পবিত্র কোরআনে যেমন এতিম-মিসকিন ও দরিদ্র অনাথ শিশু-কিশোরদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তেমনি বহু হাদিসেও রাসূলুল্লাহ (সা:)-এ বঞ্চিত, অবহেলিত এবং দুনিয়ার আনন্দ উৎসব হতে উপেক্ষিত এ শ্রেণীকে সমাজে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এবং তাদের নানা অধিকারের বিবরণ দান করেছেন। ফলে হুজুর (সা:) এর জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরামের নিকট এ এতিম-মিসকিনরা স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী হয়। একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছিলেন; ‘মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ঘর সেটি, যাতে কোনো এতিম থাকে এবং তাঁর সাথে ভলো আচরণ করা হয় এবং সবচেয়ে মন্দ মুসলমানদের সে ঘর, যাতে এতিম থাকে এবং তার সাথে অসদাচরণ করা হয়।’ (ইবনে মাজা)
এতিমদের সম্পর্কে কোরআনে অবতীর্ণ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে অভিভাবকহীন এবং উত্তরাধিকারহীন এ উম্মতের পৃষ্ঠপোষক হওয়ার জন্য হুজুর (সা:) উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। তিনি খোদ তাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কথা ঘোষণা করেন এবং তাদেরকে নিজের বরাবর স্থান দেন। তিনি বলেন, ‘আমি এবং কোনো এতিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি জান্নাতে দুই আঙ্গুল ব্যবধানের দূরত্বে অবস্থান করব।’ (বোখারি, মুসলিম)
তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো এতিম শিশুকে নিজের ঘরে এনে তাকে পানাহার করায়, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত দান করবেন, তবে শর্ত হচ্ছে, সে এমন পাপ করেনি যা ক্ষমার অযোগ্য।’ (তিরমিজি)
রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর এ শিক্ষার ফলে আরবদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এতিমদের ব্যাপারে যাদের অন্তর ছিল নিষ্ঠুর, পাষাণ এবং কঠিন পাথর, তা মোমের চেয়ে নরম হয়ে যায়। এমনকি প্রত্যেক সাহাবীর ঘর একেকটি এতিমখানায় পরিণত হয়ে যায়। হজরত আয়েশা (রা:) নিজের খান্দান এবং আনসারে এতিম শিশুকন্যাদের লালন পালন করতে থাকেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:)-এর অবস্থা ছিল এই যে, তিনি কোনো এতিম শিশু ব্যতীত কখনো খেতেন না।
মিসকিন সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য : রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘মিসকিন সে ব্যক্তি নয়, যে লোকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং এক লোকমা, দুই লোকমা এবং একটি খেজুর, দুইটি খেজুর নিয়ে ফিরে, বরং মিসকিন সে ব্যক্তি, যার এতটুকু অর্থ নেই যে, যা দ্ধারা স্বীয় প্রয়োজন মেটাতে পারে এবং তার দরিদ্র অভাব লোকেরা অনুভব করতে পারে যে, তাকে সাদকা দান করবে এবং সেও লোকদের কাছে হাত প্রসারিত করে। (বোখারি, মুসলিম)
এ হাদিসের মাধ্যমে উম্মতকে এই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, তোমাদের উচিত, সবচেয়ে গরিব, দরিদ্র, অভাবীদের খুঁজে বের করা, যারা দারিদ্র্যের কষাঘাতে লিপ্ত, কিন্তু তারা লজ্জা ও ভদ্রতার কারণে নিজেদের অবস্থা লোকদের কাছে প্রকাশ হতে দেয় না, মিসকিনদের ন্যায় চেহারা বানিয়ে ফিরে না এবং অপরের সামনে হাত পাতে না, এমন লোকেদের তালাশ করে দান করাতে ছওয়াব বেশি।
মিসকিন ও বিধবার দেখভাল : রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনদের জন্য প্রচেষ্টাকারী সে ব্যক্তির ন্যায়, যে সারা রাত আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে থাকে, কষ্ট অনুভব করে না এবং সে রোজাদারের ন্যায়, যে দিনে আহার করে না, সর্বদা রোজা রাখে।’ (বোখারি, মুসলিম)
এতিম-মিসকিনদের পৃষ্ঠপোষকতা নৈতিক দায়িত্ব : এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর দরবারে এসে নিজের অন্তরের কঠোতরা ও নির্মমতার কথা জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘এতিমের মাথায় দয়ার হাত বুলাও এবং মিসকিন খাওয়াও।’ (মেশকাত)
এ হাদিস হতে জানা যায় যে, যদি কোনো লোক তার কঠোর, পাষাণ হৃদয়ের সংশোধন বা চিকিৎসা করতে চায়, তার উচিত হবে বাস্তবে দয়া ও করুণা প্রদর্শনের কাজ শুরু করা। অভাবী-অসহায় লোকদের সাহায্য করা।
দুর্বলদের অধিকার : রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘হে আমার আল্লাহ, আমি দুই দুর্বল শ্রেণীর লোকের অধিকারকে সম্মানিত মনে করি। অর্থাৎ, এতিম ও স্ত্রীর অধিকারকে।’ (নাসায়ী)
রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর এ বাক্যের ধরনই অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, যার মাধ্যমে তিনি লোকদেরকে এই শিক্ষা দেন যে, এতিম ও স্ত্রীদের অধিকারগুলো সংরক্ষণ করা। কেননা, ইসলামের পূর্বে আরব বিশ্বে এই দুই শ্রেণী সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ছিল। সাধারণত এতিমদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হতো এবং তাদের অধিকার হরণ করা হতো। অনুরূপভাবে নারীরও কোনো মর্যাদা ছিল না।
উদাহরণ স্বরূপ কোরআন-হাদিসের আলোকে এতিম-মিসকিনদের অধিকার সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এতদসংক্রান্ত আয়াত ও হাদিসগুলোকে একত্রিত করা হলে একটি বৃহদাকারের গ্রন্থ হয়ে যাবে। পরিশেষে ফকির-মিসকিনদের অধিকার সংক্রান্ত একটি হাদিস উল্লেখ করা হলো-
‘ফকির মিসকিনদের অধিকার ’
অভাবীদের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক : পূর্বের আলোচনায় আমরা এতিম ও মিসকিনদের অধিকারসমূহের কথা কোরআন ও হাদিসের আলোকে আলাদাভাবে উল্লেখ করেছি। কেননা এ দুই শ্রেণীর নাম বিভিন্ন আয়াতে একসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। ফকির বা অভাবীদের কথা কোরআনে আলাদাভাবে বলা হয়েছে। এ ‘ফোকারা’ (ফকির শব্দের বহুবচন) শ্রেণীর মধ্যে ‘আহলে সুফ্ফা’ র নামও রয়েছে। মিসকিন ও ফকির এর মধ্যে অর্থগতভাবে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। সূরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াতে ‘লিল ফোকারায়িল্লাজীনা’ বলে তাদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্ণ আয়াতটির অর্থ হচ্ছে-
‘এটা প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপিত যে, দেশময় ঘুরাফিরা করতে পারে না, যাঞ্জা না করার কারণে অন্য লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট নাছোড় হয়ে যাঞ্জা করে না। যে ধন সম্পদ তোমরা ব্যয় করো, আল্লাহ তো তা সবিশেষ অবহিত।’
এ আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, যে সকল লোক দ্বীনের কাজে ব্যস্ত বা কোনো না কোনোভাবে জেহাদে লিপ্ত থাকার কারণে উপার্জন করতে পারে না, তাদের জন্য ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। এইরূপ লোকদের উদাহরণ হচ্ছে ‘আসহাবে সুফ্ফা’। যারা হজরত মোহাম্মদ (সা:)-এর সময়ে দ্বীনি শিক্ষা লাভের জন্য এবং প্রয়োজনে জেহাদে শরিক হওয়ার জন্য মদিনায় মসজিদে নববীর সংলগ্ন সর্বদা অবস্থান করতেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনি শিক্ষার জন্য যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মনিয়োগ করেছে, তারা অভাবী, তারাও দান-সাদকা পাওয়ার অধিকারী যেমন- ‘আসহাবে সুফ্ফা’ ।
অভাবীদের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক সম্বন্ধে মহানবী (সা:) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত হয়েছিলাম, তুমি আমার সেবা করোনি।’ বান্দা উত্তর করবে; ‘হে প্রভু! আপনি বিশ্বের প্রতিপালক, আমি কিরূপে আপনার সেবা করতাম?’ আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা পীড়িত হয়ে সাহায্য কামনা করেছিল, তুমি তার সেবা করোনি। যদি তার সেবা করতে আমাকে তার নিকটে পেতে।’ তিনি পুনরায় বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমার নিকট ক্ষুধার্ত হয়ে খাদ্য চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি দাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে প্রভু! আপনি তো বিশ্বের সকলেরই খাদ্যদাতা, আমি আপনাকে কিরূপে খাদ্য দিতাম?’ তিনি বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা ক্ষুধার্ত হয়ে তোমার নিকট খাদ্য চেয়েছিল, তুমি সঙ্গতি থাকা সত্তে¡ও তাকে খাদ্য দাওনি। যদি দিতে, তবে সে খাদ্য আমার নিকট পৌঁছাত।’ তিনি আবার বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি পিপাসার্ত হয়ে তোমার নিকট পানি চেয়েছিলাম, তুমি দাওনি। বান্দা বলবে, ‘বিশ্বের প্রতিপালক প্রভু আমার! আমি কিরূপে আপনার পিপাসায় পানি দিতে পারতাম?’ আল্লাহ পাক বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা তোমার নিকট পিপাসায় কাতর হয়ে পানি চেয়েছিল, তুমি দাওনি। যদি দিতে, তবে সে পানির বদলে আজ জান্নাতের সুস্নিগ্ধ বারিধারা পান করতে।’ (মুসলিম, মেশকাত)
এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো এবং পিপাসার্তকে পানি পান করানো অতি সওয়াবের কাজ। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
ঈদ আনন্দ সকল মুসলমানের যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী বৈধভাবে উপার্জিত আয়-আমদানি দ্বারা এ আনন্দ উৎসব করা কল্যাণকর। হালাল উপার্জনের এ অংশে এতিম-মিসকিন, ফকির তথা অসহায়, অভাবী, দুঃখী, দরিদ্রদের অংশীদার করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। বিত্তবানরা যদি এ অসহায়, অবহেলিত, বঞ্চিত, দরিদ্র শ্রেণীগুলোর প্রতি দয়া, দান ও সাহায্য, সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করে দেয়, তা হলে তাদের সারা বছরের অভাব একটি ঈদ মৌসুমেই পূরণ হতে পারে। দ্বারে দ্বারে গিয়ে লোকের কাছে ওদের ভিক্ষার হাত পাততে হবে না। জাকাত-ফিতরা প্রদান করা ধর্মীয় দায়িত্ব। এটা প্রদান করা যাদের ধর্মীয় কর্তব্য এখানের একটা অংশ প্রাপকদের মধ্যে প্রদান করা হলে বড় কিছু করা হলো না, ধর্মীয় দায়িত্বই পালন করা হয় মাত্র। সাদকা বা দান-খয়রাতের অসংখ্য ক্ষেত্র রয়েছে। ঈদ উৎসবকালে সে কথা স্মরণ করে এতিম-মিসকিন, ফকির তথা এ অভাবী বঞ্চিত শ্রেণীগুলোর কথা বিশেষভাবে স্মরণ করার এটা উত্তম ও উপযুক্ত সময়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন