পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে এ ঘটনা ঘটে। দেখা যাচ্ছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কারান্তরীনের পর থেকেই বিএনপির শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ থেকে পুলিশ চিলের মতো ছোঁ মেরে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখে সচেতন মানুষের মনে হতে পারে, যেন গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ঘটনার দুই-তিন দিন আগে পুলিশ স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে প্রেসক্লাব থেকে যেভাবে ধরে নিয়ে যায়, তা হলিউডের অ্যাকশন সিনেমাকেও হার মানায়। পিস্তল হাতে পজিশন নিয়ে তাক করে থাকা সাদাপোশাকের পুলিশের যেসব ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তা কেবল সিনেমার পোস্টারেই দেখা যায়। তার আগে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে যেভাবে অপরাধীর মতো কলার চেপে অপমান-অপদস্ত করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তা একজন রাজনীতিবিদের জন্য খুবই অবমাননাকর। এই অপমান শুধু তারই নয়, সকল রাজনীতিবিদের। বিএনপির ওপর পুলিশের এই নতুন ধরনের অ্যাকশন কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন কোনো মানুষ সমর্থন করতে পারে না। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকা ও সচেতন মহলে সমালোচনা হচ্ছে। তাতে অবশ্য সরকারের কিছু যায় আসে না। কারণ সরকার যেমন সাধারণ মানুষ কী মনে করলো না করলো তার তোয়াক্কা করে না, তেমনি সচেতন নাগরিক সমাজের কথাও আমলে নেয় না। সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে, যে করেই হোক ক্ষমতায় থাকতে হবে এবং ক্ষমতায় থাকতে হলে তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ধুলিস্যাত করতে যা যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে। দলটিকে কোনো কর্মসূচিই পালন করতে দেবে না। এজন্য পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিএনপির প্রতি সরকারের এ আক্রোশ পুলিশের মাধ্যমে প্রকাশ করে পুরো বাহিনীকে বিরোধী রাজনীতির প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। পুলিশও অতি উৎসাহী হয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করে টুটি চেপে গ্রেফতার করে বাহাদুরী দেখাচ্ছে। দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির প্রতি সরকারের এই বিরূপ মনোভাব ও রৈরি আচরণ প্রত্যক্ষ করে আসছে। সাধারণত দেখা যায়, সরকার তার মেয়াদের শেষ কয়েক মাস আগে বিরোধী দল যাতে কোনো আন্দোলন করতে না পারে, এ জন্য তার নেতাকর্মীদের ব্যাপক হারে ধরপাকড় করে। এর কারণ হচ্ছে, মেয়াদের শেষ বছরে এসে সরকারের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে, তার ভেতর নার্ভাসনেস কাজ করে। সে নিশ্চিত হতে পারে না, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারবে কিনা। তার ভেতর ক্ষমতা হারানোর ভয় কাজ করে। ধরেই নেয়, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতা হারাবে এবং তার প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় আসবে। তাই প্রতিপক্ষ যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, এজন্য হামলা-মামলা, নিপীড়ন-নির্যাতনমূলক পন্থা অবলম্বন করে। প্রথাগত রাজনৈতিক এই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বেশ ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। সরকার ক্ষমতার শেষ বছরের শুরুতেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু করেছে। সরকার বুঝতে পারছে, তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি যদি ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে এগিয়ে যায়, তবে একসময় তা প্রবল আকার ধারণ করবে। তখন তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ আশঙ্কা থেকেই সরকার বিএনপি দমনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে। এতে কে কি মনে করল, তাতে কিছু যায় আসে না। অবশ্য বিনাভোটে নির্বাচিত যে সরকার ক্ষমতায় থাকে এবং গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে, তার চক্ষু লজ্জা বলে কিছু থাকে না। বিরোধী দলের নেতাদের চ্যাঙদোলা করে হোক বা ঘাড় ধরে হোক, জেলে নিয়ে যাওয়া তার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। তার নীতি হয়ে পড়ে ‘নো মার্সি, নো রিট্রিট’ বা কোনো দয়াও নয়, পিছিয়ে আসাও নয়। বলা বাহুল্য, এ ধরনের ধ্বংসাত্মক নীতি তখনই অবলম্বন করা হয়, যখন সরকারের ভিত্তি দুর্বল থাকে।
দুই.
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভেতরে বরাবরই সরকারবিরোধী মনোভাব কাজ করে। এ সরকারের বিরুদ্ধেও যে এ মনোভাব অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে, তা পথে-ঘাটে, মাঠে, চলতে-ফিরতে মানুষের কথা থেকে বোঝা যায়। সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, তার দোষ-ত্রুটিই তাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয়। আর বিরোধী দল যতই আন্দোলন-সংগ্রাম করুক না কেন, কষ্ট হলেও তার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর প্রবণতা দেখা যায়। সেই ’৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা ছিল। তা নাহলে এই সময়ের মধ্যে জনগণ বিএনপি বা আওয়ামী লীগকে একবার করে নয় পরপর সুযোগ দিত। কেবল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা এ কাজটি করতে পারেনি। বলা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের সে সুযোগ দেয়নি। দলটি ভোটারদের রায় তুচ্ছ করে বিনাপ্রতিদ্ব›দ্বতার সরকার গঠন করে। দলটি মনে করেছে, জনগণের ভোটের প্রয়োজন নেই। আমাদের সিদ্ধান্তই তাদের মেনে নিতে হবে। অন্যদিকে বিরোধী দল যাতে তার এই বিনাভোটে নির্বাচিত হওয়াকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বা কোনো টুঁ শব্দ করতে না পারে, এজন্য তাদের অ্যাবলিশ বা ধ্বংস করে দেয়ার নীতি অবলম্বন করে চলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ নীতি দেশের মানুষ ভালভাবেই উপলব্ধি করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ বিএনপির ওপর যে দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা যেভাবে অব্যাহত রেখেছে, তা সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাসে দেখা যায় না। এই নীপিড়ন-নির্যাতনকে জায়েজ করতে গিয়ে যুক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির সময়কার নীপিড়ন-নির্যাতনের কথা বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, বিএনপি যা করেছে, আমরাও তাই করব। বরং তার চেয়ে বেশি বৈ কম করব না। এক ধরনের প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা এবং আক্রোশের নীতি বিএনপির ওপর চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই দুই শাসনামলের নিপীড়নের তুলনা করলে দেখা যাবে, বিএনপির বিরুদ্ধে নিপীড়নের যে অভিযোগ করা হয়, তখন দলটি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ছিল। তার মানে এই নয়, জনগণ আওয়ামী লীগকে নীপিড়নের জন্য বিএনপিকে ভোট দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের ওপর নিপীড়নের বিষয়টি ছিল একান্তই তার সিদ্ধান্ত। এজন্য ভোটারদের মধ্যেও আফসোস এবং দায়ও ছিল। কারণ তারাই বিএনপিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল। ফলে জনগণ পরবর্তীতে বিএনপিকে আর ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিএনপির ওপর যে জুলুম-নির্যাতন ও দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, তাতে জনগণের কোনো সমর্থন নেই। ফলে জনগণ একদিক থেকে জনগণ নিজেদের দায়মুক্ত মনে করে বিএনপির ওপর সরকারের দমন নীতিকে কোনোভাবেই গ্রহণ করছে না। বিএনপির ওপর এই যে ক্রমাগত নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সচেতন মহলের পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। এমনকি সরকার সমর্থক অনেক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরাও বলছেন, বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে সরকার যে বাধা দিচ্ছে, তা ঠিক হচ্ছে না। বিএনপিকে এ কর্মসূচি পালন করতে দেয়া উচিত। তারা মনে করছেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে বিরোধী রাজনীতি থাকা অপরিহার্য। অবাধ গণতন্ত্রের স্বার্থে আগামী নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক করা খুবই দরকার। তারা পরোক্ষভাবে হলেও বলছেন, সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একতরফা করে দেশে-বিদেশে সমালোচনার শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। আগামী নির্বাচনটিও যদি এরকম হয়, তবে আর মুখ দেখানো যাবে না। তাদের এই কথা ক্ষমতাসীন দল আমলে নিচ্ছে না। পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল কাছের লোকজন এবং সমর্থক-বুদ্ধিজীবীদের কথাও শুনতে নারাজ। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সে এতটাই উদ্বিগ্ন যে, যে কোনো মূল্যে তাকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। সামনে যে-ই বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকে নির্মূল করা হবে। সরকারের মধ্যে যে নার্ভাসনেস কাজ করছে, তার বড় উদাহরণ হচ্ছে, রাজধানীসহ বড় বড় শহর ও এলাকায় জনসভা করে বেড়ানো। সে মনে করছে, আগেভাগে জনসভা করলে জনগণের মন জয় করে এগিয়ে যাওয়া যাবে। এই মনে করা থেকেই প্রধানমন্ত্রী জনসভায় আগতদের নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য ওয়াদা করাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, জনসভায় আগতদের ওয়াদা করাতে হবে কেন? তাদের তো এমনিতেই ভোট দেয়ার কথা! এর ব্যাখ্যাটি এমন হতে পারে, সরকারের ভেতর এতটাই ভয় কাজ করছে যে, যদি ওয়াদা না করাই, তাহলে জনসভায় আগতরা তাকে ভোট দেবে না। তাই ওয়াদা করিয়ে ভোট নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি জনসভায় দলের নেতা-কর্মীদেরও ওয়াদা করানো হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার নিজ দলের নেতা-কর্মীদের ওপরও আস্থা রাখতে পারছে না।
তিন.
৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর থেকেই কেবল ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের কথাটি শোনা যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি সব মহল থেকেই এর উপর জোর দেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ‘অংশগ্রহণমূলক’ কথাটিই আসার কথা নয়। অতীতেও কখনো শোনা যায়নি। নির্বাচন এলে ছোট-বড় সব দল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ফলাফলের পর পরাজিতরা সূ²-স্থূল কারচুপির অভিযোগ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হওয়ায় এসব অভিযোগ পাত্তা পায়নি। দুঃখের বিষয়, বিগত পাঁচ বছর ধরে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের কথাটি খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। এর কারণ পাঠকরা ভাল করেই জানেন। ক্ষমতাসীন দল দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে নির্বাচন করে। যেখানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারেনি। এতে ক্ষমতাসীন দলের একদিকদর্শী ও কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার মানসিকতা বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দলটি মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে গণতন্ত্র ও ভিন্নমত থাকুক এটা চায় না। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীনই হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেন্দ্র করে। স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিক ধারা বাধাগ্রস্ত হলেও দেশের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করে পুনরায় তা বলবৎ করেছে। অর্থাৎ মানুষ বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই দেখতে চায়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তাদের এ চাওয়া অনেকটাই আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা দৃঢ় হয়ে উঠেছে। আগামী নির্বাচনেও সে এই প্রবণতা ধরে রাখতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোন দল এলো কি এলো না, তাতে তার কিছু যায় আসে না। তার এ কথা থেকেই বোঝা যায়, ক্ষমতাসীন দল এককভাবে এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতাসীন হতে চায়। অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন সে চায় না। এ কারণেই তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির ওপর দমন নীতি চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে দলটি নির্বাচনে আসতে না পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আচরণ এভাবে বদলালো কেন? সে কি স্বেচ্ছায় গণতান্ত্রিক আচরণ থেকে সরে এসেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে হবে। তখন সদিচ্ছায় হোক বা লোক দেখানো হোক, বিএনপিকে তার অধীনে নির্বাচনে আনার জন্য আওয়ামী লীগ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। বিদেশি মধ্যস্থতাকারীরাও দুই দলের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে ছিল। এসব উদ্যোগের মাঝেই হঠাৎ দৃশ্যপটে আগমণ ঘটে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের। তার আগমণের পরপরই আওয়ামী লীগের আচরণ বদলে যায়। সব আলাপ-আলোচনা বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়। যে এরশাদ নির্বাচনে যাবে না বলে গোঁ ধরে বসেছিল, তাকে চ্যাঙদোলা করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই নমিনেশন পেপার সাবমিট করা হয়। এরশাদ অনেক কাকুতি-মিনতি করে নমিনেশন পেপার প্রত্যাহার করতে চাইলেও সে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। এসবই যে করা হয়েছিল তৎকালীন ভারতের কংগ্রেস সরকারের বুদ্ধিতে, তা জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আওয়ামী লীগও কংগ্রেসের এই বুদ্ধি লুফে নেয়। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। অথচ যে কংগ্রেস বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে খর্ব করার সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছিল, সেই কংগ্রেস কিনা বিজেপির কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে এখণ গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার করছে। অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সে গর্তে যে একসময় নিজেকেই পড়তে হয়, এই চিরন্তন কথাটি এখন কংগ্রেসের জন্য অতিবাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে গর্তে ফেলে একই ধরনের গর্তে পড়ে সে এখন আফসোস করছে। বিজেপির দোর্দান্ড প্রতাপের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে কংগ্রেস নেত্রী এবং ভারতের ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) চেয়ারপারসন সোনিয়ে গান্ধীকে বলতে হচ্ছে, ‘গণতন্ত্র মানে বিক্ষোভ-বিতর্ক। গণতন্ত্র মানে একতরফা বলে যাওয়া নয়। বিজেপিকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেছেন, মানুষ এখন ভয়ের আবহে বেঁচে আছে। বিরুদ্ধ স্বর থামিয়ে দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মদদে নজরদারি বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। সমাজে, সমাজে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে স্রেফ নির্বাচনে জেতার প্রয়োজনে। বিচারব্যবস্থা টলমল করছে। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেছেন, সংসদে যদি আমাদের বলতেই না দেয়া হয়, তাহলে সংসদ চালু রাখার দরকার কী? সংসদ বন্ধ করে দিলেই হয়? আমাদের স্বাধীনতার গলা টিপে ধরা হচ্ছে। দমন-পীড়নকে আঁকড়ে ধরা হচ্ছে।’ সোনিয়া গান্ধীর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যেন বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার ধরণ এবং গণতন্ত্রকামী মানুষের হাহাকারই প্রতিধ্বণিত হচ্ছে। বাস্তবিকই দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিজেপির শাসন পদ্ধতি আর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে খুবই মিল রয়েছে, যেখানে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অত্যন্ত সীমিত করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে দলন-পীড়ন ও জুলুমের শিকার হতে হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ এ ধরনের শাসন প্রক্রিয়া উপভোগ এবং তার স্বাদ আস্বাদন করে চলেছে। ক্ষমতার এ স্বাদ থেকে তার বের হয়ে আসা তার পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনে এই স্বাদ ধরে রাখার জন্য তার পোষ্য দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আরেকটি লোক দেখানো নির্বাচন করার প্রতিই তার আগ্রহ বেশি।
চার.
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারাটিই বদলে দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে যদি দলটি ৫ জানুয়ারির মতোই একটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসে, তাহলে রাজনীতির ধারাটি কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে তা বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা যায়, আওয়ামী লীগ দেশে কোনো বিরোধী দল থাকতে দেবে না। একেবারেই নির্মূল করে ফেলবে। ইতোমধ্যে দলটির পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে না এলে বিএনপির পরিণতি হবে মুসলিম লীগের মতো অস্তিত্বহীন। আবার যদি অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ কারণেই দলটি তার অধীনে এবং সংসদ ভেঙে না দিয়ে নির্বাচন করতে বদ্ধ পরিকর। দলটি ভাল করেই জানে, এ ব্যবস্থা ছাড়া নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে না। তখন যদি বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসে এবং সে যদি না-ও চায়, তারপরও আওয়ামী লীগের উপর দিয়ে কম-বেশি একটা ঝড় বয়ে যাবে। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর জীবনহানি হবে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল বাঘের পিঠে চড়ে বসার মতো পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। না পারছে নামতে, না পারছে বসে থাকতে। এই জটিল পরিস্থিতিতে এবং আগামী নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়, তবে অনেকে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। যদি তাই হয়, তাহলেও কি ক্ষমতাসীন দল নিরাপদ থাকতে পারবে? অনেকে মনে করছেন, বিএনপি যদি ক্ষমতায় নাও যায় এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকে, তার পরিবর্তে অন্য যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তখন বিএনপিকেই বেশি শক্তিশালী দেখাবে। তখন আজকের বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চালানো নির্যাতনের চিত্র যদি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তবে অবাক বা নির্বাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ ইতিহাস নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি করে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন