ইসলামের সর্বাধিক ফযিলতপূর্ণ ও বরকতময় রজনীগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পবিত্র শবে বরাত। উম্মাতে মোহাম্মদীর মর্যাদা বৃদ্ধি, রহমাত ও মাগফিরাতের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শবে বরাত এক মহানিয়ামত। পাপ-পঙ্কিলতায় জর্জরিত হতভাগ্য কোন ব্যক্তির জন্য খাঁটি তওবা করে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের অপূর্ব সুযোগ এ মহিমান্বিত রজনী। তাইতো বছর ঘুরে যখন শবে বরাত মুসলমানের দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়, তখন তারা এর ফযিলত ও বরকত হাসিলে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
আরবী শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবে বরাত বলা হয়। ফার্সী ভাষায় শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ- ভাগ্য রজনী। উপমহাদেশে মুসলমানদের নিকট এটি ভাগ্য রজনী হিসেবেই সুপ্রসিদ্ধ। মহিমান্বিত এ রজনীর আরবী নাম হচ্ছে ‘লাইলাতুল বারাআত’ (মুক্তির রজনী)। হাদীস শরীফে এ রজনীকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ (মধ্য শাবানের রজনী) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গোটা মুসলিম জাহানে এ নাম দুটিই বেশি সমাদৃত।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি একে অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে, আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরিকৃত হয়’ (সূরা দুখান-৩-৪ আয়াত)। হযরত ইকরামা (রা.) ও একদল আইম্মায়ে কিরামের মতে, এ আয়াতে উল্লেখিত ‘মোবারক রজনী’ দ্বারা শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে। যদিও অনেকে একে লাইলাতুল ক্বদর বলে মনে করেন। কিন্তু এতে শবে বরাতের সম্ভাবনা একদম নাকচ হয়ে যায়নি। তাই একদল মোফাসসিরীনের মত অনুযায়ী শবে বরাত ‘মোবারক রজনী’ হওয়ায় এ রাতটি অন্যান্য রাতের তুলনায় বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। হাদীস গ্রন্থসমূহে শবে বরাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কিত অনেক হাদীস এসেছে। অত্যধিক গুরুত্ববহ এসব হাদীসের একটি হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (স.) একদা রাতে সালাত আদায় করছিলেন। তিনি সাজদায় দীর্ঘ সময় থাকলেন। এতে আমার মনে হলো যে, তাঁর ওফাত হয়ে গেছে। আমি যখন এমনটি দেখলাম তখন শয়ন থেকে উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলী নাড়া দিলাম, ফলে তিনি নড়ে উঠলেন। অতঃপর যখন তিনি সাজদা থেকে মাথা উঠালেন এবং নামায শেষ করলেন তখন বললেন, হে আয়শা তুমি কি মনে করেছিলে যে, নবী (স.) তোমার সাথে প্রতারণা করেছেন? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ, আমি এমনটি মনে করিনি। বরং আপনার দীর্ঘ সাজদার কারণে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার ওফাত হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স.) সম্যক জ্ঞাত। তিনি বললেন, এটি মধ্য শাবানের রাত। আল্লাহ তায়ালা এ রাতে বান্দাদের প্রতি তাঁর রহমত প্রেরণ করেন। যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করেন, যারা দয়া প্রার্থনা করে তাদেরকে দয়া করেন এবং যারা বিদ্বেষী তাদেরকে তাদের অবস্থাতেই রেখে দেন। (বায়হাক্বী, শোয়াবুল ঈমান, ৩/৩৮৩৫)
শবে বরাতের অসংখ্য নাম রয়েছে। এ নামগুলোর তাৎপর্য বিশ্লেষণে ফুটে ওঠে এ রাতের সুমহান মর্যাদা। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে নামের সংখ্যাধিক্যই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। যেমন, পবিত্র কোরআনের অসংখ্য নাম এ গ্রন্থের সুউচ্চ মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ। আবুল খাইর আত-তালিকানী (রহ.) শবে বরাতের ২২টি নাম উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি নাম হল-লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (মধ্য শাবানের রাত), লাইলাতুল বারাআহ (মুক্তির রাত), লাইলাতুল মোবারাকাহ (বরকতময় রাত), লাইলাতুর রাহমাহ (অনুগ্রহের রাত), লাইলাতুল ক্বিসমাহ (বণ্টনের রাত), লাইলাতুত তাকফীর (কাফফারার রাত), লাইলাতুল ইজাবাহ (দোয়া কবুলের রাত), লাইলাতুস সাক (সনদের রাত), লাইলাতুল জায়িযাহ (পুরস্কারের রাত), লাইলাতুল ক্বদর (ভাগ্য রজনী) ও লাইলাতু ঈদিল মালাইকাহ (ফিরিশতাদের ঈদের রাত) ইত্যাদি।
হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী, আল্লাহ তায়ালা এ রাতে বান্দাদের এক বৃহৎ দলের গুণাহ মাফ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন বিধায় এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত বা গুনাহ মুক্তির রাত বলা হয়। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ.) বলেন, ট্যাক্স আদায়কারীগণ যেমন জনগণের কাছ থেকে পূর্ণ কর আদায় করে তাদেরকে বারাআত বা দায়মুক্তের সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন, আল্লাহ তায়ালাও এ রাত্রে মুমিন বান্দাদের ক্ষমা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সার্টিফিকেট দেন বলে এ রাতের নামকরণ হয়েছে লাইলাতুল বারাআত (তাফসীরে কাবীর)। তিরমিযী শরীফে হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে তাঁর রহমাত প্রেরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন। (তিরমিযী-৭৩৯, মুসনাদে আহমাদ-২৬০৬)। ইমাম বায়হাক্বীর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তায়ালা এ রাত্রে কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দান করেন। (বায়হাক্বী, শোয়াবুল ঈমান-৩/৩৮৩৭) উল্লেখ্য, এখানে কালব গোত্রের কথা এ জন্যই বলা হয়েছে যে, তখনকার সময় আরব দেশে সর্বাধিক সংখ্যক মেষ ছিল একমাত্র তাদের। উদ্দেশ্য, উক্ত রাতে আল্লাহ তায়ালার ব্যাপক ক্ষমার প্রতি উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ। (যুরকানী, শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ, ১০/ ৫৬০)
শবে বরাতের বিশেষ মাহাত্ম হচ্ছে, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দার দোয়া কবুল করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, পাঁচ রাতের দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। রজবের প্রথম রাত, শবে বরাতের রাত, জুময়ার রাত, ঈদুল ফিতর ও কুরবানীর রাত (বায়হাক্বী, শুয়াবুল ঈমান-৩/৩৭১৩, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ৭৯২৭)। ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, অর্ধ শাবানের রাত বা শবে বরাতে সুর্যাস্তের পরপরই আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয়ে বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে রিযিক দান করব। কোনো বিপন্ন-বিপদগ্রস্থ আছে কি? আমি তার বিপদ দূর করব। এভাবে আরো ব্যক্তিকে ফযর হওয়া পর্যন্ত ডাকতে থাকেন (ইবনে মাজাহ-১৩৮৮, মিশকাত-১৩০৮)। উল্লেখ্য, এ হাদীসে আল্লাহ তায়ালার নুযুল বা অবতীর্ণ হওয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার রহমাত প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয় অথবা তাঁর নির্দেশিত কোনো ফিরিশতা নেমে আসেন। কেননা, আল্লাহ তায়ালাকে কোনো দিক বেষ্টন করে না।
এমন মহিমাময় গুরুত্বপূর্ণ রাত্রিতেও আল্লাহর অশেষ রহমাত ও ক্ষমা থেকে কিছু হতভাগ্য ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাসূলুল্লাহ (স.) থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের পনের তারিখ তথা শবে বরাতে সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমাত দান করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি ব্যাতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন (সহীহ ইবনু হিব্বান ১২/৫৬৬৫, মুজামূল কাবির-২০/২১৫ )। সহীহ হাদীসের এ বর্ণনা সহ অন্যান্য বর্ণনায় এ হতভাগ্য ব্যক্তিরা হচ্ছে- ১. মুশরিক ২. হিংসুক ৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ৪. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ৫. মদ পানকারী ৬. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী ৭. আত্মহননকারী ৮. যিনাকারী ৯. একের দোষ অন্যের কাছে বর্ণনাকারী ১০. গণক বা গায়েবী সংবাদ বর্ণনাকারী ১১. হস্তরেখা দেখে ভাগ্য নির্ণয়কারী ১২. অন্যায়ভাবে ট্যাক্স আদায়কারী ১৩. যাদুটোনার পেশা গ্রহণকারী ১৪. বাদ্য বাজনায় অভ্যস্ত ব্যক্তি।
শবে বরাতে রাত জেগে একনিষ্ঠভাবে নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, তসবীহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ ও যিকির-আযকারে নিজেকে মশগুল রাখা। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রাতে জাগ্রত থাকবে তাঁর জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যাবে। (রাতগুলো হচ্ছে) যিলহজ্জ্বের ৮ম ও ৯ম রাত, ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের রাত, শাবানের পঞ্চদশ রজনী। (মুনযিরী, তারগীব ওয়াত তারহীব)। এ রাতে নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে খাঁটি তওবার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের দোয়া করা। কবর যিয়ারত করা, শবে বরাতে কবর যিয়ারত করা সুন্নত। কেননা, এ রাতে রাসূল (স.) কবরস্থানে গিয়েছিলেন এবং মৃত মুসলমানদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করেছিলেন। দিনের বেলায় রোযা পালন, পরের দিন অর্থাৎ ১৫ শাবান রোযা রাখা। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, যখন মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত) আসে তখন তোমরা রাত্রিতে দাঁড়িয়ে নফল নামায পড় এবং দিনের বেলায় রোযা পালন কর (ইবনে মাজাহ-১৩৮৮, মিশকাত-১৩০৮)। তদুপরি এ দিনটি (১৫ শাবান) আইয়ামে বীযের অন্তর্ভুক্ত।
শবে বরাতে আতশবাজি, পটকা ফুটানো, মসজিদ, দোকান ও অফিসে আলোকসজ্জা, কবরস্থানে পুস্প অর্পণ, আলোকসজ্জা ও নারী পুরুষের সম্মিলিত যিয়ারত, অযাচিত আনন্দ উল্লাস, বেহুদা কথাবার্তা, ইবাদত-বন্দেগী বাদ দিয়ে অযথা ঘোরাঘুরি ও সেলফি এবং হালুয়া, রুটি বা খানাপিনার পিছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে বিরত থাকা অবশ্যই নিন্দনীয়। এগুলো শয়তানী কুমন্ত্রণা বৈ কিছুই নয়। কাজেই এ কাজগুলো থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য।
লেখক: প্রভাষক (আরবী), নাঙ্গুলী নেছারিয়া ফাযিল মাদরাসা, কাউখালী, পিরোজপুর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন