মুসলিম উম্মাহর বিশ^জনীন ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, সংহতি, সহমর্মিতার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ, হাসি-খুশি, রম্য-রসাত্বক ও ছন্দময় মুহুর্ত। এটি মুসলমানদের সর্বাধিক প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মুসলিম জাতি বছরে দুটি উৎসব পালন করে থাকে। একটি ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি ঈদুল আজহা। রমজান মাসে সিয়াম সাধনার শেষে ঈদুল ফিতর এবং জিলহজের দশম তারিখে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। প্রতি বছর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও আনন্দ-উৎসবের সাথে মুসলমানরা এ উৎসব পালন করে থাকে। ঈদ অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- সুপ্রশস্ত প্রান্তরে, খোলা গগনতলে মুসলমানদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করা। ঈদ প্রতিটি মুমিন হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে অফুরন্ত প্রেম-প্রীতি। নবচেতনায় জাগিয়ে তোলে মানব কল্যাণের উচ্ছাস।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধনী-নির্ধন, প্রবল-দুর্বল, মনিব-গোলাম, ক্ষমতা ও অক্ষমতার মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। পার্থক্য রয়েছে কেবল তাক্ওয়া, তাওয়াক্কুল ও প্রভূপ্রেমের মধ্যে। সত্য ও মিথ্যা এবং ঈমান ও কুফরীর মধ্যে। সকলে আল্লাহর গোলামির এক ও অভিন্ন রশির অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা।
সুদীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ মুমিন জীবনে খুবই আনন্দঘন একটি মুহূর্ত নিয়ে আসে। মহান আল্লাহ তায়ালা এদিনে মুমিনদেরকে পুরষ্কার প্রদান করেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, “ঈদের দিন উপস্থিত হলে ফেরেশতাগণ রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাড়িয়ে আহবান করে বলতে থাকেন, হে মুসলমানগণ! তোমরা করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের দিকে এগিয়ে আস, যিনি তোমাদেরকে কল্যাণ ও উন্নতির কাজ করার তৌফিক দিয়েছেন, অতঃপর এর বিনিময়ে তিনি তোমাদেরকে পুরষ্কার দান করবেন। তোমাদেরকে রমজানের রাত জাগরণের হুকুম দেয়া হয়েছিল তোমরা তা আঞ্জাম দিয়েছ ও দিনে রোজা রাখতে আদেশ করা হয়েছে তাও তোমরা পালন করেছ এবং আল্লাহর (দারিদ্র্য) বান্দাদেরকে খাবার দিয়েছ। অতএব, তোমরা তোমাদের পুরস্কারগুলো গ্রহণ কর। অতঃপর যখন মুুমিনগণ ঈদের নামাজ হতে অবসর হন তখন একজন আহবানকারী ঘোষণা করতে থাকেন, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা জেনে রাখ যে, মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতএব, তোমাদের কোন চিন্তা-সংশয় নেই, খুশিচিত্তে তোমরা বাড়ী ফিরে যাও। বস্তুতঃ ঈদের দিন হলো- পুরষ্কার বিতরণের দিন এবং আসমানেও ঐ দিনটিকে ‘পুরষ্কার দিন’ বলে নামকরন করা হয়েছে।” (তাবরানী শরীফ) ঈদের দিনে সাহাবীগণের মাঝে দেখা যেত আনন্দ-প্রফুল্লতার ছাপ। তারা পরস্পরকে অভিবাদন জানাত এবং পরস্পরের জন্য মঙ্গল কামনা করত। হযরত যুবায়ের ইবনে নুফাইর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এর সাহাবীগণ ঈদের দিনে সাক্ষাত হলে একে অপরকে বলতেন, “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা” অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে ও আপনার কাছ থেকে কবুল করুন। (ইবনে হাজার আসকালানী (র.) রচিত ‘আল-মুহামিলিয়্যাত’)
ঈদ উৎসবে প্রকাশিত হয় মানবিক সাম্য, সমতা, একতা, সংহতি, সহমর্মিতার এক বিস্ময়কর নিদর্শন যা ইসলামের মহত্ত ও সার্বজনীনতার প্রতীক। সেদিন গরীব-দুঃখী, এতিম-মিসকিনের মুখে ফুটে উঠে আনন্দের ফল্গুধারা এবং মুছে যায় ক্লান্তি-বেদনার ছাপ। ঈদ আমাদের ঐক্যের আহবান জানায়। এ দিনে ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচু, ছোট-বড় সকলে সব ভেদাভেদ ভূলে গিয়ে একই স্থানে, একই দিনে, একই সময়ে, একই কাতারে জামাতবদ্ধভাবে সালাত আদায় করে থাকে। এ দিনে আমরা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও মত বিনিময় করি। ফলে আমাদের মাঝে আন্তরিকতা ও পারস্পরিক ভালোবাসা সুদৃঢ় হয়। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের মাঝে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ভূলে একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এটাই রাসূল (সা.) এর আদর্শ ও শিক্ষা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঈদুল ফিতরের দিনে হযরত রাসূল (সা.) ঈদগাহে যাতায়াতের পথ পরিবর্তন করতেন অর্থাৎ- রাসূল (সা.) ঈদগাহে এক পথ দিয়ে যেতেন এবং অন্য পথ দিয়ে বাড়ীতে আসতেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে পারস্পরিক ভাব বিনিময় করতেন। নিস্ব-অসহায় ও গরিব-দুঃখিদের খোঁজ খবর নিতেন। তাঁর নিখুঁত আদর্শ থেকে ঈদের মৌলিক শিক্ষাগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।
কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় যে, প্রতিবছর দুটি ঈদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ দান করেছেন। এ ঈদদ্বয় উদযাপনের নীতিমালার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ থেকে উৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম নিদর্শন পাওয়া যায়। যার দ্বারা একতা, সততা, একনিষ্ঠতা ও পবিত্রতার বিশুদ্ধতম পদ্ধতি এবং সর্বোত্তম নৈতিক মূল্যবোধ ও মহোত্তম চরিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ তাদের স্বকীয় সুস্থ সংস্কৃতির মধ্যে বিজাতিদের নগ্ন অপসংস্কৃতির আদর্শ চর্চা করে ধর্মের নামে ধর্মহীন উদযাপনে মেতে উঠেছে। নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা, নোংরামি ও উচ্ছৃঙ্খলতা ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়ে তাদের আদর্শ ও ঐতিহ্য ভূলে যাচ্ছে। যা তাদেরকে ঘোর অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ঈদের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে- ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রেই ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার থেকে বিচ্যুত না হয়ে আদর্শিক মূল্যবোধের চর্চা, মার্জিত রুচিবোধ ও শালীনতার মাধ্যমে কর্মসম্পাদন করে ইহ-পারলৌকিক সফলতার পথকে উন্মোচন করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন