মদিনার মোনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অনেক কাহিনী খোদ কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মোনাফেক চক্রের নাম অনুসারে ২৮ পারার ৬৩ নং সূরাটির নাম করা হয়েছে ‘মোনাফিকুন’ নামে। এ সূরার ৭ ও ৮ নং আয়াতে মোনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের যে কাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা প্রণিধানযোগ্য। আয়াত দ্বয়ের অর্থ হচ্ছে: ‘ওরা বলে, তোমরা আল্লাহর রাসূল (সা:)-এর সহচরদের জন্য ব্যয় করো না, যাতে ওরা সরে পড়ে। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর ধন ভান্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মোনাফেকগণ তা বুঝে না।’ ‘ওরা বলে, তোমরা মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথা হতে প্রবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু শক্তি তো আল্লাহরই, আর তাঁর রাসূল ও মোমেনদের। তবে, মোনাফেকগণ এটা জানে না।’
এ দু’টি আয়াত এর ‘শানে-নুজুল’ বা অবতীর্ণ হওয়া বিষয়ে এমন একটি ঘটনা রয়েছে, যার সাথে জড়িত রয়েছে মোনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের মিথ্যাচার ও একজন কমবয়সী সাহাবীকে মিথ্যাবাদী রূপে প্রতিপন্ন করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। ঘটনাটি নিম্নরূপ:
‘বনু মোছতালেক’ নামক বিখ্যাত যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরী পঞ্চম সালে। এ সময় একজন মোহাজের ও একজন আনসারের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া বেঁধে যায়। অতি সাধারণ এ ব্যাপারটি তীব্র আকার ধারণ করে। তারা উভয়ে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রার্থনা করে। উভয়পক্ষের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু কিছু লোক মধ্যস্থতা করে সন্ধি করিয়ে দেয়, ব্যাপারটি এখানেই শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু মোনাফেকদের গুরু ঠাকুর আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই ছিল মুসলমানদের চরম বিরোধী। ঘটনাটির শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হয়ে যাওয়া তার কাছে অসহ্য ছিল। সে ঘটনাটি জানার পর রসূলূল্লাহ (সা:)-এর শানে অশালীন উক্তি করে এবং বন্ধু-বান্ধবদের উদ্দেশ্যে বলে; ‘এসব ঘটনার জন্য তোমরাই দায়ী, তোমাদের কারণেই এসব ঘটেছে। তোমরা এসব লোককে তোমাদের শহরে আশ্রয় দিয়েছ, ধন-সম্পদ তাদের মধ্যে আধা-আধি ভাগ করে দিয়েছ। যদি তোমরা তাদের সাহায্য করা বন্ধ করে দাও, তা হলে তারা এখনই চলে যেতে বাধ্য হবে।’ সে আরও বলে; আল্লাহর কসম! আমরা মদীনায় পৌঁছলে আমরা সম্মানিত ব্যক্তিরা মিলিতভাবে নিকৃষ্টদের সেখান হতে বহিষ্কার করব।’
তার ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তিগুলো সেখানে উপস্থিত কমবয়স্ক সাহাবী হজরত জায়দ ইবনে আরকাম (রা:) শুনছিলেন। তিনি রাগে ক্ষোভে বলে উঠেন; ‘আল্লাহর কসম! তুমিই নিকৃষ্ট, তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তোমাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়, তোমার কোন সমর্থনকারী নেই। রসূলুল্লাহ (সা:) সম্মানিত, আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে সম্মান প্রদান করা হয়েছে এবং তিনি তাঁর কওমের মধ্যে সম্মানের অধিকারী।’ এ কথা শোনবার পর আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই বলে; ‘আচ্ছা, হয়েছে এবার চুপ কর। আমি তো মশকরা করে বলেছি।’
হজরত জায়দ (রা:) রসূূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট গিয়ে মোনাফেকের সব কথা বলেদেন। হজরত উমর (রা:) ঘটনার কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট অনুরোধ জানান যে, এ কাফেরকে হত্যা করা হোক। কিন্তু হুজুর (সা:) হত্যার অনুমতি দিলেন না।
এ খবর অবগত হওয়ার পর আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই হুজুর (সা:)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে মিথ্যা শপথ করে বলে; সে এরূপ বাক্য উচ্চারণ করেনি। জায়দ মিথ্যা বলেছেন।
আনসারদের কিছু লোকও উপস্থিত হয়ে হুজুর (সা:)-এর নিকট সুপারিশ করে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই তাদের সম্প্রদায়ের নেতা, সে বড় লোকদের অন্তর্ভুক্ত। একজন বাচ্চার কথা তার মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সম্ভবত শ্রবণে কিংবা বুঝাতে তার ভুল হয়ে গেছে। রসূলুল্লাহ (সা:) আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের উজর গ্রহণ করলেন এবং হজরত জায়দের কথা প্রত্যাখ্যান করলেন। অত:পর তিনি লজ্জায় কোথাও বের হওয়া বন্ধ করে দেন। এমতাবস্থায় সূরা ‘মোনাফিকুন’ নাজিল হলে তার সম্মান বেড়ে যায় এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের মোনাফেকি চরিত্র ফাঁস হয়ে যায়।
মোনাফেক চক্র ইসলামের শুরু থেকে যুগে যুগে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি ও সর্বনাশ করার জন্য নানাভাবে অপতৎপরতা চালাতে থাকে এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে। নানা দেশে ওদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও তৎপরতা বহু রাষ্ট্রেরও পতন ঘটিয়েছে। ওদের চেনা যেমন অতি প্রয়োজন, ওদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা আরও অধিক প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা মোনাফেকদের স্থান নির্ধারণ করেছেন জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে- ‘আসফালুস সাফেলিন’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন