সখিপুর উপজেলায় এক লক্ষ একর জমির মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার একর জমি বন বিভাগের। বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ১৫০টি করাতকল। বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী মূল্যবান বৃক্ষ নিধন করে হাজার হাজার একর জমি জবর দখল করে তিনশত টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাঁশতৈল, হতেয়া, বহেড়াতৈল ও ধলাপাড়া রেঞ্জের প্রায় ৩০ হাজার একর বনবিভাগের জমি স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে গেছে, দখলদাররা ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করে দিয়েছে। এখানে রক্ষকই ভক্ষকের ভ‚মিকায়। স্থানীয় প্রভাবশালীমহল, বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে বন বিভাগের জমি জবর দখল ও মূল্যবান বৃক্ষ বেপরোয়াভাবে নিধন করা হচ্ছে।
হতেয়া রেঞ্জের হতেয়া সদর কালমেঘা, কড়িচালা, বাজাইল, কালিদাস বিট, বাঁশতৈল রেঞ্জের বংশীনগর, পাথরঘাটা, নলুয়া বিট, বহেড়াতৈল রেঞ্জের বহেড়াতৈল সদর, কাকড়াজান, (মরিচা) এম এম চালা (আন্দি) কচুয়া, ডিবি গজারিয়া (কৈয়ামধু) বিট, ধলাপাড়া রেঞ্জের ধলাপাড়া সদর সাগরদীঘি বিট নিয়ে টাঙ্গাইলের সখীপুর সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠিত। এসব বনাঞ্চলে রয়েছে শাল, গজারি ক‘পিচ, আকাশমনি, মেহগনি, সেগুন মিউজিয়াম, ইউকেলিপটাস, ক্রস প্রভৃতি মূল্যবান বৃক্ষ। এসব মূল্যবান বৃক্ষ চোরাই কাঠ ব্যবসায়ী জিন্নাত আলী, আজহার (আবু জাহেল) হুরমুজ, ফারুক, মফিজুল, তপু, বাদল, ইস্কান্দার, রিপন, হামিদ, কামরুল, আমিনুল গং চোরাই ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে আতাত করে মূল্যবান বৃক্ষ রাতের আধারে নিধন করে সখিপুর পৌরসভায় ৫৫টি করাতকল, বনবিভাগের ভেতর স্থাপিত ১৫০টি অবৈধ করাতকলের মাধ্যমে চিড়াই করে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ ট্রাক কাঠ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। অবৈধ করাত কলের মধ্যে হতেয়া রেঞ্জে ১৭টি, বাঁশতৈল রেঞ্জে ৩৫টি, বহেড়াতৈল রেঞ্জে ৬৭টি এবং ধলাপাড়া রেঞ্জে ৩১টি অবৈধ করাতকল রয়েছে। বন বিভাগের আইন অনুযায়ী বনাঞ্চল এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো করাতকল নির্মাণ করা যাবে না। অথচ মরিচা (কাকড়াজান) বিটের বড়চালা বাগানের ভেতর হামিদের করাতকলসহ অসংখ্য করাতকল আইনের তোয়াক্কা না করে বাগানের ভেতর বন বিভাগের জমিতে করাতকল নির্মিত হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সাংবাদিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করলে মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে এক করাতকল মালিক কে বাদী ও অন্যান্য করাতকল মালিকদের সাক্ষী করে ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা দেয়ার নজিরও রয়েছে। অবৈধ করাতকলগুলো পরিচালনা করার জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে দু’ভাগে ভাগ করে উত্তরাঞ্চলে কামরুল ও দক্ষিণাঞ্চলে গোলাপ, মকবুল প্রতি করাতকল থেকে মাসিক ১০ হাজার টাকা করে প্রায় কোটি টাকা উত্তোলন করে। এ টাকা স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগের লোকজন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা, সাংবাদিকদের মধ্যে বণ্টন করা হয় বলে কামরুল জানায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চোরাই ব্যবসায়ী বলেন, বন বিভাগের কর্মকর্তা স্থানীয় প্রশাসন, রাস্তা খরচ বাদ দিয়ে প্রতি ট্রাক চোরাই কাঠ বিক্রির পর চার-পাঁচ লাখ টাকা লাভ হয়। আবার বৃক্ষ নিধনের পর বিরাণভ‚মি জবর দখল করে সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা প্লট আকারে ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি সূত্র জানায়, বন বিভাগের বিরাণভ‚মিতে নতুন করে ঘর নির্মাণে বন বিভাগের লোকজন বাধা দেয়। কিন্তু রাতের আধারে ঘর নির্মাণ হয়ে গেলে আর ভাঙা হয় না। এ ব্যাপারে হতেয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. খুশরু আলম জানান, অবৈধ করাতকলের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া করাতকল উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। আর ঘর ভেঙে ফেলার জন্য সরকার থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে। ফলে এ সুযোগে হাজার হাজার একর বন বিভাগের জমি জবর দখল হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার একর জমি জবর দখল হয়ে স্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি, দালানকোঠা পোল্ট্রি ফার্ম বা ফ্যাক্টরি প্রভৃতি নির্মাণ করা হয়েছে। যা বহেড়াতৈল হতেয়া বাঁশতৈল, ধলাপাড়া রেঞ্জের বিভিন্ন বিট কর্মকর্তাদের নিকট সরেজমিন খোজ নিলেই জানা যাবে অবিশ্বাস্যভাবে বন বিভাগের জমি জবর দখল হয়েছে। আর নেতৃত্বে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের আত্মীয়স্বজন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি প্রতিবেদন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বন বিভাগের কর্মকর্তাগণ কিছুদিন তৎপর হলেও পুনরায় পূর্বের তুলনায় অজ্ঞাত কারণে দ্বিগুণ অনিয়ম-দুর্নীতি চলতে থাকে। বহেড়াতৈল রেঞ্জ কর্মকর্তা আতাউল মজিদ বলেন, মামলা সংক্রান্ত জটিলতা কেটে গেছে, ইতোমধ্যে সাতটি করাতকল উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং অচিরেই পুনরায় টাস্কফোর্স গঠন করে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অবৈধ করাতকলগুলো উচ্ছেদ করা হবে।
সখিপুর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর ১৫০টি অবৈধ করাতকল স্থাপিত হয়েছে এবং আরো ৫৫টি স্থাপন করার প্রক্রিয়া চলছে। যে সব এলাকায় এসব অবৈধ করাতকলগুলো রয়েছে সে সব এলাকা হলো- উপজেলার সলঙ্গা, কালমেঘা, মুচারিয়াপাথার, ইছাদীঘি, আড়াইপাড়া, বড়চওনা, কুতুবপুর, ইন্দারজানি, গড়বাড়ি, তৈলধারা, দীঘিরচালা, মহানন্দনপুর, বুড়িচালা, বড়চালা, হামিদপুর, বাঘেরবাড়ি, সাপিয়াচালা, ডাবাইলগোয়াইলবাড়ি, বহেড়াতৈল, কালিয়ান, বেতুয়া, থলচালা, আকন্দপাড়া, দাড়িয়াপুর, নলুয়া, বেড়বাড়ি, তক্তারচালা, হতেয়া, হতেয়া রাজাবাড়ি, করটিয়াপাড়া, চতলবাইদ, ভাতকুরাচালা, কালিদাস, আমতৈল, রতনপুর, চাকদহ, কামালিয়াচালা, পাথরঘাটা, গোবরচাকা, বগাপ্রতিমা, সাড়াসিয়া, বাসার চালা, বাজাইল, দেওদীঘি, বহুরিয়া চতল বাইদ, নাকশালা, গিলাবাড়ি, বড়–ইতলা, বংকি, ফুটানি বাজারসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর এবং ১০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১৫০টি অবৈধ করাতকল রয়েছে। একেকটি করাতকলের মালিক চার-পাঁচজন। করাতকল অবৈধ হওয়ার কারনে কেউই করাত-কলের মালিক বলে স্বীকার করে না-শুধু বলে আমি আ’লীগ করি। অবৈধ করাতকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসলাম ভূঁইয়া বলেন, বন বিভাগের লোকজন, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক ম্যানেজ করেই আমরা করাতকলগুলো চালিয়ে যাচ্ছি। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা টাঙ্গাইল (ডিএফও) হোসাইন মো. নিশাদ বলেন, টাস্কফোর্স গঠন করার মাধ্যমে অবৈধ করাতকলগুলো শীঘ্রই উচ্ছেদ করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন