শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

উন্নয়নের রূপকল্প : প্রচারণা ও বাস্তবতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিনত হওয়ার প্রথম ধাপ উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। গত কয়েক দশকে বিশ্বের বহুদেশ এই ধাপগুলো অতিক্রম করে এলডিসি থেকে ডেভেলপিং, মিডিয়াম ইনকাম এবং ডেভেলপ্ড কান্ট্রিতে উর্ত্তীণ হয়েছে। এবারের ইউএনডিপির নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নি¤œমধ্য আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের নাম এসেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও মিয়ানমার, নেপাল ও ভ’টান রয়েছে এই তালিকায়। এর মধ্যে নেপাল ও ভ’টান নি¤œ মধ্য আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করলেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রমের সময় নির্ধারিত হয়েছে ২০২১ সাল এবং সবকিছু ঠিক থাকলে চুড়ান্ত ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি লাভ করবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিনত হতে আরো অন্তত ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। সে পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে এই মুহূর্তে মানুষের সংশয় ও উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। তবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় এগিয়ে চলা ইউএনডিপি’র রোডম্যাপে শামিল হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার ৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে এই রোডম্যাপ বা স্বীকৃতি নিয়ে তেমন কোন আওয়াজ হয়নি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, তারা এ ধরনের স্বীকৃতিকে বড় কোন অর্জন হিসেবে গণ্য করেনি। করেনি বলেই তা জাতীয়ভাবে উদযাপন বা সেলিব্রেশনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি।এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশ লাওস বা লাও পিডিআর এ বছর এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারা এ অর্জনকে সেলিব্রেশন করেছে বলে কোন রির্পোট পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে আমাদের দেশে এই স্বীকৃতিকে ঘটা করে জাতীয়ভাবে উৎযাপন করা হয়েছে। সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারী অফিস এবং সরকারীদলের পক্ষ থেকে একে বিশাল অর্জন হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। এ উপলক্ষে আয়োজিত ৭দিনব্যাপী উৎসবের শুরুর দিনটি ছিল নগরবাসির জন্য কিছুটা বিব্রতকর। একটি সরকারী ঘোষনায় বলা হয়েছিল, স্বল্পন্নোত থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পর্দাপণের সাফল্য উৎযাপনের অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার স্বার্থে নগরীতে কেউ এদিন রাস্তায় ব্যাগ বহন করতে পারবেনা। পরবর্তিতে অবশ্য ঘোষণাটি কিছুটা সংশোধন করে বলা হয়, শুধুমাত্র অনুষ্ঠান বা সমাবেশ স্থলে কেউ ব্যাগ বহন করতে পারবেনা। সরকারী নির্দেশনায় অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবেই এই অর্জনের ‘ঐতিহাসিক সাফল্য উৎযাপন’করা হয়েছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কার্যত: শ্রেণীকক্ষের পাঠদান ব্যহত করেই এই উৎযাপন সম্পন্ন হয়েছে। দেশের হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় ভবন ও শ্রেনীকক্ষ নেই। হাজার হাজার বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। ক’দিন আগেও হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও ও সরকারী স্বীকৃতির জন্য ঢাকার রাজপথে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরণ অনশন করে রিক্ত হাতে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর গত আট বছরে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে পারছেনা সরকার। উপরন্তু শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট, প্রাতিষ্ঠানিক মুনাফাবাজি, বৈষম্য এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস নজিরবিহীনভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠায় পাবলিক পরীক্ষা ও শিক্ষার মান চরমভাবে অধ:পতিত হয়ে পড়েছে। গত দশ বছরে বল্গাহীনভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি, বইয়ের বোঝা, কোচিং ফি, পরীক্ষা ফি বাড়ার পাশাপাশি বছরে শতকরা কমপক্ষে ৭ ভাগ হারে মূল্যস্ফীতি বা পণ্যমূল্য বেড়েছে। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ায় ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ধকল সামলে সন্তানের লেখাপড়া ও দৈনন্দিন খরচাপাতির যোগান দেয়া সাধারণ মানুষের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এহেন বাস্তবতায় শিশুদেরকে দেশ উন্নত হওয়ার গল্প শোনানো হচ্ছে। অবশ্য দেশের পুলিশ বাহিনী, সরকারী কর্মকর্তা ও এমপি, মন্ত্রীদের বেতন কয়েক ধাপে বাড়ানো হয়েছে। সেই সাথে এমপি-মন্ত্রীসহ সরকারী দলের একশ্রেণীর প্রভাবশালী নেতাকর্মীর আয় গত এক দশকে হাজার হাজার গুণ বেড়ে আঙুল ফুলে বটগাছ হয়ে গেছে। শেয়ার বাজার থেকে, সরকারী ব্যাংক থেকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে কিছু মানুষ ধনকুবের বনে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্য বেড়ে গিয়ে কিছু মানুষ নি¤œ আয় থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার বাস্তবতা সামনে রেখেই বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনের প্রথম ধাপে পৌঁছার স্বীকৃতি দেশের ভুক্তভোগি মানুষের কাছে পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেদিন ঢাকায় যখন জাঁকজমকের সাথে বিপুল উৎসব আয়োজনে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের প্রথম ধাপ অতিক্রমণের আনন্দ র‌্যালী পালিত হচ্ছিল, তখন ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর ডেস্কে একটি গতানুগতিক সংবাদ উঠে আসে, তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক জরিপে বাংলাদেশের রাজধানী শহরটি আবারো বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহরের তালিকায় উঠে এসেছে। এই সংবাদটি গতানুগতিক এ কারণে যে, বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘুরে ফিরে ঢাকা শহর বিশ্বের এক বা দুই নম্বর দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। আমাদের সরকার এবং নগরকর্তারা ঢাকার যানজট নিরসন বা শহরকে দূষণমুক্ত ও বসবাসের জন্য পরিবেশবান্ধব করতে ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছেন। এই সংবাদের এক সপ্তাহ আগে ঢাকার সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দু’টি পরস্পরবিরোধী সংবাদে সরগরম হয়ে উঠেছিল। এর একটি হচ্ছে, দ্য স্টাটেসটিক্স ইন্টারন্যাশনাল নামের কথিত সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ৫০ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ- সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভূষিত করেছে। এ তালিকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম স্থান পেয়েছে বলে জানা যায়। এ সংবাদের ভিত্তিতে মন্ত্রীপরিষদের নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দিত করার সংবাদটি পরের দিন বেশকিছু দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়। যদিও পরবর্তিতে কথিত গবেষনা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নিয়ে নানা বির্তক দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুসন্ধানী তথ্য ও নানা বিশ্লেষণের পাশাপাশি মনিটর নিউজ নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনাকে দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রীর খেতাব দেয়ার কথিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান দ্য স্টাটিসটিক্স ইন্টারন্যাশনালসহ পরিবেশিত সংবাদটি ভ’য়া। এ ধরনের সংবাদ নি:সন্দেহে দেশের জন্য গর্বের, আনন্দের। তবে মন্ত্রী পরিষদের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দিত করার আগে তথ্য যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি! এ ধরনের ঘটনা শুধু প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের জন্যই বিব্রতকর নয়, পুরো জাতির জন্যই বিব্রতকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার খবরের রেশ কাটতে না কাটতেই দ্য টপ টেন্স নামের একটি জরিপ প্রতিষ্ঠান রোমান সা¤্রাজ্য থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্বের ৫০ জন স্বৈরাচারী শাসকের তালিকায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী এক নম্বরে স্থান পেয়েছেন। দ্য স্টাটিসটিক্সের মত দ্য টপটেন কোন অস্তিত্বহীন সংস্থা না হলেও এ ধরনের সংস্থার জরিপ নিয়ে মাতামাতি করার কোন যুক্তি নেই। আমাদের দেশ ও সরকারের অবস্থা এদেশের মানুষই ভালো জানে এবং বোঝে, বিদেশিদের মতামত নিয়ে দেশের সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বেশী উল্লসিত, আহ্লাদিত, বিক্ষুব্ধ বা হতাশ না হওয়াই উত্তম।
বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হতে দুইটি ধাপে আরো ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সীমারেখা এখন এক ধরনের আলঙ্কারিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোসাইটি ফর স্টাডি অব রিপ্রোডাকশন(এসএসআর) নামের একটি অনলাইন পোর্টালে ২০১৭ সালের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে ১৪০ দেশের নামের তালিকায় বাংলাদেশকেও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এমনকি সোমালিয়া, রুয়ান্ডা, ইথিওপিয়া,উগান্ডা, কেনিয়া, ইয়েমেন, কঙ্গো, জিম্বাবুয়ের মত দেশও এই তালিকাভুক্ত। যদিও অর্থনৈতিক অবস্থানগত শ্রেণীবিভাজনে এসব দেশকে লো-ইনকাম কান্ট্রিজ(১০২৫ ডলার বা তার নিচে), লোয়ার মিডল ইনকাম কান্ট্রিজ(১০২৬-৪০৩৫ ডলার) এবং আপার মিডল ইনকাম কান্ট্রিজ(৪০৩৬- ১২০৭৫ডলার) এমন তিনভাগে বিন্যাস্ত করা হয়। অর্থাৎ শ্রেণীভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থায় অনেক বেশী পার্থক্য থাকতে পারে। তবে অর্থনৈতিক অবস্থানকেই রাষ্ট্রের বড় অর্জন হিসেব গণ্য করার সুযোগ নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জিডিপি পার ক্যাপিটা হিসেবে কাতার বিশ্বের একনম্বর ধনী রাষ্ট্র হলেও সে ইরান বা তুরস্কের মত উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র নয়। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইরান, তুরস্ক,ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে একই তালিকাভুক্ত হলেও অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এসব দেশের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিন এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ মালদ্বীপ অনেক আগেই উন্নয়নশীলের সীমা ডিঙিয়ে মধ্য আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে। এমনকি ভ’টান ও নেপাল উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি লাভের জন্য এ বছর দ্বিতীয় ধাপের সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি, নেপাল,ভ’টান মিয়ানমার বা লাওস উন্নয়নশীল দেশে পর্দাপনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ক্রাইটেরিয়া অর্জনকে সেলিব্রেট না করলেও বাংলাদেশে সপ্তাহ ধরে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের সরকারী আনন্দ উদযাপন চলেছে। অনেক হতাশা ও নেতিবাচক সংবাদের মধ্যেও এটুকু অর্জনের আনন্দ আয়োজনকে আমরা খাটো করে দেখতে চাইনা। এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ অসাধ্য সাধন করতে জানে। দেশের সরকার এবং রাজনৈতিকদলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক বৈরিতা, হানাহানি, দুর্নীতি, লুটপাট ও অপশাসনে লিপ্ত না হলে বাংলাদেশ হয়তো বহু আগেই উচ্চমধ্য আয়ের দেশে পরিনত হতে পারত। ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তার সফরের সময় ঢাকার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি মূল্যায়ণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে অনেক দিক থেকেই ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। চার-পাঁচ দশক আগে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডও বাংলাদেশের সমকক্ষ ছিল। পাকিস্তানের সাথে ৯ মাস যুদ্ধ করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রায় ২০ বছর লড়াই করে লন্ডভন্ড, বিদ্ধস্ত ভিয়েতনাম সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে যুদ্ধ থামার পর ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে একটি অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক নানা জরিপে স্বীকৃত হচ্ছে। গোল্ডম্যান স্যাাক্স, প্রাইসওয়াটার কুপার্স-এর মত অর্থনৈতিক জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর ফোরকাস্ট হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ভিয়েতনাম বিশ্বের সবচে দ্রæতগতির প্রবৃদ্ধিসম্পন্ন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটি নরওয়ে বা সিঙ্গাপুরের উন্নয়নকে ছাড়িয়ে যাবে। উর্বরা শস্যভ’মি, পরিশ্রমী বিশাল জনগোষ্ঠি এবং ভ’-রাজনৈতিক অবস্থানের কারনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ভিয়েতনামের তুলনায় মোটেও কম নয়। তবে পার্থক্য হচ্ছে, ভিয়েতনাম অতীত ভুলে ভবিষ্যতমুখী রাজনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে, আর বাংলাদেশ বিভক্তি, বিভেদ-বৈরিতার অতীতমুখী রাজনীতিকে ঘৃনা, প্রতিশোধ পরায়ণ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক হানাহানির রাজনীতিতে পরিনত করে সব সম্ভাবনাকে নস্যাত করে চলেছে।
স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঐতিহাসিক মাস এই মার্চে একদিকে দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশশীল হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের সুখবর পেয়েছে। অন্যদিকে সরকারের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষ-বিপক্ষে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জরিপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যা জাতিকে আবারো রাজনৈতিভাবে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। এর কয়েকটি কথা নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি। আমাদের ভুৃলে গেলে চলবেনা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রতি এদেশের মানুষের গভীর আস্থা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মূল আকাঙ্খাই ছিল একটি উদার, উন্নত ও বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। একাত্তরের পর সাড়ে চার দশক পেরিয়ে আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন আন্তর্জাতিক গবেষনা জরিপে নতুন করে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশ! আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং গণতন্ত্রকামী জনগনের জন্য এটি অনেক বড় ধাক্কা। জার্মানী ভিত্তিক একটি গবেষনা প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’য়ের জরিপে বিশ্বের ১২৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ ৫টি দেশ এ বছর স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় স্থান লাভ করেছে। বিবিসি বাংলার বরাতে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটির শুরুতেই বলা হয়, বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যুনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছেনা। জার্মান সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদন তৈরীর ক্ষেত্রে দেশে রাজনৈতিক দমন পীড়ন, পুলিশি নির্যাতন, গুম-খুন ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশকে মূল উপাত্ত হিসেবে তুলে ধরেছে। দেশে উন্নয়ন-অগ্রগতির কথিত রোডম্যাপ, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সক্ষমতার প্রথম ধাপ অতিক্রমণের যোগ্যতার স্বীকৃতি আমাদেরকে যেমন আনন্দিত ও আশান্বিত করে, তেমনি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন থেকে ক্রমশ বিচ্যুত হওয়ার বাস্তবতা জাতিকে হতাশ ও বিমর্ষ করে তোলে।
এবার চলতি সপ্তাহে আরেকটি বিদেশি জরিপ রিপোর্টের সংবাদ দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা গাল্ফ নিউজ বিশ্বের ২০জন সম্ভাবনাময় ও প্রভাবশালী তরুন রাজনৈতিক নেতার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় এক নম্বরে স্থান পেয়েছেন সউদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান, দ্বিতীয় হয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদিদল (বিএনপি)’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট যুক্তরাজ্য প্রবাসী নেতা তারেক রহমান। আর তালিকার সর্বশেষ বা ২০তম অবস্থান লাভ করেছেন, শেখ হাসিনাপুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়। লক্ষনীয় হচ্ছে ভারতের বৃহত্তম ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী এ তালিকায় তৃতীয় স্থান লাভ করেছেন। দুর্নীত মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হওয়ার পর বিএনপি ভেঙ্গে যাওয়ার সমুহ আশঙ্কা থাকলেও তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে চরম দুর্দিনেও দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বলে গাল্প নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অন্যদিকে সজিব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে বলা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প গ্রহণ ও বিনির্মানে সজিব ওয়াজেদ জয় গুরুত্বপূর্ণ ও অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছেন। গাল্ফ নিউজের ২০জন তরুন সুযোগ্য ও সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের তালিকায় বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই তরুণ নেতার মূল্যায়ণ আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। তবে ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রবণ অতীতমুখী রাজনীতি বন্ধ করে ভবিষ্যতের কল্যানমুখী, সকল রাজনৈতিক শক্তির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনীতি শুরু করতে না পারলে বাংলাদেশের সব সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। গণতন্ত্র, সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সমান্তরালভাবে হাত ধরাধরি করে চলে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অর্জন করা সম্ভব নয়, তা জনগনের কাঙ্খিতও নয়।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Ali Akbar ২৮ মার্চ, ২০১৮, ১১:৫২ এএম says : 0
দেশের উন্নয়ন হই নাই হয়েচে আওয়ামী .......... দের।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন