শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের আকাল

মেজর (অব.) রেজা উল করিম | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যাবলির প্রতি মানুষের বিশ্বাস, ধারণা, অনুভূতি, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির সমষ্টিকে বুঝায়। রাজনৈতিক বিষয়াদির প্রতি নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গির এক সামগ্রিক বন্ধনব্যবস্থা হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি তৈরি হয় রাজনীতিবিদদের সামগ্রিক কর্মকান্ড, কথাবার্তা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা প্রভৃতি দ্বারা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনভাবেই সর্বজনগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নেই। পরনিন্দা, পারস্পারিক অশ্রদ্ধা, চরিত্রহনন, অসম্মান প্রভৃতিই যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে তাদের অসম্মান, কুৎসা রটনা ও নিচু করে উপস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও দিন দিন নিচু হচ্ছে। অথচ, রাজনীতিবিদরা যদি একজন আরেকজনকে প্রতিপক্ষ মনে না করে রাজনৈতিক প্রতিযোগী মনে করতেন এবং সুষ্ঠু প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন তাহলে তরুণ, শিক্ষিত ও মেধাবী প্রজন্ম রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হতেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা এমনকি বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদরাও পারস্পারিক অসম্মানকে নোংরামির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন।
একজন বিবেকমান ব্যক্তির অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে নোংরা মন্তব্য করার পূর্বে হাজার বার ভাবা উচিত। কেননা, অন্য কাউকে হেয় করার মধ্য দিয়ে নিজের নিচু রুচিবোধ ও নিচু মন-মানসিকতা প্রকাশ পায়। প্রতিপক্ষও তদ্রæপ উত্তর দেয়ার সুযোগ পায় এবং সর্বোপরি এর মধ্য দিয়ে উভয়ই সবার কাছে হাসির পাত্র হয়। দুঃখের বিষয়, এদেশে বিভিন্ন দলের রাজনীতি করেন এমন অনেক লোক আছে যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু বলা তো দূরের থাক তাকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করতেও লজ্জাবোধ করেন না। বঙ্গবন্ধুকে সারা দুনিয়া সম্মান করে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার অনেক ভুল থাকতে পারে তাই বলে কি তার অবদান ভুলে যাব? তিনি যে কত বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন তা আমাদের উপলব্ধি করা উচিত। বঙ্গবন্ধু এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি কাউকে একবার দেখলে, একবার কথা বললে ১০ বছর পরেও তার নাম ধরে ডাকতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুর অপরাজেয় নেতৃত্বের কারণেই এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পরে রাজনৈতিক বা অন্য কোন কারণে যে কেউ তার কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু তাকে অসম্মান, অশ্রদ্ধা কিংবা ছোট করার প্রবণতা কোনবাবেই কাম্য নয়। অন্যদিকে আজকের আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কোনভাবেই বিচার করা উচিত নয়। বঙ্গবন্ধু দল, মত, আদর্শের অনেক ঊর্ধ্বে। তাকে যথাযথ সম্মান না দিয়ে কথা বলার সুযোগ আওয়ামী লীগ-ই করে দিয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। সঙ্গত কারণেই স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পরেও আজ আমাদের ভাবতে হয় ‘বঙ্গবন্ধু কি সবার কাছে বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছেন, নাকি শুধু আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু হয়ে আছেন’। এর দায় আওয়ামী লীগও এড়াতে পারে না।
একই ধরনের অশ্রদ্ধাবোধমূলক ও নোংরা মন্তব্য অনেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নিয়েও করে থাকেন। স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, বেতারে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার তিনি। তার রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে হলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে বা মহান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে অসম্মান করা কাম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বঙ্গবন্ধু নিজে খেতাব পর্যন্ত দিয়েছেন। এমনকি যুদ্ধ দিনের শুরুর দিকে একজন সেনা অফিসারের জন্য বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেয়া যে কত কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। কোন কারণে যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, যে সকল সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিক স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, বিদ্রোহের অপরাধে তাঁদের প্রত্যেককে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। এমন অনেক পারিপার্শ্বিক চাপকে মাথায় নিয়ে তিনি মহান মুক্তি সংগ্রামে যে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তার মূল্যায়ন না করা হলে জাতি হিসেবে আমরা ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যাব। তাঁকে নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে তাঁর অসম্মান হয় এমন বাচনভঙ্গি বা শব্দচয়ন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কলুষিত করবে। তাকে আপনি অন্তত জেনারেল জিয়াউর রহমান বা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নামটা সম্মানের সাথে বলুন।
আমরা এমন একটা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডলে বড় হয়েছি যেখানে সামাজিক মূল্যবোধ খুব শক্তিশালী। যে মূল্যবোধ আমাদের শেখায় কোন মৃত্যু ব্যক্তিকে অসম্মান না করতে। মৃত্যুর সাথে সাথেই তার সাথে সকল শত্রুতা, বিরোধকে ছিন্ন করতে। অথচ এই ধর্মীয় শিক্ষাটাও আমরা রাজনৈতিক কারণে ভুলে যাচ্ছি। যে কারণে মৃত্যুর চার দশক পরেও সম্পূর্ণ হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানকে কটাক্ষ, অসম্মান ও আক্রমণ করে কথা বলি।
আবার দেখা যায়, বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীকে হাসিনা নাম ধরে সম্মোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে কিন্তু তিনি তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাকে অন্তত মাননীয় না বলুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলুন। অপরকে গালি দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতারা অনেক এগিয়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অসম্মান করতে তারা এমন বিশ্রীভাবে কথা বলেন যে ভুলে যান এই বাংলাদেশটার তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। পারলে তাকে তারা ছিচকে চোর বানিয়ে ফেলেন। অথচ ভুলে যান এর চেয়ে বহু বড় বড় অপরাধী লুটপাটকারী বহাল তবিয়তে দেশে আছে। আপনি তথ্যভিত্তিক যে সমালোচনা করতে চান করেন কিন্তু তাই বলে খালেদা খালেদা না বলে বলুন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বেগম খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনাকে নিয়ে কথা বলার আগে প্রত্যেকেরই এ বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত তারা দুজনই বাংলাদেশকে একাধিকবার নেতৃত্ব দিয়েছেন।
একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তখনই টেকশই হয় যখন সেখানে মূল্যবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠী থাকে। যে জনগোষ্ঠীর চর্চিত সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে দেশের সুনাম বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ বিবেচনায় আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পারস্পারিক সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ, জাতীর বীর সেনানীদের প্রাপ্য সম্মান, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা প্রভৃতির উন্নয়ন না ঘটাতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
লেখক: নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
গনতন্ত্র ৩১ মার্চ, ২০১৮, ৫:৩৪ এএম says : 0
জনগন বলছেন, অসংখ্য ধন্যবাদ , আপনার মন্তব্য জাতীয় দর্পন “ কাউকে অসন্মান করা, গালিগালাজ করা , কটুক্তি করা এ যেন রেওয়াজে পরিনত হয়ে গেছে , উনাদের ধারনা , যে যত নীচু ভাষায় গালিগালাজ করবে , সে নেতা-নেত্রীর তত বেশী সান্নিধ্য লাভ করবে ?? তা ছাড়া নেতা-নেত্রীরা ..........................................৷ আমাদের ভয় হয় , এ ভাবে চলতে থাকলে, হয়তঃ একদিন দুই পরিবারের নাম ও নিশানা ইতিহাসের পাতা থেকে ঝরে যায় কিনা, আল্লাহ ভাল জানেন ৷
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন