বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা হজের হুকুম-আহকামের অন্যতম অংশ। হাজীগণের প্রতি এই হুকুম রয়েছে যে, তারা তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে কাঁধ হেলিয়ে-দুলিয়ে চলবেন। ব্যবহারিক ভাষায় একে ‘রমল’ বলা হয়। হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ পাক ফরমান, আজমত ও শ্রেষ্ঠত্ব আমার ইজার এবং কিবরিয়া ও বড়ত্ব আমার চাদর। সুতরাং যে কেউ এই দুটির কোনো একটি আমার নিকট হতে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। [ ইবনে আবি শায়বা : আলমুছান্নাফ : খন্ড ৫, পৃ. ৩২৯, বর্ণনা সংখ্যা-২৬৫৭৯।
আর রমলের হেকমত হচ্ছে এই যে, মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পর ক্রমাগত সাধনা ও দুঃখ-দুর্দশার কারণে মুসলমানগণ হালকা-পাতলা ও কমজোর হয়ে গিয়েছিলেন। হুদায়বিয়া সন্ধির পূর্ববর্তী বছর যখন তারা ওমরা আদায় করার জন্য মক্কায় পৌঁছলেন, তখন তাদের মধ্যে দুর্বলতার চিহ্ন সুস্পষ্ট ছিল। কাবাগৃহ তাওয়াফের সময় তাদের আস্তে আস্তে চলা দেখে মক্কার কাফেরগণ এই অপবাদ দিতে লাগল যে, মুসলমানগণ মক্কাতে খোশহালে ছিলেন, কিন্তু মদিনায় গমন করে তাদের অবস্থা এতই শোচনীয় হয়ে গেছে যে, তারা ঠিকভাবে চলতেও পারছে না। রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট কাফেরদের এই অপবাদ ও অবজ্ঞার ঠাট্টা-বিদ্রুপের কথা পৌঁছাল। তখন তিনি সাহাবায়ে কেরামকে হুকুম দিলেন, কাফেরদের কথা ভুল প্রমাণিত করার জন্য তাওয়াফের সময় হেলে-দুলে, কাঁধ নেড়ে চলবে। সেই সময় হতে এভাবে চলা হজের মানাসেকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
ইমাম মুসলিম ‘আস সহিহ’ গ্রন্থের কিতাবুল হজ অংশে তাওয়াফ এবং ওমরায় রমল করা এবং হজের তাওয়াফের প্রথমে রমল করা বিষয়ে কতিপয় সহিহ হাদিস বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃত করা হলো : (ক) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, ইয়াছরেব (মদিনা মুনাওয়ারা) এর জ্বরে কমজোর হয়ে যাওয়ার পর হুজুর নবী আকরাম সা. এবং তার সাহাবিগণ (হুদায়বিয়া সন্ধির পূর্ববর্তী বছর ওমরার জন্য) মক্কায় তাশরিফ আনয়ন করলেন। তাদের আগমনের সংবাদ শুনে মক্কার মুশরিকগণ (সর্দারগণ) তাদের (গোত্রের) লোকজনকে বলল, আগামী দিন তোমাদের সামনে এমন এক সম্প্রায়ের লোক আগমন করবে, যাদেরকে কঠিন জ্বর কমজোর করে দিয়েছে। সুতরাং (এই সংবাদ শুনে) তারা হাজরে আসওয়াদের কাছে বসে পড়ল। যখন হুজুর সা. এবং তার সাহাবিগণ তাশরিফ আনলেন, তখন হুজুর নবী আকরাম সা. সাহাবাদের উভয় রুকনের মধ্যে (রুকনে ইয়ামানি ও রুকনে ইরাকি) প্রথম তিন চক্করে কাঁধ হেলিয়ে-দুলিয়ে এবং অবশিষ্টগুলোতে আরামে চলার হুকুম দিলেন, যেন মুশরিকগণ তাদের শক্তি অবলোকন করতে পারে। (এই দৃশ্য দেখে) মুশরিকগণ বলাবলি করতে লাগল, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে বলতে ছিলে যে, তাদেরকে জ্বর কমজোর করে দিয়েছে? আসলে তারা তো এতই শক্তিশালী, এতই তীব্র গতিসম্পন্ন। [ সহিহ মুসলিম : কিতাবুল হজ, বাবু এস্তেহবাবুর রমল ফিততাওয়াফি ওয়াল ওমরাতি ওয়া ফিত তাওয়াফিল আউয়্যালি মিনাল হজ, খন্ড ২, পৃ. ৯২৩, বর্ণনা সংখ্যা ১২৬৬। (খ) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. একটি বর্ণনায় বিস্তারিতভাবে বলেছেন, বাইতুল্লাহ, সাফা এবং মারাওয়ার মধ্যবর্তী সাঈ হুজুর নবী আকরাম সা. কেবল মুশরেকিনদেরকে শক্তি দেখানোর জন্য করেছেন। [সহিহ বুখারী : কিতাবুল হজ, বাবু মাজ্বাআ ফিছ ছা’ইয়ে বাইনাছ ছাফা ওয়াল মারওয়াহ, খন্ড, ২ পৃ. ৫৯৪, বর্ণনা সংখ্যা ১৫৬২।]
(গ) অনুরূপভাবে হজরত আবু তোফায়েল আমের বিন ওয়াছিলা রা. বর্ণনা করেছেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, যখন হুজুর নবী আকরাম সা. মক্কায় তাশরিফ আনয়ন করলেন, তখন মুশরিকগণ বলতে লাগল, অবশ্যই মোহাম্মদ সা. এবং তার আসহাবগণ দুর্বলতার কারণে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করতে সমর্থ নন। বর্ণনাকারী বলেন, (এই অপবাদের কারণে) রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবায়ে কেরামকে তিন চক্কর ‘রমল’ করতে এবং চার চক্করে সাধারণভাবে চলার নির্দেশ দিলেন। [ সহিহ মুসলিম : কিতাবুল হজ, বাব প্রগুক্ত, খন্ড ২, পৃ. ৯২১-৯২২, বর্ণনা সংখ্যা ১২৬৮; ইবনে হাব্বান : আসসহিহ, খন্ড ৯, পৃ. ১৫৪, বর্ণনা সংখ্যা ৩৮৪৫।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন