শব্দদূষণ মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শব্দদূষণের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকার সকল বয়সের মানুষ আজ দিশেহারা। কোনভাবে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শব্দদূষণের বিরুদ্ধে দেশে আইন থাকলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগের অভাবে দিন দিন এর মাত্রা বাড়ছে। আর এর ক্ষতির শিকার হচ্ছে কোমলমতি ছোট ছোট বাচ্চারা। বড়রা কোন রকমে শব্দদূষণ সহ্য করতে পারলেও বাচ্চারা তা সহ্য করতে পারছে না। চিকিৎসকদের মতে, বড়দের পাশাপাশি শিশুদের কানের সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। আর বড়-ছোট মিলে রোগীর অনুপাত দেখলে সহজেই ধারণা করা যায় যে, আমাদের দেশের এখন সর্বত্র বিশেষ করে রাজধানীতে অতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে শ্রবণ সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ দূষণের কবলে রাজধানীসহ সারাদেশ। এই শব্দদূষণ মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শব্দ দূষণের কারণে আমাদের দেশের আগামী প্রজন্ম মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দ দূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘিœত হওয়া, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় শব্দদূষণ বিধিমালা কার্যকর রয়েছে। এছাড়া সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তারপরও শব্দদূষণের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতি থেকে জনগণকে রক্ষা করতে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা।
যানবাহনের জোরালো হর্ন ও ইঞ্জিনের শব্দ, যানবাহন চলাচলের শব্দ, রেলগাড়ি চলাচলের শব্দ, বিভিন্ন নির্মাণ কাজের শব্দ, মেশিনে ইট ও পাথর ভাঙার শব্দ, ভবন ভাঙার শব্দ, কল-কারখানা থেকে নির্গত শব্দ, গ্রিলের দোকানে হাতুড়ি পেটার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, নির্বিচার লাউড স্পিকারের শব্দ, অডিও ক্যাসেটের দোকানে উচ্চ শব্দে গান বাজানোর শব্দ, সারাদেশের গ্রামের আনাচ-কানাচ সর্বত্র বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের রোগী আকর্ষণের জন্য রাতদিন উঁচ্চ স্বরে মাইক বাজানোর শব্দ, উড়োজাহাজের শব্দ মিলিয়ে দূষণ চারদিকে।
দেশে বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কোনো না কোনো শ্রুতিক্ষীণতায় ভুগছেন এবং ৯ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রুতি প্রতিবন্ধী। একই সাথে দেশে ১৫ বছর বয়সের নিচের জনসংখ্যার মধ্যে শ্রুতি প্রতিবন্ধীর হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দ দূষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূরভবিষ্যতে ঢাকা মহানগরীর ৫০ শতাংশ মানুষ ৩০ ডেসিবল শব্দ শোনার ক্ষমতা হারাবে। শিশুদের মধ্যে বধিরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও বিকার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, সাধারণত ৬০ ডেসিবল শব্দ একজন মানুষকে অস্থায়ীভাবে বধির করে দিতে পারে এবং ১০০ ডেসিবল শব্দ সম্পূর্ণভাবে বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সেখানে রাজধানীর নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দুই গুণেরও বেশি। আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আবাসিক এলাকায় রাত্রিকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে প্রায় দুই গুণের বেশি। মিশ্র এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। মিশ্র এলাকায় রাত্রিকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দুই গুণেরও বেশি। বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশি। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী এ তথ্য জানা যায়।
শব্দদূষণের প্রভাব দুটি জায়গায় পড়ছে। ফলে শ্রবণ ইন্দ্রিয় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে আমরা ঠিকমত শুনতেও পারি না; রেসপন্সও করতে পারি না। অন্যদিকে আমাদের শ্রবণের একটা সেন্টার আছে সেখানে প্রভাব পড়ছে। এ প্রভাবের কারণে আমাদের ব্রেনের ক্যান্সার থেকে শুরু করে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের প্রতিবন্ধতার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমরা যদি মাইকিং এবং গাড়ির হর্ন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তা হলে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি ও ব্রেনের ক্যান্সার থেকে জনগণকে মুক্ত করতে পারবো।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে শব্দ দূষণের মাত্রা নিরূপণে ২০১৭ সালে ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৮৩.৩ থেকে ১০৪.৪ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকায় ৯২.২ থেকে ৯৭.৮ ডেসিবেল এবং রাত্রিকালীন ৬৮.৭ থেকে ৮৩.৬ ডেসিবেল। মিশ্র এলাকায় দিবাকালীন ৮৫.৭ থেকে ১০৫.৫ ডেসিবেল এবং রাত্রিকালীন ৮৫.৭ থেকে ১০৬.৪ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন ৯৪.৩ থেকে ১০৮.৯ ডেসিবেল।
শব্দদূষণে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত করে, ফলে শরীরে বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যায়। এতে হৃদপিÐের গতি দ্রæত হয়ে যায় এবং হৃদরোগ, বøাডপ্রেশার বেড়ে যায়, অনিন্দ্রা তৈরি হয়। ফলে সারাদিন মেজাজ খিটখিটে থাকে এবং ব্যক্তিত্বের সাধারণ ভারসাম্য বিঘিœত হয়। স্টেজ হরমোন বেড়ে গেলে গ্যাসট্রিক আলসার তৈরি হয়। শব্দ যেহেতু কানের পর্দায় আঘাত করে তাই প্রায় বধিরতারও তৈরি হয়। শৈববকাল শিশুদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো পূর্ণতা পায় না। এরকম সময়ে তাদের কানে যদি সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দের আঘাত পড়ে তা হলে শৈশব থেকে তাদের শোনার ক্ষমতা কমে যায় অথবা প্রায় বধির হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, ঘুম কম হওয়া, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখা এবং লেখাপড়ায় মনোযোগ কমে যায়। ফলে শিশুর মেধার বিকাশ বিঘিœত হয়। শব্দের কারণে স্টেজ হরমোন বেড়ে যাওয়ার কারণে শিশুর ডায়বেটিস, গ্যাসট্রিক বা হজমের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে শিশুর বিকাশ ব্যাহত হয়। শব্দদূষণ রোধ করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে শুধু সরকারের আইনের মাধ্যমে শব্দদূষণ রোধ করা যাবে না। সাথে সাথে দেশের পরিবেশবাদী যে সংগঠনগুলো রয়েছে তাদের কে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। যদি শব্দদূষণ রোধ করা না যায় তাহলে আমাদের দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম অঙ্কুরেই ধবংস হয়ে যাবে। স্থানীয় প্রশাসনকে শব্দদূষণ বন্ধ করার জন্য স্ব স্ব এলাকার মানুষের মধ্যে জনসচেতনা সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন