গণতন্ত্রের পরীক্ষায় বাংলাদেশ কোনো সময় উত্তীর্ণ হয়েছে কোনো সময় ব্যর্থ হয়েছে। ওইরূপ উত্তীর্ণ হওয়ার সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে থেকে বন্ধুপ্রতিম শক্তিও অবদান রেখেছে। অনুরূপভাবে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলোতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে থেকে বন্ধুপ্রতিম শক্তিও ওইরূপ ব্যর্থতায় অবদান রেখেছে। ২০১৮ সাল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য কঠিন বছর। গণতন্ত্রকে যেভাবে আমরা এই দেশের মাটিতে চিনে আসছি সেই ১৯৩৬ সাল থেকে, সেটার সাদামাটা বর্ণনা হলো : মানুষ ভোট দেবে, অনেক প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেবে, বিজয়ী প্রার্থীরা ও তাদের দল বাংলাদেশ শাসন করবে। এরূপ গণতন্ত্র বাংলাদেশে হোঁচট খেয়েছে।
শুরুটা ভালোই ছিল। ১৯৭২ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণকে দিয়েই সংবিধান রচনা করা হলো; ১৯৭২ সালেই সেই সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হলো। যেখানে পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রায় আট বছর লেগেছিল সেখানে এক বছরের মাথায় সংবিধান পাওয়া বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য একটি বড় সাফল্য ছিল। ১৯৭৩ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচন হলো। বেশ কয়েকটি আসনে দারুণ সাহসী ও ঐতিহাসিক কারচুপি হলো; যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, কারচুপিবিহীনভাবে যেসব আসনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছিল সেগুলোতেও আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু তার সরকারের সাফল্য ছিল সীমিত; এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দায়ী, এর পেছনে বঙ্গবন্ধুর নিজ দলের মানুষের দুর্নীতি ও অদক্ষতা দায়ী, এর পেছনে প্রকৃতি বা ন্যাচার দায়ী এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে মানুষের আশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল পার্থক্য দায়ী। দেশ শাসনে বা দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা মেটানোর ওইরূপ ঐতিহাসিক ব্যর্থতার ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্য অথবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক না কেন, সেই বঙ্গবন্ধু নিজেই বহুদলীয় গণতন্ত্র নিস্তব্ধ করে দিলেন এবং একদলীয় শাসন কায়েম করলেন; গণতন্ত্রের ওপর এই প্রথম আক্রমণের তারিখটি ছিল ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। এটা ছিল প্রথম আঘাত। দ্বিতীয় আঘাত এলো ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ, যে দিন বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন; এই হত্যাকাÐ ও রক্তাক্ত পদ্ধতিতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং তার ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের বা বাকশালীয় বন্ধুরা। মোশতাক মার্শাল ল বা সামরিক আইন জারি করেছিলেন। মোশতাকের সরকার বাকশাল কায়েম রাখত কী রাখত না এটা বলা মুশকিল, মোশতাকের সরকার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যেত কী যেতেন না সেটাও বলা মুশকিল। মোশতাকের সরকার আসলে কোন রাজনৈতিক সড়ক অবলম্বন করত সেটা বলা মুশকিল। কোনো কিছু ডিসাইড বা ফয়সালা বা চিহ্নিত হওয়ার আগেই এসে যায় নভেম্বরের ৩ তারিখের সামরিক কু-দ্য-তা; তিন দিন সরকারবিহীন থাকার পর একটি সরকার এসেছিল ৫ তারিখ সন্ধ্যায়। কিন্তু এই নতুন বা অভিনব সরকার দায়িত্ব নেয়ার ৩৬ ঘণ্টার মাথায় আসে ৭ নভেম্বর। আমি ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের কথা বলছি। অতঃপর মোশতাক কর্তৃক জারি করা সামরিক শাসন আক্ষরিক অর্থেই বাস্তবায়ন হওয়া শুরু হলো।
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চার বছর মারাত্মক ঘটনাবহুল ছিল। মানুষের শরীর থেকে যেমন রক্ত বেরিয়েছে, গণতন্ত্রের শরীর থেকেও রক্ত বেরিয়েছে। এই অবস্থান থেকে অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের শুরু থেকে যদি আমরা ভিন্ন বাংলাদেশ চিন্তা করি, সেই বাংলাদেশের নতুন কাÐারি হলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরূপ বাংলাদেশ তথা বাকশালবিহীন বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ, সামরিক শাসনের অধীন বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক পরিবেশবিহীন বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটানো ছিল একটি মারাত্মক কঠিন কাজ। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই সম্পন্ন করেছিলেন তৎকালীন জেনারেল জিয়াউর রহমান। যে দিন তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সে দিন থেকে তিনি অবসরে গেলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র আবারো চালু হলো ১৯৭৮-এ এবং চলল ১৯৮২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। কিন্তু এর মধ্যেই ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩০ তারিখ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। এই হত্যাকাÐের ও কল্পিত পরিবর্তনের নীলনকশার হোতা, প্রকাশ্যে ছিলেন মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, প্রেসিডেন্ট নিহত হলেও প্রেসিডেন্টের দল, অর্থাৎ তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, স্বাভাবিক রাজনীতি বজায় রাখে এবং বাংলাদেশের জন্য একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার বন্দোবস্ত করে। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে আসে গণতন্ত্রের ওপর আরেকটি আক্রমণ। ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান (লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিলেন এবং বাংলাদেশে নতুন করে সামরিক শাসন জারি করলেন। এটা ছিল গণতন্ত্রের ওপর দ্বিতীয় প্রধান আঘাত।
১৯৮৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের তৃতীয় যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৬ সালেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজনীতির মেরুকরণ সুস্পষ্ট হওয়া শুরু করে। অর্থাৎ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী লীগ জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়ে পক্ষভুক্ত করল। তখন দেখা গেল যে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এক পক্ষে, জাতীয়তাবাদী দল আরেক পক্ষে, অন্য দলগুলো তৃতীয় পক্ষে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় ঢাকা মহানগরের গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ তৎকালীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন থেকে ১৯৯১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের ২৭ তারিখ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর সংসদ মিলিত হওয়া পর্যন্ত সময়টি ছিল প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রথম তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রত্যক্ষ শাসন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের শাসনকে প্রত্যক্ষভাবে এবং আন্তরিকভাবে সহায়তা করেছিল বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র। বেগম জিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশ তখনো সংবিধান মোতাবেক চলছিল প্রেসিডেনসিয়াল ফরম অব গভর্নমেন্ট বা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে। তাই ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে, নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের বাইরের এবং ভেতরের সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে পার্লামেন্ট কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয় এবং ওই সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের তথা পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসি বা সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়।
১৯৯৫-৯৬ সালে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল। ঘটনাবহুল বাংলাদেশে অনেক ঘটনার ভিড়ে ১৯৯৬ সালের মে মাসের ঘটনা আজকের পাঠক প্রায় ভুলে গেছেন। যদি ঘটতেই হতো, তাহলে ঘটনা ঘটার কথা ছিল ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারিতে, কিন্তু সেই ঘটনা ঘটল মে মাসের ২০ তারিখে। সেটি ছিল গণতন্ত্রের ওপর একটি ব্যর্থ আঘাত। ওই উপাখ্যান আজ বলব না। যা হোক, আন্দোলন, প্রতি-আন্দোলন ইত্যাদির শেষে, পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয়েছিল এবং ১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৯৬ নতুন নির্বাচন হয়েছিল। নবনির্বাচিত সংসদ মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে শুধু নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য তত্ত¡াবধায়ক পদ্ধতির সরকার বহাল করে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে এই পদ্ধতির ওপর আঘাত আসে; এই আঘাত পরিপক্ব হয় ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ। এই আঘাতকে সমর্থন দিয়েই নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে, শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। সে দিন থেকে আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা শুরু, নতুন উদ্যমে, নতুন বুদ্ধিতে, নতুন বন্ধুসহ, নতুন লক্ষ্যে, নতুন উদ্দেশ্যে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, তার আগেকার এক বছরের ঘটনাবলি এবং পরবর্তী তিন সপ্তাহের ঘটনাবলি আমি আজ আলোচনা করছি না। উপরের তিনটি অনুচ্ছেদে এবং এই অনুচ্ছেদসহ মোট চারটি অনুচ্ছেদে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন বা ক্ষমতার পরিবর্তনের মুহূর্তগুলোকে চিহ্নিত করে উল্লেখ করেছি।
চলমান ২০১৮ সাল বাংলাদেশের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যকার শুধুমাত্র রাজনৈতিক দ্ব›েদ্বর বছর বললে ভুল হবে। তাহলে আর কিসের দ্ব›দ্ব? যেই দ্ব›দ্বগুলোর কথা উল্লেখ করতে চাই, তার মধ্যে কয়েকটি হলো নি¤œরূপ: এক. বাংলাদেশে চর্চার জন্য গণতন্ত্রের নতুন রূপ কী হবে তথা একদলীয় নাকি সীমিত বহুদলীয় নাকি উন্মুক্ত বহুদলীয়, তা নিয়ে দ্ব›দ্ব। দুই. যেহেতু বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক শিবিরগুলো কর্তৃক অভ্যাসকৃত রাজনৈতিক দর্শনগুলো শতভাগ পরস্পরের সম্পূরক নয় তাই, গণতন্ত্রের মূল দর্শন কী হবে সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব। তিন. বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া নামক অঞ্চলে, বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে সেই নিয়ে দ্ব›দ্ব। চার. মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এরূপ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় তথা ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরই; এই প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে সেই নিয়ে দ্ব›দ্ব।
আমি পাঠকের সচেতন দৃষ্টি আকর্ষণ করছি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ নেপালের প্রতি। রাজতন্ত্র দূর করার জন্য বহু বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে একটি দল। অতঃপর সাফল্য এসেছে। রাজতন্ত্রবিহীন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি সহায়ক এমন সংবিধান রচনায় সময় নিয়েছে বহু বছর। বিগত বহু মাস ধরে টানাপড়েনের পর, অতি স¤প্রতি একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। দেশটির সংবিধানের কয়েকটি বিধান নিয়ে প্রতিবেশী ভারত বিরূপ মনোভাব ধারণ ও প্রকাশ করে। এরূপ প্রেক্ষাপটে নেপালের সাথে রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি হয় ভারতের। ল্যান্ড লকড বা চতুর্দিকে ভূবেষ্টিত পাহাড়ি দেশ নেপাল বিস্তৃতভাবেই নির্ভরশীল ছিল ভারতের সাথে বাণিজ্যের ওপর। সেই ভারত নেপালের সীমান্তে অবরোধ করার কারণে চার মাসের অধিককাল নেপাল অবরুদ্ধ ছিল; শত কষ্ট সত্তে¡ও নেপালি জনগণ ও নেপালি রাজনীতিবিদেরা ভারতীয় এই জিম্মিনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। সেই সময় নেপাল নামক দেশটির অভ্যন্তরে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন চলছিল চরমভাবে; কিন্তু জাতীয় স্বার্থে কোনো দলই গোপনে ভারতের সাথে আপস করেনি। নতুনভাবে নির্বাচিত এবং ক্ষমতায় যাওয়া সরকারও ভারতের সাথে আপস করেনি। প্রায় শতভাগ ভারতের সাথে বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য নেপাল অতি দ্রæত এবং অতি জোরালো উদ্যোগ নেয় চীনের সাথে রাস্তা খোলার; বাণিজ্যিক রাস্তা খোলার। চীন উদারভাবে এগিয়ে আসে। নেপালের দক্ষিণের প্রতিবেশী যেমন ভারত তেমনিই নেপালের উত্তরের প্রতিবেশী চীন। নেপালের দক্ষিণের প্রতিবেশীর সাথে সীমান্ত এলাকাটি জনবহুল ও সমতল প্রকৃতির। নেপালের উত্তরের প্রতিবেশীর সাথে সীমান্ত এলাকাটি জনবহুল নয় এবং অসমতল প্রকৃতির। এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই নেপাল নিজের অস্তিত্ব রক্ষার পন্থা বের করে নেয়।
আজ থেকে দু’চার সপ্তাহ আগেই দক্ষিণ এশিয়া বা সার্ক নামক গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য মালদ্বীপ মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দিন পার করে। মালদ্বীপের ভেতরে দ্ব›দ্ব হচ্ছে এরূপ: চলমান ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এবং তার দল ক্ষমতায় থাকতে চায়, সদ্য অতীতে ক্ষমতায় ছিল কিন্তু এখন ক্ষমতা থেকে দূরে এবং দেশ থেকে নির্বাসিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার দল নতুনভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়। মালদ্বীপকে তাদের বলয়ে নেয়ার জন্য চীন এবং ভারত উদগ্রীব ও সক্রিয়। সা¤প্রতিক সঙ্কটে চীন পাশে ছিল; মালদ্বীপের বর্তমান সরকার টিকে যায়।
শ্রীলঙ্কার উত্তর অঞ্চলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিদ্রোহ ছিল। এলটিটিই বা তামিলদের একটি দল যাদের নেতা ছিল প্রভাকরণ; তারা শ্রীলঙ্কা থেকে আলাদা হয়ে নতুন রাষ্ট্র করতে চেয়েছিল। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে, ভারত সরকার ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি বিরাট দলকে শ্রীলঙ্কায় অবতরণ করিয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দিয়েছিল শান্তিরক্ষী বাহিনী। ওই ভারতীয় তথাকথিত শান্তিরক্ষী বাহিনী, শুধু এক পক্ষ নয় অনেক পক্ষের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে ও আক্রান্ত হয় এবং বিপর্যস্ত হয়। অতঃপর ভারত সরকার নীতি বদলিয়েছিল। এলটিটিই বা তামিলদের সশস্ত্র সংগ্রামে সর্বোত সহায়তা দিয়েছিল ভারত সরকার, কিন্তু অবশ্যই গোপনে। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ অংশে চীনের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তায় ভীষণ বড় একটি ডিপ-সি-পোর্ট বা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে এবং তার নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, শ্রীলঙ্কার আগামী নির্বাচনে, চীনের প্রতি দুর্বল এমন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিই আবার ক্ষমতায় আসবে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় মুসলমান স¤প্রদায়ের ওপরে, উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ কঠোর ও মারাত্মক হামলা শুরু করে। এ ঘটনাকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনের সফল প্রক্রিয়ার বাই-প্রোডাক্ট বলে মনে করা হয়; বিদেশী কোনো উসকানি এই আক্রমণের পেছনে আছে কি না সেটা নিয়ে আজ আলোচনা করছি না।
উপরের তিনটি অনুচ্ছেদে আমি নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার আলোচনা করেছি। এখন কয়েকটি লাইনে মিয়ানমার প্রসঙ্গটি সামনে আনছি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সেই রাজনীতির প্রভাব আমাদের ওপর কী প্রকারের হতে পারে বা হচ্ছে সেটি নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দীর্ঘ আলোচনার বিষয়, কিন্তু এই কলামে অতি সংক্ষিপ্তভাবে করতেই বাধ্য হচ্ছি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে গণতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়ে আলিঙ্গন করলেও বাস্তবে গ্রহণ করেনি। মিয়ানমারের অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জাতিগোষ্ঠী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। ক্ষমতাসীন জাতিগোষ্ঠী এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সামরিক বাহিনী উভয়ে মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমার একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক. তারা একগুয়েমির পথ বেছে নেবে, দুই. তারা সামরিকতন্ত্রের পথ বেছে নেবে, তিন. তারা একাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করবে হয় থাইল্যান্ডের দিকে অথবা বাংলাদেশের দিকে, চার. তারা নিজেদের দেশের সম্পদকে বিদেশের হাতে উন্মুক্তভাবে ও নিঃশর্তভাবে তুলে দেবে না। পাঁচ. প্রতিবেশী চীন ও ভারতের সাথে যুগপৎ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে এবং কোনো প্রকারের দ্ব›েদ্বর আবির্ভাব হলে চীনের পক্ষ নেবে। ছয়. অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে তারা চীন এবং ভারত উভয়কেই তাদের ভূখÐ এবং রাখাইন প্রদেশসংলগ্ন সমুদ্রসীমা ব্যবহারের সুযোগ দেবে। সাত. মিয়ানমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করবে। আমি নিশ্চিতভাবে জানি না যে, মিয়ানমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কি না বা এই মুহূর্তেও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি না: বাংলাদেশের ভূখÐে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য।
বাংলাদেশের জন্য ২০১৮ সালটি একাধিক প্রকারের দ্ব›েদ্বর বৈশিষ্ট্যমÐিত। কিঞ্চিৎ আলোচনা উপরের একটি অনুচ্ছেদে করা হয়েছে; বিস্তারিত করা হয়নি; আগামী দিনে করা হবে, ইনশা আল্লাহ। ওই দ্ব›দ্বগুলোর সাথে অবশ্যই আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর ভূমিকা (ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স) জড়িত, আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নামক ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে, আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলো (রিজিওনাল পলিটিক্স) জড়িত, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্ব›দ্ব (কালচারাল কনফ্লিক্ট) জড়িত। সে জন্যই উপরের কয়েকটি অনুচ্ছেদে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমার নামক চারটি দেশের নাম নিয়ে আলোচনা করলাম।
সা¤প্রতিক বাংলাদেশের তথা আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও মানুষকে নিয়ে আমার চিন্তার কিঞ্চিৎ বহিঃপ্রকাশ করেছি। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কলামগুরোতে এই বহিঃপ্রকাশ আছে। এটা মার্চ মাস। ঐতিহাসিক মাস। গর্বের মাস, অনুরাগের মাস, অনুভূতি নবায়নের মাস এবং প্রত্যয় উদ্দীপ্ত করার মাস। স্বাধীনতার মাস মার্চ, এই মার্চ মাস স্বাভাবিকভাবেই ডিমান্ড করে যে, আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে, বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করি। নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ইশারা-ইঙ্গিত-লক্ষণ আমাকে বাধ্য করছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে। তাই আমি লিখলাম। হঠাৎ করে, আগে-পিছে কোনো ভূমিকা বা ব্যাখ্যা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা, কোনো স্থানে উল্লেখ করলে, সেটি অরণ্যে রোদন হয়। তাই একাধিক পত্রিকায় কলাম লিখেছি বা লিখছি।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন