মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বাঙালির শেকড়ে ফেরার তাগিদ

প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ গোলাম হোসেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব বলতে গেলে একই নদীর দুই ভিন্ন ধারার সাথেই তুলনীয়। এতে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, লোকাচার ও সংস্কৃতির ওপর ধর্মের প্রভাব অপ্রতিরোধ্য বলে পৌত্তলিক ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি সভ্যতা ও সংস্কৃতি যেমনি গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ভারতে, তেমনি প্রায় অবিকল আর একটি পৌত্তলিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল জাহেলি যুগের আরবেও। সুতরাং তাওহিদের যে বিপ্লবী দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন হয়রত মুহাম্মদ (সা.) তা আরবে ও ভারতে প্রতিষ্ঠিত পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাসের সাথেই কেবল সাংঘর্ষিক ছিল তা কিন্তু নয়, বরং এই বিরোধ প্রভাব রেখেছিল সংস্কৃতি ও লোকাচারের ক্ষেত্রেও। আর এই পরিবর্তনের বিষয়টি মুসলিম আরবদের ক্ষেত্রে যেমনি প্রযোজ্য ছিল তেমন প্রযোজ্য ছিল ভারতীয় নও মুসলমানদের ক্ষেত্রেও। কারণ এটি কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না যে, নামাজ বা ইবাদতের ক্ষেত্রে কেউ হবেন শিরকমুক্ত নিভের্জাল তাওহিদবাদী, আর সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বা পহেলা বৈশাখ পালনে হয়ে যাবেন নির্ভেজাল পৌত্তলিক। পবিত্র কাবা থেকে মূর্তি অপসারণে যে চেতনা ও মূল্যবোধ আপস করেনি বাপ-দাদার ঐতিহ্য বা উৎসের নামে, সেই একই চেতনা ও মূল্যবোধের ধারক কোনো তাওহিদবাদীর হস্তযুগল পীর-পুরোহিত, পিতা বা পিতামহের দোহাইতে অথবা উৎসের নামে শিরক আশ্রিত কালচারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে কেমন করে? আর এই সুযোগ থাকলে তাওহিদ আর শিরক মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত কবেই। কারণ বিশুদ্ধ পানিতে দূষিত পানি মেশালে দূষিত পানি বিশুদ্ধ হয় না বরং বিশুদ্ধ পানির বিশুদ্ধতারই পরিসমাপ্তি ঘটে। তাই ইসলাম আরবে প্রতিষ্ঠিত পৌত্তলিকতা ও তদাশ্রিত কৃষ্টি কালচার, দর্শন ও চেতনার বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করেলেও তাওহিদ চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন সব মানবীয় গুণাবলিকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিল যেমনি আরবে, তেমনি ভারতে প্রচলিত শিরক-বিদায়াত, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আপসহীন ভূমিকা গ্রহণ করলেও ভারতীয় সংস্কৃতির শিরক ও কুসংস্কারমুক্ত দিকগুলোর অবসান চায়নি। বলা হয়নি মাছ-ভাতের পরিবর্তে খেজুর আর রুটিতে অভ্যস্ত হতে। ইচ্ছা ও সামর্থ্য থাকলে কারো প্রতিদিন পান্তা-ইলিশ খাওয়ায় কোনো আপত্তিও ছিল না বরং আপত্তি ছিল চড়ক-পূজা, সতীদাহ প্রথা, ছোঁয়া-ছুঁই, জাতিভেদ কালচার, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কাকার ও মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে। ‘চ-ালের ভাষা’ বলে বাংলা বা অন্য কোনো ভাষাকে বর্জন করেনি। তাই বাংলাসহ ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সমৃদ্ধির সূত্রপাত হয়েছিল মুসলিম শাসনেই। এ পর্যায় ইসলাম যতটুকু সফল হয়েছে তার সুফল যেমনি বাংলা তথা ভারতবাসীই ভোগ করছে, তেমনি ব্যর্থতার কিছু থেকে থাকলে তাকে ভারতেরই দুর্ভাগ্য বলতে হবে, যে কারণে দুনিয়ার কাছে ভারতীয়রা আজও অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি জনপদ হিসেবেই খ্যাত। বাংলা তথা ভারতের হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির ভিন্নতা এখানেই। ভাত-মাছ উভয়েরই প্রধান খাদ্য বটে, কিন্তু যার যার পরিবেশে খাওয়ার প্রক্রিয়াটা আদৌ এক নয়। আর এই ভিন্নতা ভাষা, সাহিত্য, শিল্প স্থাপত্যসহ সব ক্ষেত্রে সমানভাবে খাটে। ইসলাম আরবদেরকে জাহেলিয়াতের চরম বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে বের করে আলোক উদ্ভাসিত এক রাজপথের সন্ধান দিয়েছিল, যে পথ ধরে তারা এক সময় হয় উঠেছিল বিশ্ব সভ্যতার শিক্ষাগুরু। মদিনার সনদ, বিদায় হজের দিকনির্দেশনা ও আল কোরআনের শিক্ষায় উজ্জীবিত মুসলমানগণ সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতার নতুন দর্শন ছড়িয়ে দিলেন বিশ্বের আনাচে-কানাচে, তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ আটলান্টিক পাড়ের মরক্কো থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ফিলিপাইন উপকূল পর্যন্ত। আরব আর বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে সংস্কারের সেই ঢেউ লেগেছিল এই উপ-মহাদেশেও। মিথ্যা নয়, জাহেলি যুগের আরবের মতো ভারতের হাজার বছরের জমানো আঁধার পুরোপুরি সরাতে না পারলেও ঊষার আলোর সূচনা পর্বটা সাফল্যের সাথেই শেষ করে গেছেন হাজার বছর আগে আমাদের যে দাদারাÑযা বুদ্ধ, নানক, কবির, শ্রী চৈতন্য কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। আমাদের আস্থা ও প্রত্যয় জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি ও চিন্তার স্বাধীনতা যত প্রশস্ত ও মুক্ত হতে থাকবে মানুষের কাছে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতাও তত বৃদ্ধি পেতে থাকবে, কারণ বিজ্ঞান সে তো ইসলামের একটি অংশ মাত্র, আর উন্নতি ও প্রগতি তারই স্বাভাবিক ফলশ্রুতি।
অবাক লাগে! যাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় ভারতীয়, রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি আর হিন্দি, যারা শাসিত হয় দিল্লির হাতে, তারাই নাকি সেই বাংলাদেশিদের বাঙালিত্বের সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য খাতা-কলম নিয়ে বসে আছেন, যাদের মাতৃভাষা বাংলা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা, যারা সংখ্যার দিক থেকেও গরিষ্ঠ তদুপরি বাংলার প্রাচীন রাজধানী ঢাকা-ই যাদের রাজধানী, অতঃপর সর্বোতভাবে যারা স্বাধীন ও স্বশাসিতও বটে! ওরা কী ভুলে গেল যে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদেরই রক্তের অক্ষরে লেখা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যখন তারা হিন্দির পদমূলে শর্তহীন আত্মসমর্পণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বাংলার জন্য মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ দেখছি এখন বেশি। অথচ এরাই ১৯১১ সালে বঙ্গবিভাগ রদের শর্তে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরে কেবল উল্লসিতই হয়নি বরং ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’ বলে পঞ্চম জর্জ-এর পদমূলে মাথা ঠেকাতেও দ্বিধান্বিত হয়নি। ইতিহাসের সাক্ষ্য, ১৯৪৭ এসে সেই বঙ্গ মাতার ‘মলিন বদন’ উপেক্ষা করে তাকে দ্বিখ-িত করার জন্য এরাই গোঁ ধরেছিল। এখন আবার ইনিয়ে বিনিয়ে বারবার বলছে ‘এসো ’৪৭-এর সীমানাটা মুছে ফেলি, কারণ তোমরা আমরা যে এক জাতিÑবাঙালি’। ভালো কথা, তোমরা যদি বাঙালিই হবে তাহলে তোমাদের পরিচয় ‘ভারতীয়’ কেন? আমাদের মতো বিদ্রোহ করছ না কেন হিন্দির বিরুদ্ধে? দিল্লির চেয়ে ঢাকা অনেক কাছে নয় কী? ঠিক আছে, ধরেই নিলাম তোমাদের মনে-দিলে কপটতার লেশমাত্র নেই, একদম ফকফকা! কিন্তু তোমাদের সাথে বানর-হনুমান কেন, যে হনুমান লংকা পুড়িয়েছে। আমরা তো দানব রাজ-রাবন নই, বাঙালি মানুষ! খাঁটি বাঙালি হওয়ার জন্য তোমাদের আবদার ভূত-প্রেত, রাক্ষস-দানবে বিশ্বাস করতে হবে, চিন্তা-চেতনায় মেনে নিতে হবে প্রস্তর যুগের লিঙ্গ পূজা, নরবলী, সতীদাহ প্রথা? ইতর প্রাণীতে মৈথুনের মতো সংস্কৃতিগুলোকে আবার চালু করতে হবে একবিংশ শতাব্দীর এই দিনে যা হাজার বছর আগে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আমাদের আলোকপ্রাপ্ত দাদা-দাদিরা? উৎসের নামে, শেকড়ের খোঁজে টুপি পাগড়ি পাঞ্জাবী শেরওয়ানি খুলে ফেলে ফিরে যাব কী টিকি, ধূতি আর পৈতার জগতে? বদনা ছেড়ে ধরতে হবে কী আবার ঘটি ও লোটা? কোপ্তা কাবাব জর্দা ফিরনি-বিরানি ছেড়ে কেবলই ভাত-পান্তা, ভর্তা ভাজিতে তৃপ্ত থাকতে হবে এখন থেকে? পাঁচ হাজার আরবি ফার্সি শব্দ ছাঁটাই করে খাঁটি বাংলা দুই হাজার শব্দেই লিখতে হবে বাংলা? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ দিনে আবার শুভা-শুভ নির্ণয় মঙ্গল ঘট, কাক-পেঁচা, হাঁচি-কাশির ওপর নির্ভর করতে হবে? বিশ্বাস করতে হবে দেবীর ‘গজ গমনে’ ফসল ভালো হওয়ার তত্ত্বে? আস্থা ফিরিয়ে নিতে হবে চন্দ্র-সূর্যের বিয়ে, মুষিকের পর্বত প্রসব, রাহুর আগ্রাসন, রাম-রাবণ আর হনুমান কাহিনীতে? খাঁটি বাঙালি হওয়ার জন্য, উৎস ফিরে পাওয়ার জন্য আবারও বিশ্বাস করতে বলা হবে গো-মলের মাহত্ব ও পবিত্রতায়? শেকড়ে ফেরার নামে ঘুরিয়ে দিতে হবে সভ্যতা ও প্রগতির চাকা আবার প্রস্তর যুগের অভিমুখে? ইদানীং আগ্রাসনের খোলা হয়েছে আর এক নতুন ফ্রন্ট। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। কথাটি আপাতত মধুর বৈ কি? কিন্তু প্রশ্ন হলো, দুর্গা পূজা আর গরু কোরবানি সবার উৎসবে পরিণত করার সূত্রটা কী হবে? মিথ্যা নয় যে, এই ডিজিটাল যুগেও কিছু বিভ্রান্ত মুসলিম ‘দেবীর গজে গমনে’ ফসল ভালো হওয়ার তত্ত্বে এখন আস্থাশীল। অতএব দুর্গা পূজা তাদের মূল্যায়নে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। সুতরাং জায়নামাজ থেকে উঠে এসে মূর্তিতে ফুল-চন্দন দিয়ে সম্মান জানানোর অপসংস্কৃতি বাজারজাতে এরা এতটাই আত্মবিস্মৃত যে, এহেন আচরণটি পরলোকগত মানুষটির চেতনা ও বিশ্বাসের প্রতি যে শ্রেফ অবমাননা ও জুলুমের শামিল তা ভাবারও ফুরসত তাদের নেই যেন। একদিকে কোরআনখানি, মিলাদ, মোনাজাত অন্যদিকে ভাস্কর্যে ফুলদান, কী এক অদ্ভুত তামাশা! একজন পরলোকগত মুসলমানের জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী থাকতে পারে? কিন্তু ‘বৃথা এ সাধনা ধীমান! পরিষ্কার কথা, তাওহিদের শিক্ষায় আলোকিত কোনো ব্যক্তির পক্ষে হেন প্রত্যাবর্তন সুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র গমনের চেয়েও অবাস্তব ও অসম্ভব! (শেষ)
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন