ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম ও কোফরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ ছিল ‘ইয়ামামা’র যুদ্ধ। ভুয়া নবীর অনুসারীদের সঙ্গে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সিদ্দিকী খেলাফত আমলে সংঘটিত এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পূর্বে মুসলমানদের এরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন আর কখনো হতে হয়নি। কয়েক দিনের ভীষণ যুদ্ধের পর মুসলমানদের বিজয় সূচিত হয় এবং ভুয়া নবী ‘মোসায়লামাতুল কাজ্জাব’ ও তার অনুসারীরা নিহত হয় এবং ইয়ামামা এলাকার একটি সুরক্ষিত বাগানে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলে এ স্থানের নামকরণ করা হয় ‘হাদিকাতুল মওত’ বা মৃত্যুর বাগান। এটি ছিল হিজরি ১১-১২ সাল মোতাবেক ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।
বীর সিপাহসালার হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) এ যুদ্ধ বিজয়ে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন, যা ইসলামের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁর সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলে রাখা দরকার যে, তাঁর বাহিনীর মধ্যে তার অসাধারণ নেতৃত্বের প্রভাব এমন ব্যাপক ছিল যে, শত্রæপক্ষ যখন জানতে পারতো যে, তাদের মোকাবিলার জন্য হজরত খালেদ (রা.) আসছেন, তখন তাদের কলিজা থরথর করে উঠতো এবং তাদের মোকাবিলা করার সাহসই লুপ্ত হয়ে যেতো। এরূপ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) মোরতাদ ও ভুয়া নবীদের নির্মূলে যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তার একটি ছিল মহা মিথ্যাবাদী কুখ্যাত ভন্ড নবী মোসায়লামাতুল কাজ্জাব ও তার ভ্রান্ত অনুসারীদের খতম করা। হজরত ওসামা ইবনে জায়দ (রা.)-এর অভিযান ছিল রসূলুল্লাহ (স.)-এর সর্বশেষ এবং সিদ্দিকী খেলাফত আমলের সর্ব প্রথম অভিযান। সিরিয়া হতে ওসামা বাহিনী বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তনের পর হজরত সিদ্দীকে আকবর (রা.) যে এগারজন সেনাপতির নেতৃত্বে এগারটি বাহিনী গঠন করেন, তার প্রথমটি ছিল হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর বাহিনী। তাঁর প্রতি নির্দেশ ছিল, তিনি প্রথমে খাইবারের আশেপাশে বসবাসকারী বনি আসাদ গোত্রের ভন্ড নবী তালিহা ইবনে খোওয়াইলেদ আসাদীকে দমন করবেন। তাকে দমন করার পর ‘বুতাহ্’ গিয়ে মালেক ইবনে নোওয়াইরা নামক নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারকে দমন করবেন। দ্বিতীয় বাহিনীটি ছিল একরামা ইবনে আবি জাহলের নেতৃত্বে। তাঁকে প্রেরণ করা হয় কাজ্জাব মোসায়লামাকে দমন করার জন্য। তৃতীয় বাহিনীটি ছিল শোরাহবিল ইবনে হাসানার নেতৃত্বে। তাকে একরামার সাহায্যের জন্য প্রেরণ করা হয়। চতুর্থ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মোহাজের ইবনে আবি উমাইয়া। তাকে প্রেরণ করা হয় ‘সানা’-এ আসওয়াদে আনাসীকে দমন করার জন্য। আসওয়াদে নিহত হওয়ার পর মোসায়লামাতুল কাজ্জাবকে দমনের অভিযান শরু হয়।
ইসলামের যুদ্ধ নীতিতে ‘আল-হারবু খেদ আতুন’ বলে একটি কথা আছে। এর অর্থ যুদ্ধ একটি ধোঁকা। আসলে রণক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল বা পরাস্ত করার প্রতিযোগিতায় নানা পন্থা বা কৌশল অবলম্বন রণ নীতিমালার একটি অংশ। যতক্ষণ না প্রতি পক্ষের সাথে কোন চুক্তি সম্পাদিত হবে, সে কৌশল অনুসরণ করার বৈধতা স্বীকৃত রীতি। কেউ সে চুক্তি ভঙ্গ করলে তা হবে বিশ্বাস ঘাতকতার শামিল। ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলিমদের সাথে কাফের বা ইহুদী খ্রিস্টানদের যতগুলো চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল সবগুলো ওরাই ভঙ্গ করে, মুসলমানরা একটিও ভঙ্গ করেনি। মোরতাদ দমনের ক্ষেত্রেও তা লক্ষ করা গিয়েছে। ইয়ামামা যুদ্ধের এক পর্যায়ে হজরত খালেদ (রা.)-এর সামনে মোসায়লামা পড়ে যায়, তখন তার নিকট তিনি কয়েকটি শর্ত পেশ করেন। মোসায়লামা শর্তগুলো মানতে বিলম্ব করতে থাকে। এ সুযোগে খালেদ (রা.) তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে মোসায়লামা পালিয়ে একটি বাগানে চলে যায়। এ আক্রমণ ছিল কৌশলগত, ধোকা নয়।
এবার ইয়ামামা যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখা যাক। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারের ধৃষ্টতাপূর্ণ পত্র এবং খোদ রাসূলুল্লাহ (স.) কর্তৃক তাকে ‘কাজ্জাব’ বা মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করা এবং প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) কর্তৃক মোরতাদ ও ভন্ড নবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও তাদের নির্মূল করার ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে, মোসায়লামাতুল কাজ্জাবরা ক্ষমার অযোগ্য, তাদের উৎপাত, তৎপরতা প্রতিহত করে খতমে নবুয়তের আকিদা-বিশ্বাসকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা মুসলমানদের ঈমানী কর্তব্য। তাই মোসায়লামাতুল কাজ্জাবকে এবং ভন্ড নবীদের স্বরূপ উদঘাটন করাও প্রত্যেক মুসলিম লেখকের একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। ভন্ড নবী মোসায়লামাতুল কাজ্জাবের পরিচয় তুলে ধরার গুরুত্ব এখানেই নিহিত।
আরব-নজদের অন্তর্গত ইয়ামামার একটি প্রসিদ্ধ গোত্রের নাম বনি হানিফা ইবনে লুজাইম। ভন্ড নবী মোসায়লামা এই গোত্রেরই লোক ছিল। যেসব আরব গোত্র মোরতাদ হয়ে যাওয়ার পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে বনি আসাদ, বনি তামিম এবং মোসায়লামাতুল কাজ্জাবের অনুসারী বনি হানিফার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় বনি হানিফার একটি প্রতিনিধি দল তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। গোত্রের নেতা মোসায়লামাও তাদের সঙ্গে ছিল। উপস্থিত লোকদেরকে হুজুর (স.) কিছু উপহার দান করেন এবং তাতে মোসায়লামার অংশও ছিল। সে তার দেশে প্রত্যাবর্তন করে নবুওয়াতের দাবি করে এবং ভন্ড নবী সেজে বসে। অতঃপর সে মদিনায় আসে এবং হুজুর (স.)-এর খেদমতে একখানা পত্র প্রেরণ করে। রাসূলুল্লাহ (স.) তার পত্রের জবাবে তাকে মিথ্যাবাদী বলে সম্বোধন করেন এবং কাজ্জাব তার নামের সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং এটাই তার প্রসিদ্ধ পরিচয়। বনি হানিফা প্রতিনিধি দলের হুজুর (স.)-এর খেদমতে আগমনের ঘটনা প্রসঙ্গে মোসায়লামার কথা ভিন্নভাবেও বর্ণিত হয়েছে। প্রতিনিধি দলের লোকেরা বনি নাজ্জাবের এক মহিলার গৃহে অবস্থান করেছিল। তারা যখন হুজুর (স.)-এর দরবারে উপস্থিত হয় তখন মোসায়লামাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে এনেছিল। সে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে কথা বলে এবং নিজের জন্য কিছু ক্ষমতা চায়। হুজুর (স.)-এর হাতে তখন খেজুরের একটি লাকড়ি ছিল। তিনি বললেন, তুমি যদি এই লাকড়ির টুকরাও চাও তাহলেও আমি তোমাকে দেব না, যতক্ষণ না আল্লাহ অনুমতি দান করেন। তবে ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী, বনি হানিফার প্রতিনিধি দল হুজুর (স.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু তারা যখন ইয়ামামায় প্রত্যাবর্তন করে তখন মোসায়লামা মোরতাদ হয়ে যায় এবং নবুওয়াতের দাবি করতে থাকে।
যাহোক হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) মোসায়লামা কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং হজরত একরেমা (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রেরিত বাহিনীর সাথে আকরাবা নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ হয়, যাকে ইতিহাসে ‘হাদিকাতুল মওত’ বলা হয়। এই যুদ্ধে মোসায়লামাতুল কাজ্জাব নিহত হয়। এতে মোরতাদদের ২১ হাজার সৈন্য তিন স্থানে নিহত হয়। তাদের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার। মুসলমানদের পক্ষে মোহাজের, আনসার ও তাবেঈন এক হাজার শহিদ হন। হজরত খালেদ (রা.)-এর নেতৃত্বে যুদ্ধে বিজয় সূচিত হয় এবং ওয়াহ্শী ও একজন আনসারী মোসায়লামাকে হত্যা করেন। হিজরি ১১-১২ সাল, মোতাবেক ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ মতান্তরে ১১ অক্টোবর মোরতাদ বনি হানিফার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন