(নির্দেশ : দুই) মহান আল্লাহ্র বাণী-
“বলুন, ‘এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন, তা তোমাদেরকে পাঠ করে শোনাই। তা হচ্ছে: ‘তোমরা তাঁর কোন শরীক করবে না, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে,Ñ”(৬:১৫১)
উক্ত আয়াত বিষয়ে বিভিন্ন তাফসীর বিশারদের ব্যাখ্যাসমূহ নি¤œরূপ:-
* তাফসীরবিশারদ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এটিই হচ্ছে সেই চিরস্থায়ী বিধান সম্বলিত অন্যতম আয়াত যা হযরত আদম (আ) থেকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) পর্যন্ত সকলের শরীয়তের ঐকমত্য সম্বলিত বিধান হিসাবে চলে আসছে। আয়াতটির কোন বিষয় কোনো শরীয়তেই রহিত হয়নি।
* হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন, কেউ যদি হযরত রাসূলে কারীম (স)-এর সর্বশেষ ওসিয়্যত কি ছিল, তা দেখতে চায় বা জানতে চায় সে যেন উক্ত আয়াতটি পাঠ করে নেয়।
* হযরত ইবন আব্বাস (রা) আরও বলতেন, “সূরা আন‘আমে কয়েকটি(মুহকামাত) চিরস্থায়ী বিধান সম্বলিত আয়াত রয়েছে; যেগুলো হচ্ছে ‘উম্মুল-কিতাব’ তথা আসমানী কিতাবের মূল। তারপর তিনি উপরিউক্ত আয়াতটি পড়তে শুরু করতেন।
* হযরত উবাদা ইবন সাবিত (রা) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (স) ইনশাদ করেছেন, তোমাদের মাঝে কে আমার সঙ্গে তিনটি বিষয়ের অঙ্গিকার করবে? তারপর মহানবী (স) উক্ত আয়াতটিসহ শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করলেন এবং বললেন, যে-ব্যক্তি এ তিনটি বিষয় আমল করবে তার বিনিময় আল্লাহ্র কাছে অবধারিত। আর যে তা আমলে ত্রæটি করবে, তা হলে সম্ভাবনা রয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে ইহকালেই শাস্তি দেবেন। আর বিষয়টি যদি পরকাল পর্যন্ত বিলম্বিত হয়, তা হলে তাঁর ইচ্ছা, চাইলে শাস্তিও দিতে পারেন, অন্যথায় ক্ষমাও করে দিতে পারেন।
(নির্দেশ : তিন) মহান আল্লাহ্র বাণীÑ
“স্মরণ করুন!Ñযখন বনী ইসরাঈলের অঙ্গিকার নিয়েছিলাম , তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করবে না, মাতাপিতার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করবে”,Ñ(০২:৮৩)
উক্ত বরকতপূর্ণ আয়াতটিতেও ‘একত্ববাদ’ বিষয়ে অঙ্গিকার নেওয়ার পাশাপাশি মাতাপিতার সঙ্গে উত্তম আচরণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
(নির্দেশ : চার) মহান আল্লাহ্র বাণীÑ
“তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর শরীক করবে না; এবং মাতাপিতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে”Ñ(০৪:৩৬)
তাফসীর ‘দুররে মানসূর’ গ্রন্থে রয়েছে, হযরত হাসান (রা)-কে কেউ জিজ্ঞাসা করলো, মাতাপিতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার কিভাবে করা হবে? তিনি জবাবে বললেন, “তুমি তাদের প্রয়োজনে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দেবে এবং তোমাকে তারা যে-নির্দেশ দেবে তা পালন করবে। তবে হ্যাঁ, কোনো পাপকর্মের আদেশ দিলে তা মান্য করবে না।
(নির্দেশ : পাঁচ) মহান আল্লাহ্র বাণীÑ
“Ñসুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও-“(৩১:১৪)
ফকীহ্ আবুল্লায়স সামারকান্দী (র) স্বীয় বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ ‘তাম্বীহুল-গাফেলীন’-এ কোন কোন তাবেয়ীর ভাষ্য উদ্ধৃত করেছেন,“পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অর্থ হচ্ছে, দৈনিক পাঁচবার তাঁদের জন্য দু‘আ করা”।
মাওলানা মুফতী আশেকে এলাহী বুলন্দশহরী (র) নিজগ্রন্থ ‘হুক‚কুল-ওয়ালেদাইন’-এ লিখেন,“যেভাবে আল্লাহ্ তা‘আলার শোকরের ক্ষেত্রে মুখে কয়েকটি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক শব্দ/বাক্য উচ্চারণ করলেই শোকর আদায় হয় না বরং সারা জীবন বাহ্যিক ও গোপনীয়ভাবে তাঁর বিধি-বিধান পালন করে যাওয়ার নাম হচ্ছে শোকর ; ঠিক তেমনি পিতামাতার প্রশ্নে শুধু ‘ভালো কথা বললেই, তাঁদের প্রশংসা করলেই এবং তাঁদের কষ্টের বিষয়ে স্বীকারোক্তি করলেই, তাঁদের শোকর আদায় হয় না। বরং পিতামাতার আনুগত্য করা, মনে-প্রাণে ও সম্পদের দ্বারা তাঁদের সেবা করে যেতে হবে এবং তাঁদের অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকাই হচ্ছে, তাঁদের শোকরিয়া আদায়।
পবিত্র কুরআনের উপরিউক্ত পাঁচটি আয়াতে পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের গ্ররুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের উন্নত ও সভ্যতার দাবীদার জাতিসমূহ নিজেদের আয়নায়্্্্্্্্্্্ চেহারা দেখে বলুক, এসব আদব-শিষ্টাচারের সামান্যও তাদের সমাজে দৃষ্টিগোচর হবে না। ইউরোপের দেশগুলোতে যখন আঠারো বছর পূর্ণ হয়ে যায় তখন সন্তানরা নিজ পিতামাতা থেকে এমনভাবে পৃথক হয়ে যায়Ñযেমন কিনা তারা শত্রæ থেকে মুক্তি পেল! কেউ কেউ তো নিজ যৌবনের নেশায় মাতোয়ারা হয়ে পিতামাতাকে এমনভাবে ভুলে যায়; যেমন কিনা বর্তমান সময়কার মানুষ কবীরা গুনাহ্ করে ভুলে যায়। আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞানবিদ্যা ও বস্তুগত উন্নতি সত্তে¡ও প্রকৃত অর্থে অন্যকে প্রাধান্যদান,দয়া-মায়া-মমতার লেশ মাত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। কবির ভাষায়Ñ
বিশ্বমানবতা বিশ্বজগতের শেষদিন পর্যন্ত মানবতার সেবক দু’জাহানের গৌরব বিশ্বনবীর কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। যিনি অমূল্য সম্পদ আদব-সভ্যতা- ভদ্রতা, সৎ ও উন্নত চরিত্রের শিক্ষাদানের দ্বারা ঘৃণাকে প্রেম-ভালোবাসা দ্বারা এবং শত্রæতাকে বন্ধুত্বের দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। সন্তানদের পিতামাতার প্রতি আদব-সম্মান এ পরিমাণ শিক্ষা দিয়েছেন যে, যদি কোনো সন্তান নিজ পিতামাতার মুখের দিকে ভাব-ভক্তি, মহব্বত-ভালোবাসা নিয়ে তাকায়; তা হলে প্রতি দৃষ্টিতে একটি কবূল হজের সওয়াব পেয়ে যায়!
হাদীস শরীফে এসেছেÑ হযবত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) বলেছেন, পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারী সন্তান যখনই দয়ামায়া, মমতা ও দয়াদ্র দৃষ্টিতে পিতামাতার প্রতি তাকায়, তা হলে প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে একটি করে কবূল হজের সওয়াব লিখে দেন। উপস্থিত সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, যদি সে প্রতিদিন একশবার তাকায়? (সেক্ষেত্রেও কি তেমন সওয়াব পাইতে থাকবে?) নবীজী (স) জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ্ সবচেয়ে বড়,সর্ব শক্তিমান(যাকে যা ইচ্ছা দেন, তাকে কেউ বাধা দিতে পারে না) এবং তিনি সর্বাধিক পবিত্র(তাঁর প্রতি ক্ষতি ও হ্রাস বিষয়টির সম্পর্ক বৈধ নয়)।(মিশকাতুল মাসাবীহ)
পিতামাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা একটি স্বভাবজাত ও সৃষ্টিগত ব্যাপার; তা কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। কিন্তু তারপরও মহান আল্লাহ্র দয়ামায়ার ব্যাপারটি লক্ষণীয় যে, তিনি উক্ত পারস্পরিক স্বভাবজাত মহব্বতের বহিপ্রকাশের ক্ষেত্রেও এতো বিশাল সওয়াব দান করেন।
একটি আকর্ষণীয় ও উপদেশব্যঞ্জক ঘটনা
ইমাম কুরতুবী (র) স্বীয় সংযুক্ত সূত্র-পরম্পরায় হযরত জাবের (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (স) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করলো, আমার পিতা আমার সমস্ত সম্পদ নিয়ে নিয়েছেন। প্রিয়নবী (স) ইরশাদ করলেন, তোমার পিতাকে ডেকে নিয়ে এসো! তখনই হযরত জিব্রাঈল (আ) এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! ছেলেটির পিতা যখন এসে যাবে তখন তার পিতাকে আপনি জিজ্ঞাসা করবেন যে, ওই বাক্যগুলো কি যা তিনি মনে মনে উচ্চারণ করছিলেন এবং তার কানও তা শোনেনি। যুবকটি যখন তার পিতাকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলো তখন মহানবী (স) বললেন, আপনার পুত্র তো আপনার ব্যাপারে অভিযোগ করছে। আপনি কি তার কাছ থেকে তার সম্পদ ছিনিয়ে নিচ্ছেন? পিতা নিবেদন করলো, হে আল্লাহ্র রাসূল (স)! আপনি তার কাছেই জিজ্ঞাসা করুন! আমি তার ফুফু, খালা বা আমি নিজে ব্যতীত আর কোথায় খরচ করি! প্রিয়নবী (স) জিজ্ঞাসা করলেন, বিষয় এ টুকু? তারপর মহানবী (স) ছেলের পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই কথাগুলো কি যা তুমি মনে মনে জপছিলে অথচ তোমার কানও তা শোনেনি? সাহাবী নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (স)! প্রতিটি ক্ষেত্রেই/ব্যাপারেই আল্লাহ্ তাআলা আপনার প্রতি আমাদের ঈমান ও প্রত্যয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে দেন। অর্থাৎ যে-বিষয়টি কানেও শোনেনি, তা-ও আপনি অবহিত হয়ে গেলেন! তারপর তিনি বললেন, আমি মনে মনে কয়েকটি পংক্তি আওড়াচ্ছিলাম। নবীজী (স) বললেন, ওই পংক্তিগুলো আমাদেরকেও শোনাও। ওই সাহাবী নি¤েœাক্ত কাব্যাংশ শোনালেন:
অর্থ: “আমি তোমায় শিশুকালে পানাহার করিয়েছি, সাবালক হওয়ার পরেও;
তোমার সব দায়-দায়িত্ব পালন করেছি, তোমার সবকিছু ছিল আমার রোজগারে।
কোন রাতে যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়তে, সে রাতে আরাম হারাম হয়ে গিয়েছিল;
সে-রাত নিদ্রাবিহীন, কঠোর অস্থিরতায় আমার কেটেছিল।
কেটেছিল সে-রাত তেমনি যেমন রোগী তুমি নও, রোগী ছিলাম আমি;
যে-কারণে সারা রাত কান্নারত কাটিয়েছিলাম, আমি।
আমার অন্তর তোমার মৃত্যু-ভয়ে ছিল, ভীত-কম্পমান;
এমতাবস্থায় যে, জানতাম মৃত্যুর রয়েছে সুনির্ধারিত ক্ষণ।
তারপর যখন তুমি পৌঁছে গেলে সেই বয়স ও সীমায়, যাতে
তোমার উপনীত হওয়া ছিল মোর প্রত্যাশাতে।
আমায় তার প্রতিদান দিলে তুমি, কঠোরবাক্যে, দূর্ব্যবহারে;
যেমন কিনা তুমিই অনুগ্রহ ও দয়া করলে আমারে।
আফসোস! তোমার দ্বারা যদি আমি পিতার হক আদায় না হয়ে উঠে;
নূন্যতম সে-টুকু তো পারতে, যে-টুকু ভদ্রজন করে প্রতিবেশির তরে।
তুমি কমপক্ষে একজন প্রতিবেশী হয়ে, আমার দেনা শোধ করতে;
আমারই সম্পদ হয়ে আমার সঙ্গে কৃপণতার আশ্রয় না নিতে।”
Ñপ্রিয়নবী (স) পংক্তিগুলো শুনে ছেলেটির জামায় ধরে ইরশাদ করলেন-
“তোমার ও তোমার সম্পদের মালিক তোমার পিতা”।(মা‘আরিফুল কুরআন: ব.হা. তাফসীরে কুরতুবী)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন