রাজা নেই, শাহী নেই রাজশাহী নাম। হাতি-ঘোড়া কিছু নেই। আছে শুধু আম। রসালো শাসালো আমের কথা উঠলেই চলে আসবে আমের রাজধানী বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের নাম। সত্যি সত্যি রাজশাহীতে কিন্তু হাতি, ঘোড়া এখন কিছু না থাকলেও আমের কোন কমতি নেই। লাখো লাখো গাছে কোটি কোটি আমের মনহরন কারিনী দুলনী। মাইলের পর মাইলজুড়ে শুধুই আম বাগান। আম ভালোবাসে না। এমন মানুষ খুবই কম আছে। দুনিয়াজুড়েই আমের কদর। আর আমাদের জাতীয়বৃক্ষ হিসাবে আম্রবৃক্ষ স্বীকৃত। আরবদের যেমন খেজুর। ইংলিশদের ওক, জাপানীদের চেরী, ফরাসীদের আঙ্গুর, স্পেনীসদের অলিভ, কানাডিয়ানদের আপেল, ব্রাজিলিয়ানদের কলা, আফগানীদের আখরোট। আমাদের তেমনি ধমনিতে রয়েছে আমের নির্যাস। এই আমের আদি জন্মভূমি দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে পার্বত চট্টগ্রাম উত্তরপূর্ব ভারত, মিয়ানমার, মালোশিয়ায় বলে গবেষকদের অভিমত। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। প্রায় ছয় হাজার বছর পূর্ব থেকে আবাদ হয়ে আসছে। স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টি মানের বিবেচনায় বিশ্বব্যাপি আদর্শ ফল হিসাবে মর্যাদা পেয়েছে। এসব অঞ্চল থেকে পর্যটকদের মাধ্যমে আম চাষের বিস্তার লাভ করেছে পৃথিবীজুড়ে। এটি মূলত গ্রীস্ম মঙ্গলীয় অঞ্চলে বেশি জন্মে। বাংলাদেশ এক সময় এমন কোন বাড়ি ছিল না যেখানে দু’চারটি আম গাছ ছিল না। নগরায়নের কোপে অনেক বড় বড় আম্র কানন যেমন ধ্বংস হয়েছে। আবার এখন পরিকল্পিতভাবে বড় বড় বাগান গড়ে উঠছে। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের আম যাচ্ছে আরব ইউরোপেও। কত নামের কত জাতের আম আছ তা আজ অবদি আম বিশেষজ্ঞরা নিরূপণ করতে পারেননি। আমের যেমন শত শত জাত রয়েছে। তেমনি রয়েছে বাহারী নামও, যা নিয়ে কথার শেষ নেই। আমের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে সবাই নিজ নিজ এলাকার আম নিয়ে গর্ববোধ করে। রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ তাদের ফজলী, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসাপাত, রানীপছন্দ নিয়ে গর্ববোধ করে। তেমনি সাতক্ষীরার মানুষ গোবিন্দভোগ ও ল্যাংড়ার প্রশংসা করে। আর রংপুরের মানুষ মানতে নারাজ যে তাদের হাড়িভাঙ্গা আমের চেয়ে ভাল আম আছে। আর দিনাজপুর ঠাকুরগা মানুষের কাছে সূর্যপুরী আমই শ্রেষ্ঠ। কুষ্টিয়ার মেহেরপুর অঞ্চলের মানুষের বিবেচনায় তাদের বোম্বাই তুলনাহীন। আম নিয়ে বড়াই শুধু আমাদের দেশে নয় আম উৎপন্নকারী বিভিন্ন দেশে চলছে এরকম। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী আম উৎপাদন হয় ভারতে। এক সময় নবাব বাদশাদের কল্যাণে উঠে বড় বড় আম বাগান। এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে ‘লাখ বাগ’ আম্রকুঞ্জ। মোঘল সম্রাট আকবরের ষোড়স শতাব্দীর শেষ দিকে বিহারের দার ভাঙ্গায় বিভিন্ন জাতের এক লাখ আম গাছের এই বাগানটি করেছিলেন। সেখান থেকেও আশপাশের এলাকায় বিভিন্নভাবে ভালো ভালো জাতের আমের চারা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আমের আবাদ হয়। আমের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সেখানে বির্তকের শেষ নেই। ভারতের মানুষ তাদের দুসেহেরী আমকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আম বলে গণ্য করে। আল ফানসো আল্লামপুর বেনীশাল আমের চেয়ে উৎকৃষ্ট আম আর হয় না বলে তারা গর্ব করে। ঠিক তেমনিভাবে পাকিস্তানীরা মনে করে আনোয়ার রাতাউল, সিনধারী, মোহাম্মদওয়ালা আমই শ্রেষ্ঠ। ফিলিপাইনের মানুষ করে শ্রেষ্ঠতের বিচারে ক্যারাবাই ও পিকো আমই সেরা। এমনিভাবে আম উৎপাদনকারী সকল এলাকায় আমের স্বাদ, শাস এবং আকর্ষণীয় রং বিবেচনা করে শ্রেষ্ঠতার দাবি কর হয়। এমন দাবির মধ্যদিয়ে আমের প্রতি দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায় । ফলের রাজা আম নিয়ে যত গল্প কবিতা আর কৌতুক হয়েছে। এমনটি আর অন্য ফলের ভাগ্যে জোটেনি। আম্র সাংস্কৃতি আমাদের যেমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে তেমনি আমাদের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। আমবাগান তার মুকুলের সুবাস আর স্বাদ-গন্ধ কবি মনে দোলা দিয়েছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে ঠাঁই পেয়েছে ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে....’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে এনেদে মাঠ থেকে বাবলাফুল, আমের মুকুল নইলে রাধবনা, বাঁধবনা চুল। আমাদের পল্লী কবি জসিম উদদ্ীনের মামার বাড়ি কবিতা পড়েননি এমন কেউ নেই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ। পাকা আমের মধুর রসে রঙ্গীন করে মুখ। রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু কবিতা গানে ঠাঁই পেয়েছে আম আর আম্রকানন। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ করে/ নির্জন আমের ডালে।
আম নিয়ে শুধু সাহিত্য নয়। রয়েছে রসালো গল্প। বাদশাহ আকবর একদিন তার দরবারে ভোজ সভার আয়োজন করে। বড় বড় মানুষ এতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। ছিল সম্রাটের প্রিয়পাত্র বীরবল। পেটভরে খেলেন বীরবলও। সম্রাটকে জানালে পেট ভরে খেয়েছে। পেটে একটুমাত্র ফাঁকা জায়গা নেই। এ সময় এলো গামলা ভর্তি আম। বীরবল বেশকিছু আম খেল। যা সম্রাটের নজর এড়ালো না। সম্রাট বীরবলকে বলেন তোমার পেটে একটুও জায়গা নেই অথচ অনেক আম খেলে। পেটে জায়গা নেই এমন মিথ্যে কথা কেন বললে? বুদ্ধির রাজা বীরবলও কম যায় না। বিনয়ের সাথে বললেন মহামান্য সম্রাট যখন রাস্তা দিয়ে কোথাও যান, সে রাস্তাতে যত ভিড় থাকুক সঙ্গে সঙ্গেই তা ফাঁকা হয়ে যায়। আপনি যেমন আমাদের সম্রাট। তেমনি ফলের রাজাও আম। আপনাকে যেমন রাস্তা ছেড়ে দেয়া হয়। ফলের রাজা আমকেও সেভাবে পেট জায়গা করে দেয়। বীরবলের এমন উত্তরে সম্রাট খুশী হয়ে তাকে আরো বেশ ক’ঝুড়ি আম উপহার দেন।
আমের স্বাদ নিয়ে গল্প প্রচলিত আছে। ভারতে দীর্ঘদিন থাকার পর এক ধর্মযাজক ইউরোপে ফেরত গিয়ে আমের স্বাদের বর্ণনা দেন। এতে তার বন্ধুরা জানতে চান স্বাদ কেমন। এর জবাবে তিনি তার দাড়ির অগ্রভাগ চিনির রসে চুবিয়ে তা চুষতে বলেন। বন্ধু তার দাড়ি চুষতে চুষতে বলেন অপূর্ব স্বাদ। ধর্মযাজক বলেন প্রকৃত আমের স্বাদ আরও অপূর্ব। আমকে নিয়ে নানা বচন রয়েছে। যেমন আম ছালা সবি গেল। কিংবা মুখটা শুকিয়ে একেবারে আমচুর হয়ে গেছে। আসলে আমকে নিয়ে যত গান-কবিতা-গল্প প্রবাদ রয়েছে। অন্য কোন ফলের ভাগ্যে তেমনটি আর জোটেনি। জৈষ্ঠ্য আসে আম পাকে। আর এই জৈষ্ঠ্য মাসে হয় জামাইষষ্টি। উত্তবঙ্গের মেয়ে জামাইকে নাইয়রে নিয়ে আসা হয় আম্র দিয়ে আপ্যায়ন করার জন্য। আম নিয়ে কূটনীতিও কম নয়। বন্ধুর মান ভাঙ্গাতে কিংবা অফিসে ফাইল সচল করতে ২/৩ ঝুড়ি আম দারুণ কাজ দেবে। এ অঞ্চলের মানুষ যারা অন্য অঞ্চলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতিবছর মেয়ের শ্বশুর বাড়ির স্বজনদের কাছে ক’ঝুড়ি আম না পাঠিয়ে উপায় থাকে না। যায় যাক প্রাণ তবু রাখতে হবে মান।
যতদিন যাচ্ছে আম বাণিজ্য তত জমজমাট হচ্ছে। বাংলাদেশের আম যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপে। এজন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশেষ যত্ন আত্তি করে তৈরি শর্ত মেনে তৈরি করা হচ্ছে আম। ইতোমধ্যে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিদেশীদের নজরও ঐ আমের দিকে। সারাদেশে আম উৎপাদন হলেও ২২ জেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে ভালো ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। আর বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবার কারণে প্রতিবছর বাড়ছে আম বাগানের পরিমাণ। চাষাবাদে যোগ হয়েছে বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল। সব মিলিয়ে আম নিয়ে চলছে হুলস্থুল কারবার। এখন চলছে আমের মওসুম। বাগানে বাগানে লাখ লাখ গাছে ঝুলছে কোটি কোটি আম। বাগানের মধ্যদিয়ে চলে গেছে মাইলের পর মাইল রাস্তা। গাড়ি নিয়ে চলতে গেলে চোখে পড়বে শুধু আম আর আম। থোকায় থোকায় আমে বাতাসের দুলনী। আপনার মনকে নাড়া না দিয়ে পারবে না। সিলেটে গেলে যেমন চায়ের সবুজ বাগান আর কক্সবাজারে সমুদ্রের গর্জন আপনার দৃষ্টি মনকে প্রশান্ত করে। তেমনি লাখ লাখ বাগানের কোটি কোটি আমের দৃশ্য আপনার মনকে জয় না করেই পারবে না। বাগানের মধ্যদিয়ে হাঁটতে গেলে ঝুলে থাকা আমের থোকা আপনার দেহ ছুঁয়ে যাবে। আর মনকে করবে শিহরিত। আমের থোকা জড়িয়ে ছবি কিংবা সেলফি না তুলে থাকতেই পারবেন না। এরপর রয়েছে কাঁচা পাকা আমের স্বাদ। গাছ পাকা আমের স্বাদই যে আলাদা। বাগানের মধ্যদিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যদি ভাগ্যিস আপনার সামনে একটা গাছপাকা আম টুপ করে পড়ে। তার স্বাদে যে ভিন্নতা পাবেন এটা বলা যায় নিশ্চিত করে। আমবাগান ঘুরতে গিয়ে যদি ঝড়বৃষ্টি হয়। তখন মনে পড়ে যাবে সেই ছোট বেলায় পড়া মামার বাড়ি কবিতাটি। এ অঞ্চলে মামার বাড়ি নেই তো কি হয়েছে। রয়েছে এখানকার অতিথিপরায়ণ মানুষ যাদের নিজের মামু ভাবতে পারেন। এ অঞ্চলের মানুষগুলো খুবই সহজ সরল। এই গরম আর বর্ষায় সমুদ্র দর্শনে না গিয়ে অনায়াসে চলে আসতে পারেন আম ভরা বাগানে। আসার পথও খুব সোজা। ঢাকা-রাজশাহীর মধ্যে দিন রাতে চলে তিনজোড়া ট্রেন। কল্যাণপুর থেকে আধাঘণ্টা পর পর বাস ছাড়ে। রয়েছে আরামদায়ক এসিবাস। কক্সবাজার থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব জেলার সাথে রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ। আবার প্রতিদিন উড়োজাহাজও চলে। যদিও পদ্মা মরে যাবার কারণে আর চলে না জাহাজ স্টিমার বজরা নৌকা। ক’বছর ধরে বেশকটি ট্যুরিজম কোম্পানী এসি বাসে করে পর্যটক নিয়ে আসছে আম বাগান দেখাতে। দেশী-বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের আবাসনের ব্যবস্থাও মন্দ নয়। পর্যটকদের কথা ভেবে। বিশেষ করে তারা যাতে বাগানে কিছুক্ষণ অবস্থান, বিশ্রাম, আমের স্বাদ নেয়া ও তাদের পছন্দমত আম কিনতে পারেন। এমন বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রেখে বেশ ক’জন বাগান মালিক ছোট খাটো রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন।
লেখক : রাজশাহী ব্যুরো -প্রধান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন