শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রসালো তরমুজে বাজার ভরে উঠলেও আবাদ গত বছরের চেয়ে কম

| প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : সারা দেশ জুড়ে ইতোমধ্যেই সুমিষ্ট রসালো ফল তরমুজে বাজার ভরে উঠেছে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে সড়ক ও নৌপথে সুমিষ্ট তরমুজ যাচ্ছে সারা দেশের বাজারে। তবে গত বছর মার্চ-এপ্রিলের অতিবর্ষণে দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলভাগে তরমুজের ব্যাপক ক্ষতির ফলে এবার আবাদ কিছুটা কম হলেও ফলন যথেষ্ট ভাল। দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রয়েছে। গত এক সপ্তাহে বাজারে প্রচুর তরমুজ উঠতে শুরু করেছে। ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল ছাড়াও পটুয়াখালীর কলাপাড়া এবং বরগুনার আমতলীসহ পাথরঘাটা এলাকায় এবারো তরমুজের ফলন ভাল। দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারগণ ইতোমধ্যে এসব এলাকায় ঘুরে তরমুজ কিনছেন। ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে ট্রলার ও কাভার্ড ভ্যান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে তরমুজ যাচ্ছে সারা দেশের বাজারে।
গত তিন দশকে দেশের উপকূলভাগসহ দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। যা কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তবে গতবছর ১০ ও ১১ মার্চ এবং এপ্রিলের বিভিন্ন সময়ে অতিবর্ষণে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে আবাদকৃত ৩৫ হাজার ২৯১ হেক্টর জমির তরমুজের প্রায় ৩২%ই ক্ষতিগ্রস্থ হয় অতি বর্ষণে। এ তথ্য কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫শ’ কোটি। তবে এখনো সারা দেশের ৮০ ভাগেরও বেশী তরমুজ বরিশাল কৃষি অঞ্চলেই আবাদ হচ্ছে। কিন্তু গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষতি, চলতি মৌসুমে তরমুজ আবাদে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকগণ যথেষ্ট নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। ফলে গত বছরের প্রায় অর্ধেক এবং লক্ষ্যমাত্রার ৬০ ভাগের মত জমিতে এবার তরমুজ আবাদ হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। চলতি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বাস্তবে মাত্র ১৯ হাজার হেক্টরের কিছু বেশী জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে ২০১০-১১ সালে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের জেলাগুলোতে ১৮ হাজার ৪২৯ হেক্টরে প্রায় ৭ লাখ ৭৯ হাজার টন তরমুজ উৎপাদন হয়। হেক্টর প্রতি উৎপাদন ছিল প্রায় ৪২.২৭ টন। যা ২০১১-১২তে ২১ হাজার ৫৩৩ হেক্টরে উন্নীত হয়। উৎপাদনও দাড়ায় প্রায় ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। ২০১২-১৩’তে এ অঞ্চলে তরমুজের আবাদ প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ৩১ হাজার ৪২৪ হেক্টরে। উৎপাদনও ছিল প্রায় ১৩ লাখ ৩৭ হাজার টন। ২০১৫-১৬ তে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের আবাদ ৩২ হাজার ২১৫ হেক্টরে উন্নীত হয়। উৎপাদন ছিল প্রায় ১৫.৮৬ লাখ টনের মত। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সারা দেশে প্রায় ৪৩ হাজার হেক্টরের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায়ই সর্বকালের সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার ২৯১ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়। কিন্তু তার প্রায় অর্ধেক ফসলই ক্ষতিগ্রস্থ হয় মার্চ-এপ্রিলের অতিবর্ষণে। ফলে উৎপাদনও আগের বছরের এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়ে ১০ লাখ টনে নেমে আসে বলে জানা গেছে।
তবে এ বছর আবাদ হ্রাস পেলেও উৎপাদন যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। ডিএই হেক্টর প্রতি ৪৮ টন তরমুজ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করলেও তার প্রায় কাছাকাছি এর ফলন হচ্ছে এবার। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ তরমুজ বাজারে এসেছে। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের পাইকারী বাজারে প্রতি হাজার তরমুজ ১০-১২ হাজার টাকা দরে বিক্রি হলেও মাঠ পর্যায়ে তা ৫ হাজার টাকারও কম। আর খোলা বাজারে সে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা থেকে আড়াইশ টাকা পর্যন্ত প্রতিটি।
আফ্রিকা মহাদেশের উৎপত্তিস্থল ছাড়িয়ে কুমড়া পরিবারের সুমিষ্ট ফল তরমুজ এখন বাংলাদেশ। এ সুমিষ্ট ফল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সহ বিশ্বের অনেক দেশেই আবাদ হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ ছাড়াও তরমুজ দিয়ে নানা ধরনের শরবত, জ্যাম, সিরাপ ও গুড় সহ এলকোহলও তৈরী হচ্ছে। চীনা ভেষজবিদগণ তরমুজের রস রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে বলে জানিয়েছেন। কৃষি বিজ্ঞানী ও পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে তরমুজে যথেষ্ট পরিমান ভিটামিন-এ, রিবোফ্লাভিন, থায়ামিন ও পেকটিন বিদ্যমান রয়েছে। পাকা তরমুজের রসালো শাস স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হবার পাশাপাশি তা খুবই তৃপ্তিদায়ক ও তৃষ্ণা নিবারক। এমনকি সাইট্রেন শ্রেণীর তরমুজ দিয়ে জেলীও তৈরী হচ্ছে। কৃষি উপযোগী জলবায়ু ও মৌমাছির সাহায্যে পরাগায়িত হয়ে এ ফলের উৎপাদন নিশ্চিত হয়ে থাকে। গত কয়েক বছরে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের আবাদ প্রায় দ্বিগুণ বাড়লেও গত বছরের অসময়ের অতি বর্ষণে মারাত্মক ক্ষতির কবলে পরে এবার কৃষকগন আবাদে কিছুটা নিরুৎসাহিত হলেও এর ভবিষ্যত যথেষ্ঠ ভাল বলে মনে করছেন ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।
কৃষিবীদদের মতে, খরা প্রতিরোধক ফসল তরমুজ এর গাছ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক পরিবেশে বেড়ে ওঠে। তবে ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রা তরমুজের গাছ ও এর ফলনের জন্য ক্ষতিকর। ২২ ডিগ্রী থেকে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এ ফসল ভাল হলেও অতিরিক্ত আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও স্যাতস্যাতে মাটিতে ফুল ও বীজের গুণগত মান বিনষ্ট এবং পুষ্পায়ন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাশাপাশি রোগ বালাইয়ের আশংকাও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদগন। প্রখর সূর্যালোকসহ শুষ্ক পরিবেশ আগাম পরিপক্কতা এবং ফলের মিষ্টতা ও সুগন্ধ বৃদ্ধি করে থাকে। খরা প্রতিরোধক ফসল-তরমুজ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক পরিবেশেই বেড়ে ওঠে। তবে গাছে ফল আসার পরে হালকা বৃষ্টি বা গাছে পানি সেচ পেলে মিষ্টতা বৃদ্ধি সহ তা আরো কিছুটা টেকসই হয়।
আমাদের দেশের বেলে দো-আঁশ থেকে এটেল দো-আঁশ পর্যন্ত সব ধরনের মাটিতে তরমুজের ভাল আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে। এমনকি নদ-নদীবহুল দক্ষিণাঞ্চলের নোনা পানিমুক্ত চরাঞ্চলের পলি মাটিতেও এ রসালো ফলের ভাল ফলন হচ্ছে। তরমুজ-এর গাছ বর্ষজীবী, দিবস দৈর্ঘ্য নিরপেক্ষ ও লতানো প্রকৃতির। ৫.৫ থেকে ৭.০ পিএইচ মাত্রার জমি এ ফসলের জন্য উপযোগী। তবে কোন অবস্থাতেই একই জমিতে পর পর তিন বছরের বেশী তরমুজ আবাদ না করার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষিবিদগণ। এতে রোগ বালাইয়ের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
কৃষিবিদদের মতে, অধিক ফলন, মিষ্টতায় পরিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট গুণের কারণে আধুনিক জাতের উচ্চ ফলনশীল তরমুজের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশে ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ইউরোপীয়, প্রাচ্য ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় ‘সুইট ফেস্টিবল ও ফ্লোরিডা জয়েন্ট, টপইল্ড, গেøারী, কঙ্গো, চার্লসটন-গ্রে, ইমিরিয়েল, জুবলী, সুপার ডেলিকেট ও সুপার বেবী’ নামের একাধিক উন্নত জাতের তরমুজের আবাদ হচ্ছে। তবে দেশে সদুর অতীত থেকে ‘পতেঙ্গা’ ও ‘গোয়ালন্দ’ জাতের কালচে এবং নীলাভ গোলাকৃতির তরমুজের আবাদ হত। এসব ফল ওজনে ৮-১০ কেজি হলেও বর্তমানের আধুনিক উচ্চ ফলনশীল জাতের তরমুজের মিষ্টতা অনেক বেশী।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন